যেভাবে ধাপে ধাপে গুরুত্বপূর্ণ বিরল খনিজের নিয়ন্ত্রণ নিজের দখলে নিল চীন
প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চীন এমন নিয়মাবলী তৈরি করেছে যা দেশটির খনিজসম্পদের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করে। এই খনিজগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই 'বিরল খনিজ' যা যুদ্ধবিমান, সেমিকন্ডাক্টর, গাড়ি সহ বিভিন্ন সামরিক ও নাগরিক পণ্য তৈরিতে অপরিহার্য এবং এসব খনিজের অস্তিত্ব ছাড়া বিশ্ববাসী টিকতে পারবে না
রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ চীনের জন্য বিশাল প্রভাব তৈরি করেছে, কারণ চীন এই খনিজের প্রধান সরবরাহকারী। উদাহরণস্বরূপ, সামারিয়াম এমন একটি বিরল খনিজ যা বহু সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। চীন একচেটিয়াভাবে এটি উৎপাদন করে। এছাড়া, ডিসপ্রোসিয়াম নামক 'অতিবিশুদ্ধ' খনিজকে পরিশোধন করার জটিল কৌশলও চীন একমাত্র দেশ হিসেবে আয়ত্ত করেছে। দ্রুত চিপ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় এই খনিজের বিশ্বজুড়ে সরবরাহ সাংহাইয়ের কেবল একটি কারখানার ওপর নির্ভরশীল।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, চীন বিশ্বজুড়ে ৯০ শতাংশ বিরল খনিজ চুম্বক তৈরি করে, যা ইলেকট্রনিক্স ও বৈদ্যুতিক মোটরে ব্যবহৃত হয়। গাড়িতে ব্যবহৃত কিছু ছোট চুম্বকের একমাত্র উৎপাদকও চীন।
গত বছরের শেষের দিকে চীন নতুন নিয়মগুলো প্রথম প্রয়োগ করে। ওয়াশিংটন চীনে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন সেমিকন্ডাক্টরের রপ্তানি কঠোরভাবে সীমিত করায় পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় দেশটির কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রে চারটি ধাতব উপাদানের সরবরাহ স্থগিত করে। তবে এর মধ্যে বিরল খনিজ অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও, চীন পরবর্তীতে এসব বিরল খনিজ রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করেছে।
চীনের এই রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈঠকে বিতর্কের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বৃহস্পতিবার চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করার সময় এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। রোববারের বাণিজ্য আলোচনার পরে ঊর্ধ্বতন মার্কিন নীতিনির্ধারকরা আশা প্রকাশ করেছেন, চীন হয়তো নতুন নিয়মের প্রয়োগ কিছুটা স্থগিত করতে পারে। চীন এই নিয়মগুলো বজায় রাখলে দীর্ঘমেয়াদে নিজ অর্থনীতিতেও ক্ষতি হতে পারে এবং বিশ্বে নির্ভরযোগ্য সরবরাহকারীর হিসেবে তার ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হতে পারে।
১ অক্টোবর, ২০২৪
প্রাথমিক পদক্ষেপ: বিস্তারিত তথ্যসংক্রান্ত নথি বাধ্যতামূলক
চীন বিরল খনিজ রপ্তানিকারীদের জন্য নতুন শর্ত আরোপ করেছে। এখন তাদের সব বিদেশি গ্রাহকের কাছ থেকে ধাতুগুলো সরবরাহ চেইনে ঠিক কীভাবে ব্যবহার করা হবে তার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।
এই নিয়মের মাধ্যমে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় বিরল খনিজের ধরন ও পরিমাণের একটি পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র পাবে।
৩ ডিসেম্বর, ২০২৪
চারটি প্রয়োজনীয় ধাতুর ওপর নিষেধাজ্ঞা
চীন যুক্তরাষ্ট্রে চারটি ধাতুর রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এই ধাতুগুলো বিরল খনিজ নয়, তবে প্রয়োজনীয়। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গ্যালিয়াম ও জার্মেনিয়ামের নতুন করে রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এগুলো কয়েক ধরনের সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হয়।
এছাড়া অ্যান্টিমনি ও টাংস্টেনের রপ্তানি বন্ধ করা হয়, যা গোলাবারুদ ও অন্যান্য সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়।
এবার চীন কেবল সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি সীমিত করেনি, বরং অন্য দেশের প্রতিষ্ঠানের মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ধাতু স্থানান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল।
৪ এপ্রিল, ২০২৫
কিছু বিরল খনিজও চুম্বকের ওপর রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ
চীন ১৭টি বিরল খনিজের মধ্যে সাতটির ওপর এবং এগুলো দিয়ে তৈরি চুম্বকের ওপর রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। এবার শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, সব দেশের কাছে রপ্তানি বন্ধ করা হয়। পরবর্তী দুই মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খুব সীমিত রপ্তানি লাইসেন্স মঞ্জুর করে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাপানের অটোমোবাইল নির্মাতা ও সরবরাহকারীরা তাদের মজুত শেষ করে ফেলে এবং কিছু ক্ষেত্রে উৎপাদনও স্থগিত হয়। গ্রীষ্মকালে লাইসেন্স প্রদানের গতি বাড়ে, তবে অনেক বিদেশি কারখানাই এখনো তীব্র ঘাটতির সম্মুখীন।
ছয় মাসের বেশি সময় পরে সামারিয়াম নামে এক বিরল খনিজ রপ্তানি এখনও বন্ধ আছে, যা সামরিক চুম্বকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাকি ছয়টি বিরল মৃত্তিকা ও চুম্বকের জন্য চীন ছয় মাস মেয়াদি লাইসেন্স প্রদান করছে। এসব লাইসেন্সের মেয়াদ শীঘ্রই নবায়নের জন্য আসবে।
৯ অক্টোবর, ২০২৫
বিরল খনিজ প্রযুক্তি সংক্রান্ত গোপন তথ্য স্থানান্তর বন্ধ
সেদিনের একাধিক পদক্ষেপের মধ্যে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একটি তাৎক্ষণিক নির্দেশনা জারি করে। দেশ থেকে বিরল খনিজ প্রক্রিয়াকরণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি বা তথ্য কোনোভাবে দেশের বাইরে স্থানান্তর করতে হলে মন্ত্রণালয়ের অনুমতি বাধ্যতামূলক। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে খনন থেকে রিসাইকেল করা পর্যন্ত প্রায় সমস্ত ধাপ।
অন্য দেশগুলো যাতে নিজেদের বিরল খনিজ খাত উন্নয়ন করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে এই নির্দেশনার মাধ্যমে চীনা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির লাইসেন্স করা থেকে শুরু করে চীনের কর্মী নিয়োগ পর্যন্ত বিস্তৃত কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
চীন এই শিল্পে প্রায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে বিস্তৃত রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করছে।
বিরল খনিজ প্রক্রিয়াকরণ যন্ত্রপাতির রপ্তানি বন্ধ
চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ৮ নভেম্বর থেকে অনুমতি ছাড়া কোনো চুল্লি, রাসায়নিক বা অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও উপকরণ চীনের বাইরে পাঠানো যাবে না। এগুলো বিরল খনিজ প্রক্রিয়াজাত করতে প্রয়োজন।
চীন বিরল খনিজ পরিশোধনাগার ও চুম্বক কারখানার যন্ত্রপাতির প্রধান উৎপাদক। ফলে অন্য দেশগুলোর নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা দেরি হতে পারে।
চীন আরও পাঁচটি বিরল মৃত্তিকা রপ্তানি লাইসেন্সের আওতায় নিয়ে এসেছে
চীন ৪ এপ্রিল সাতটি বিরল খনিজের জন্য যেসব লাইসেন্স আবশ্যকীয় করেছিল, তার সঙ্গে আরও পাঁচটি বিরল খনিজ যোগ করা হয়েছে। চুম্বক এবং এই বিরল মৃত্তিকা থেকে তৈরি অন্যান্য উপকরণও নিয়ন্ত্রণের আওতায় এসেছে।
এর ফলে চীন বিশ্বজুড়ে বিরল খনিজ সরবরাহে আরও বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারবে।
ব্যাটারি তৈরির যন্ত্রপাতি সীমাবদ্ধ
৮ নভেম্বর থেকে চীনের অনুমতি ছাড়া ব্যাটারি তৈরির যন্ত্রপাতি বিদেশে পাঠানো যাবে না। এর ফলে বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা এবং সৌর বা বায়ু শক্তি ব্যাটারি নির্মাণে চীনের গুরুত্ব বেড়ে যাবে।
'ডায়মন্ড স' ও শক্তিশালী যন্ত্রের রপ্তানি বন্ধ
সেমিকন্ডাক্টর ও সৌর ওয়েফার তৈরিতে ব্যবহৃত 'ডায়মন্ড স' [হীরার করাত] ও অন্যান্য শক্তিশালী যন্ত্রের রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে চীন সেমিকন্ডাক্টর ও সৌর ওয়েফার উৎপাদনে নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারবে।
চীনের বিরল খনিজ ব্যবহার করা ম্যাগনেটের আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ
১ ডিসেম্বর থেকে চীনের বিরল মৃত্তিকা ব্যবহার করা যে কোনো চুম্বক অন্য দেশে পাঠাতে হলে অনুমতি নিতে হবে। চীনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদেশে তৈরি চুম্বকের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে।
এর ফলে চীন চাইলে ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহে বা অন্যান্য দেশের সামরিক নির্মাণে বাধা দিতে পারবে।
১৪ অক্টোবর, ২০২৫
নেক্সপেরিয়া কম্পিউটার চিপের ইউরোপে রপ্তানি বন্ধ
নেদারল্যান্ডের নেক্সপেরিয়া প্রতিষ্ঠানকে ২০১৮ সালে একটি চীনা সংস্থা অধিগ্রহণ করে। সংস্থাটি ঘোষণা করেছে, চীনের পক্ষ থেকে তাদের সেমিকন্ডাক্টরের রপ্তানি বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরপর ফোক্সভাগেন-এর মতো ইউরোপের অটোমোবাইল নির্মাতারা চিপ ঘাটতির মুখোমুখি হয়।
নেদারল্যান্ডের সরকার নেক্সপেরিয়ার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পর চীনের এই পদক্ষেপ আবারও দেখালো, কীভাবে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে চীন বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
