জাপানের সামরিকায়নের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়ে নানকিং গণহত্যা স্মরণ করল চীন
জাপানের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে নানকিং গণহত্যার বার্ষিক জাতীয় স্মরণ অনুষ্ঠানে প্রতিবেশী দেশটির নতুন করে করে সামরিকায়ন পুনরুত্থানের যেকোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে চীন।
আজ শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) চীনের পূর্বাঞ্চলীয় শহর নানজিংয়ে আয়োজিত স্মরণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক বিভাগের প্রধান শি তাইফেং বলেন, সামরিকবাদের পুনরুজ্জীবন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা কিংবা বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন করার যেকোনো প্রচেষ্টা "ব্যর্থ হতে বাধ্য"। রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম সিসিটিভি এ তথ্য জানিয়েছে।
কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবশালী পলিটব্যুরোর ২৩ সদস্যের একজন শি তাইফেং নানকিং গণহত্যার ৮৮তম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা।
নানজিংয়ে গণহত্যায় আগ্রাসী জাপানি সেনাদের হাতে নিহতদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধে এই স্মরণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
সকাল ১০টা ১ মিনিটে শহরজুড়ে বিমান হামলার সাইরেন বেজে ওঠে। একই সঙ্গে গাড়ি, ট্রেন ও নৌযানগুলোও হর্ন বাজিয়ে শ্রদ্ধা জানায়।
চীনের জননিরাপত্তা মন্ত্রী ও স্টেট কাউন্সেলর ওয়াং শিয়াওহংয়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অনুষ্ঠানে শি তাইফেং বক্তব্য দেন। তিনি নানকিং গণহত্যাকে "মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ" হিসেবে উল্লেখ করে একে "অমোচনীয়" আখ্যা দেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে "সঠিক ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠার" আহ্বান জানান।
১৯৩৭ সালের ১৩ ডিসেম্বরে চীনের জাতীয়তাবাদী সরকারের রাজধানী নানকিং (বর্তমান নানজিং) পতনের পর জাপানি বাহিনী সেখানে ৩ লাখেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে বলে চীনের হিসাব। নিহতদের অধিকাংশই ছিলেন বেসামরিক নাগরিক। প্রায় ছয় সপ্তাহ ধরে চলা এই হত্যাযজ্ঞে ধর্ষণ, নির্যাতন, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়।
তবে নিহতের সংখ্যা নিয়ে জাপান দীর্ঘদিন ধরেই আপত্তি জানিয়ে আসছে, যা চীনে তীব্র ক্ষোভ, সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
২০১৪ সালে চীন ১৩ ডিসেম্বরকে জাতীয় স্মরণ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সে বছর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তিনি ২০১৭ সালে ৮০তম বার্ষিকীতেও অংশ নেন।
অন্যান্য বছরগুলোতে সাধারণত পলিটব্যুরোর কোনো সদস্যই সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি হিসেবে অনুষ্ঠানে অংশ নেন। ব্যতিক্রম ছিল ২০২২ সালে ৮৫তম বার্ষিকী, যেখানে পলিটব্যুরো স্থায়ী কমিটির সদস্য সাই চি উপস্থিত ছিলেন।
এ বছরের স্মরণ অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়েছে বেইজিং ও টোকিওর মধ্যে তীব্র কূটনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেই। গত মাসে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির দেওয়া তাইওয়ান–সংক্রান্ত মন্তব্য থেকে এই উত্তেজনার সূত্রপাত হয়।
৭ নভেম্বর জাপানের সংসদে দেওয়া বক্তব্যে তাকাইচি বলেন, চীনের গণমুক্তি ফৌজ যদি তাইওয়ানে হামলা চালায়, তাহলে তা জাপানের জন্য "অস্তিত্ব বিপন্নকারী পরিস্থিতি" তৈরি করতে পারে, যা (তাইওয়ানে) জাপানি বাহিনী মোতায়েনের যৌক্তিকতা সৃষ্টি করবে।
এই মন্তব্যের জেরে পূর্ণমাত্রার কূটনৈতিক সংকট তৈরি হয় এবং চীন–জাপান সম্পর্ক নতুন করে তলানিতে পৌঁছে। বেইজিং একের পর এক পাল্টা পদক্ষেপ নেয়।
চীন এই মন্তব্যকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ, যুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রতি চ্যালেঞ্জ এবং তাইওয়ান প্রশ্নে টোকিওর দীর্ঘদিনের 'কৌশলগত অস্পষ্টতা' নীতিকে পরিত্যাগ করার অংশ হিসেবেই দেখছে।
চীন তাইওয়ানকে নিজ ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে এবং প্রয়োজন হলে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পুনরেকত্রীকরণের কথা বলে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার চুক্তিভিত্তিক মিত্র জাপানসহ অধিকাংশ দেশ তাইওয়ানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। তবে ওয়াশিংটন জোরপূর্বক দখলের বিরোধিতা করে এবং তাইওয়ানকে অস্ত্র সরবরাহে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
গত সপ্তাহান্তে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়, যখন চীন ও জাপানের যুদ্ধবিমান আকাশে মুখোমুখি অবস্থানে যায়।
জাপানের অভিযোগ, চীনের লিয়াওনিং বিমানবাহী রণতরী থেকে উড্ডয়ন করা চীনা জে–১৫ যুদ্ধবিমান ওকিনাওয়ার কাছে আন্তর্জাতিক আকাশসীমায় মহড়ার সময় জাপানের এফ–১৫ বিমানকে ফায়ার-কন্ট্রোল রাডারে লক করে। বেইজিং পাল্টা অভিযোগ করে জানায়, টোকিও ইচ্ছাকৃতভাবে চীনের বৈধ সামরিক মহড়া ব্যাহত করছে এবং আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়াচ্ছে।
এদিকে শুক্রবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুও জিয়াকুন বলেন, নানকিং গণহত্যা মানব ইতিহাসের "সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়গুলোর একটি"।
তিনি বলেন, "আমরা কখনোই জাপানের ডানপন্থী শক্তিকে ইতিহাস বিকৃত করতে দেব না, কখনোই বাইরের শক্তিকে চীনের তাইওয়ান অঞ্চলে হস্তক্ষেপ করতে দেব না, এবং কখনোই জাপানি সামরিকবাদের পুনরুত্থান মেনে নেব না।"
