যেভাবে ১ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাল চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত
চীনের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বা 'ট্রেড সারপ্লাস' প্রথমবারের মতো ১ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। সহজ কথায়, দেশটি যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করে, তার চেয়ে ১ ট্রিলিয়ন ডলার বেশি মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে। এটি একটি বিশাল মাইলফলক। চীনকে বলা হয় 'বিশ্বের কারখানা'। মোজা আর পর্দা থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক গাড়ি—সবই তৈরি হয় সেখানে।
চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে চীনের রপ্তানি বেড়ে ৩.৪ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে আমদানি কিছুটা কমে হয়েছে ২.৩ ট্রিলিয়ন ডলার। ফলে দেশটির বাণিজ্য উদ্বৃত্ত দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলারে। সোমবার চীনের কাস্টমস বিভাগ এই তথ্য জানিয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বৈশ্বিক বাণিজ্য যুদ্ধ বা 'ট্রেড ওয়ার' সত্ত্বেও চীনের রপ্তানি রমরমা। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ট্রাম্প অনেক দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করেছিলেন। শুরুতে চীনের ওপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক বসানো হয়েছিল। পরে আলোচনার স্বার্থে তা কমানো হয়। কিন্তু চীন আমেরিকার বাইরের বাজারগুলোতে রপ্তানি বাড়িয়ে এই ধাক্কা সামলে নিয়েছে।
২০২৪ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প জেতার পর চীন তার রপ্তানি বাজার বদলাতে শুরু করে। তারা এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে। শুল্ক এড়াতে তারা চীনের বাইরে নতুন উৎপাদনের কেন্দ্রও তৈরি করেছে।
কেন এত বিশাল উদ্বৃত্ত?
অক্টোবরে কিছুটা কমার পর গত মাসে চীনের রপ্তানি আবারও বেড়েছে। এক বছর আগের তুলনায় এটি ৫.৯ শতাংশ বেশি। এর বিপরীতে আমদানি বেড়েছে মাত্র ১.৯ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে চীনের পণ্যের উদ্বৃত্ত গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২১.৭ শতাংশ বেড়েছে। এর মূল চালিকাশক্তি হলো হাই-টেক বা উচ্চ প্রযুক্তির পণ্য।
গাড়ি রপ্তানিতে চীন এখন জাপান ও জার্মানির বাজার দখল করছে। বিশেষ করে ইলেকট্রিক গাড়ির ক্ষেত্রে তাদের জয়জয়কার। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান 'অটোমোবিলিটি'র তথ্যমতে, এ বছর চীন থেকে মোট গাড়ি রপ্তানি ১০ লাখ বেড়ে প্রায় ৬৫ লাখে দাঁড়িয়েছে। এনভিডিয়ার মতো মার্কিন চিপ কোম্পানিগুলোর চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনে চীন প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। এই খাতে রপ্তানি বেড়েছে ২৪.৭ শতাংশ। জাহাজ নির্মাণেও চীন এগিয়ে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের তুলনায় এই খাতে রপ্তানি বেড়েছে ২৬.৮ শতাংশ। অন্যদিকে, আমেরিকা চীনের পণ্যের ওপর শুল্ক কিছুটা কমালেও তা এখনো গড়ে প্রায় ৩৭ শতাংশ। একারণে গত নভেম্বর পর্যন্ত আমেরিকায় চীনের রপ্তানি ২৯ শতাংশ কমেছে।
অনেক চীনা কোম্পানি তাদের কারখানা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মেক্সিকো এবং আফ্রিকায় সরিয়ে নিচ্ছে। এতে তারা সরাসরি চীন থেকে পণ্য না পাঠিয়ে ট্রাম্পের শুল্ক এড়াতে পারছে। উদাহরণস্বরূপ, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ইন্দোনেশিয়া থেকে আমেরিকার আমদানি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বেড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এগুলো আসলে চীনা পণ্য যা ইন্দোনেশিয়া হয়ে যাচ্ছে।
ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের অর্থনীতিবিদ জিচুন হুয়াং বলেন, ভিয়েতনামেও চীনের রপ্তানি দ্রুত বাড়ছে। আমেরিকার সঙ্গে ব্যবসা কমলেও চীন অন্য বড় অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে চীনের রপ্তানি ১৫ শতাংশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ৮.২ শতাংশ বেড়েছে।
চীনের সাফল্যের আরেকটি বড় কারণ তাদের সস্তা মুদ্রা। ইউয়ান বা রেনমিনবি-র মান কম থাকলে রপ্তানি পণ্য উৎপাদন খরচ কমে। কিন্তু আমদানির খরচ বেড়ে যায়। চীন তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে মুদ্রার মান নিয়ন্ত্রণ করে যাতে দাম স্থিতিশীল থাকে।
অর্থনীতিবিদরা অনেক দিন ধরেই বলছেন, চীন ইচ্ছে করে তাদের মুদ্রার মান কমিয়ে রাখে। এতে সস্তা পণ্যের কারণে তারা বিশ্ববাজারে সুবিধা পায়। তথ্যে দেখা যায়, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির হিসেবে চীনের মুদ্রার প্রকৃত বিনিময় হার ২০১২ সালের পর এখন সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে।
চীন কীভাবে এই অবস্থানে এল?
চীনের এই ১ ট্রিলিয়ন ডলারের রেকর্ড উদ্বৃত্ত একদিনে হয়নি। এটি কয়েক দশকের শিল্প নীতির ফল। সত্তরের দশকে চীন ছিল একটি দরিদ্র কৃষিভিত্তিক দেশ। সেখান থেকে আজ তারা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি।
আশির দশকে চীন টি-শার্ট আর জুতো তৈরির নির্ভরযোগ্য কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পায়। এরপর তারা ধীরে ধীরে ভারী শিল্পের দিকে ঝুঁকেছে। এখন তারা বানাচ্ছে ইলেকট্রিক গাড়ি আর সোলার প্যানেল।
রপ্তানির সবচেয়ে বড় খাত এখন ইলেকট্রনিক্স। ২০২৪ সালে তারা ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি ইলেকট্রনিক পণ্য রপ্তানি করেছে। তারা খুব দ্রুত এবং বিশাল পরিসরে এটি করেছে, যা বিশ্বজুড়ে তাদের আধিপত্য নিশ্চিত করেছে।
স্মার্টফোন থেকে যুদ্ধবিমান—সবকিছুতেই লাগে 'রেয়ার আর্থ মেটাল' বা বিরল খনিজ। এই খনিজের বাণিজ্যেও চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য। বিশ্বের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বিরল খনিজ চীন তোলে এবং ৯০ শতাংশ প্রক্রিয়াজাত করে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার যে অবস্থান ছিল, অর্থনীতির অনুপাতে চীনের বর্তমান বাণিজ্য উদ্বৃত্ত তার চেয়েও বড়।
অন্য দেশগুলো এখন বাণিজ্যের এই ভারসাম্যহীনতা কমাতে চাইছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সতর্ক করেছেন যে, বেইজিং ব্যবস্থা না নিলে ইউরোপ কঠোর হতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ইতিমধ্যে চীনা ইলেকট্রিক গাড়ির ওপর অতিরিক্ত শুল্ক বসিয়েছে। জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীও আলোচনার জন্য চীন সফর করছেন। তিনি চীনের বিরল খনিজ এবং শিল্পের অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন।
আমেরিকা ও ধনী দেশগুলো চীন থেকে সরে আসার চেষ্টা করলেও চীনের বাণিজ্যের গতি কমার লক্ষণ নেই। মর্গান স্ট্যানলির অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দশকের শেষ নাগাদ বিশ্ব রপ্তানিতে চীনের ভাগ ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৬.৫ শতাংশ হবে। আপাতত মনে হচ্ছে, বেইজিং তাদের বার্ষিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সহজেই পূরণ করবে।
