যদি মনে করেন ট্রাম্পের চীন চুক্তির গল্প শেষ, তবে আসল ঘটনা খেয়াল করেননি
চীনের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা ইতিবাচকভাবে এগোনোর খবরে— এ সপ্তাহের শুরুতেই যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারে উচ্ছ্বাস ও আশাবাদের ধারা দেখা গেছে। অথচ সপ্তাহখানেক আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুমকি দিয়েছিলেন, তিনি চীনের রপ্তানির ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক বাতিলও করতে পারেন। এখন, দেখা যাচ্ছে, সেই বৈঠক এই সপ্তাহেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
সবকিছু দেখেশুনে যদি মনে হয়, এটা কোনো পুরোনো সিনেমা আবার দেখার মতো—যার শেষটা কেউ স্পষ্টভাবে মনে করতে পারে না—তাহলে তার কারণ হলো, এই নাটকের শেষ কখনোই বাস্তবে ঘটেনি।
বিরল ধাতু নিয়ে কূটনৈতিক টানাপোড়েন
ট্রাম্প ও শি-র সাম্প্রতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে চীনের বিরল খনিজ (রেয়ার আর্থ মিনারেল) রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা। এসব খনিজ উপাদান আধুনিক ইলেকট্রনিক ডিভাইস, যেমন স্মার্টফোন থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক গাড়ি পর্যন্ত, প্রায় সবকিছু উৎপাদনে অপরিহার্য।
তবে এই কৌশল নতুন নয়। বিশ্বব্যাপী বিরল খনিজ ধাতুর সরবরাহের প্রায় পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করে চীন, এবং তারা তিন দশক আগেই এখাতে বিদেশি কোম্পানির প্রবেশাধিকার সীমিত করার ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছিল। এরপরে চীনা খনিজের চাহিদা যত বেড়েছে, এখাতে তাদের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ও বাণিজ্য সুরক্ষার নীতিও তত কঠোর হয়েছে।
সপ্তাহান্তে মালয়েশিয়ায় চীনা বাণিজ্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ও শি জিনপিংয়ের শীর্ষ বৈঠকে "কোনো না কোনো রকমের স্থগিতাদেশ বা বিলম্ব" দেখা যেতে পারে এই রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের ক্ষেত্রে।
মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার, যিনি বেসেন্টের সঙ্গে আলোচনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন, জানান যে বেসেন্ট শেষ বৈঠকে চীনা প্রতিনিধিদের বলেছিলেন—"আমরা আর বিরল খনিজ নিয়ে কথা বলতে চাই না।"
গ্রিয়ার পরে সাংবাদিকদের বলেন, "দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ওরাই বরং চায় আমরা বারবার এনিয়ে কথা বলি।"
আর সেটাই সত্য। "কোনো না কোনো বিলম্ব" মানে আসলে হলো, শি ভবিষ্যতেও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে বিরল ধাতুর বাজারে প্রবেশাধিকার ব্যবহার করতে পারবেন, বিশেষ করে ট্রাম্পের কোনো পদক্ষেপে তিনি ক্ষুব্ধ হলে।
চীন যখনই নতুন করে রপ্তানি সীমিত করবে, ট্রাম্প তখনই পাল্টা হুমকি দেবেন—আরও উচ্চ শুল্ক আরোপের।
তবে ট্রাম্প বা শি, কেউই তাদের প্রতিনিধিদের অর্জিত কূটনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখবেন—তার নিশ্চয়তা নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ট্রাম্প প্রায়ই নিজেই এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছেন, যেখানে বেসেন্ট ও গ্রিয়ারের মতো কর্মকর্তারা যে অগ্রগতি অর্জন করেছেন, সেটি তিনি নিজ কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে নস্যাৎ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দেশ পারস্পরিক শুল্ক কমানোর এক চুক্তি স্বাক্ষর করার কয়েক সপ্তাহ পরই ট্রাম্প চীনের ওপর চিপ ডিজাইন সফটওয়্যারের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা জারি করেন (যা পরে তুলে নেওয়া হয়)।
আশার আলো নাকি কূটনৈতিক বিভ্রম?
আশাবাদীরা বলছেন, এই সপ্তাহে ট্রাম্প ও শির বৈঠক থেকে বিরল ধাতু নিয়ে কোনো "অগ্রগতি বা সমঝোতা" আসতে পারে। কিন্তু বাস্তবে উভয় দেশই পূর্ববর্তী চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ একে অপরের বিরুদ্ধে তুলেছে; ফলে কোনো অগ্রগতিকেই অত গুরুত্বসহকারে নেওয়া বেশ কঠিন।
ডোনাল্ড তার প্রথম মেয়াদেও চীনের বিরুদ্ধে এক বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। এরপর হয়েছিল একটি বাণিজ্য চুক্তি। সেই চুক্তির শর্তগুলো এখন চীন মেনে চলেছে কিনা—এনিয়ে গত সপ্তাহেই একটি তদন্ত শুরু করেছেন গ্রিয়ার।
ওই চুক্তিতে চীন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ২০২১ সালের শেষ নাগাদ ২০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন পণ্য কিনবে। কিন্তু বাস্তবে সেই লক্ষ্যমাত্রা থেকে চীন অনেক পিছিয়ে ছিল বলে অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের।
আগুন নেভাতে গিয়ে নতুন আগুন জ্বালানো
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা ঠান্ডা করার চেষ্টা করতে গিয়ে ট্রাম্প আবার উত্তপ্ত করে তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের এক নিকটতম মিত্র ও প্রতিবেশী দেশ—কানাডার সঙ্গে সম্পর্ক।
অন্টারিও প্রদেশের এক সরকারি বিজ্ঞাপনে ১৯৮৭ সালে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের এক বাণিজ্য-বিরোধী ভাষণের অংশ ব্যবহার করা হয়। এর জবাবে ট্রাম্প কানাডার ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দেন—যা যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদারকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি ট্রাম্পের আরোপিত শুল্কের বিরুদ্ধে এখনো তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাননি, তবে তা ভবিষ্যতেও হবে না—এমন নিশ্চয়তা নেই। ট্রাম্প যখন বিজ্ঞাপনটির কারণে বাণিজ্য আলোচনাই স্থগিত করেন, তখন কার্নি বলেন, "রাগ করে কোনো লাভ হয় না। আবেগ দিয়ে কূটনীতি চলে না।"
তবে বাস্তবতা হলো, ট্রাম্প যদি এইভাবে মিত্রদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে থাকেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে সেই দেশের ওপর—যার সঙ্গে সে সবচেয়ে বড় কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত। আর সেই দেশটি হচ্ছে চীন।
