ইউক্রেন রণাঙ্গনে ব্যর্থ পশ্চিমা ড্রোন: যুদ্ধক্ষেত্রে প্রযুক্তির নতুন বাস্তবতা!
ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে একসময় প্রযুক্তিগত বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে দেখা আমেরিকান "সুইচব্লেড" ড্রোন এখন অনেকটাই ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর অপরিহার্য অস্ত্র ছিল এই দ্রুতগতির, নির্ভুল ড্রোনগুলো। কিন্তু ২০২২ সালে সুইচব্লেড-৩০০ মডেলের একটি চালান ইউক্রেনে পৌঁছানোর পরই সব আশা ভেস্তে যায়। ড্রোনগুলো ছিল ব্যয়বহুল, রাশিয়ার ইলেকট্রনিক যুদ্ধ ব্যবস্থার মুখে অকার্যকর, আর যখন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পেড়েছে, তখনও ক্ষয়ক্ষতি করেছিল ন্যূনতম।
ইউক্রেনীয় ড্রোন নির্মাতা ভ্যালেরি বোরোভিক বলেন, "আমরা যখন এগুলো পরীক্ষা করেছিলাম, জ্যামিং অবস্থায় এগুলো একদমই কাজ করেনি। একবার যখন একটি মিনিবাসের পেছনের জানালায় আঘাত করে, তখন সামনের কাচও ভাঙেনি।"
এরপর থেকে বিভিন্ন পশ্চিমা কোম্পানি ইউক্রেনে তাদের ড্রোন প্রদর্শনের চেষ্টা করেছে, যা এখন বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা ব্যর্থ হয়েছে। ইউক্রেনীয় কোম্পানিগুলো, যারা একসময় মার্কিন অ্যান্ডুরিল বা ইউরোপীয় হেলসিং-এর মতো সামরিক ড্রোন প্রযুক্তি জায়ান্টদের অনুসরণ করতে চেয়েছিল, এখন তারাই হয়ে উঠেছে নতুন পথপ্রদর্শক। বোরোভিকের মতে, যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্রযুক্তির মধ্যে "মাত্র ২০-৩০% পশ্চিমা।" তিনি বলেন, "ড্রোন প্রযুক্তিতে ইউক্রেন এখন প্রায় বিশ্বের সব দেশকেই ছাড়িয়ে গেছে।"
এর একটি কারণ খরচ, তবে আরও বড় কারণ হলো কার্যক্ষমতা। ইউক্রেনীয় ড্রোন কোম্পানিগুলো এমন পণ্য তৈরি করছে যা যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতার সঙ্গে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ — দ্রুত, নমনীয় এবং সামরিক চাহিদার দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে সক্ষম। ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর একটি কনসোর্টিয়াম– টেক ফোর্স ইন ইউএ-এর প্রধান ভাদিম ইউনিক বলেন, "যদি আপনি কখনো সমুদ্র না দেখেন, তাহলে ভালো নৌকা বানাতে পারবেন না।"
অর্থাৎ, তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, পশ্চিমা ড্রোন নির্মাতারা যেহেতু এই যুদ্ধের ধরন ও শত্রুপক্ষের পাল্টা ব্যবস্থা সম্পর্কে ইউক্রেনীয়দের চেয়ে কম অবহিত, তাই তাদের তৈরি ড্রোনও সফলতা পাচ্ছে না।
সমস্যার মূল আসলে দর্শনের সংঘাতে। পশ্চিমা দেশগুলো এতদিন ধরে সীমিত যুদ্ধে ব্যবহারযোগ্য উচ্চমানের প্রযুক্তি তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছে, যেখানে প্রতিপক্ষ ছিল তুলনামূলক দুর্বল। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন — এটি সর্বাত্মক, ভারসাম্যপূর্ণ এবং প্রযুক্তিগতভাবে 'গণতান্ত্রিক'। ইউক্রেন ২০২৩ সালে যে সস্তা এফপিভি ড্রোনের ব্যবহার শুরু করেছিল, তা এখন রাশিয়াও নকল করছে, এবং এই ড্রোনগুলো উচ্চমূল্যের সামরিক লক্ষ্য ধ্বংসে ব্যবহৃত হচ্ছে। রাশিয়া এদিকে "স্প্যাম" কৌশল অবলম্বন করেছে — প্রচুর ড্রোন একসঙ্গে ব্যবহার করে প্রতিরক্ষা ভেদ করার চেষ্টা করছে।
এই বাস্তবতায় ড্রোনের ব্যবহারযোগ্য সময় বা 'লাইফস্প্যান' অত্যন্ত সীমিত। ইউক্রেনে একটি গ্রাউন্ড ড্রোন বা স্থলচর ড্রোনের গড় আয়ু মাত্র এক সপ্তাহ, বলেন এই ধরনের ড্রোন তৈরিতে ইউক্রেনে অগ্রদূত প্রতিষ্ঠান- বিউরেভি ডিজাইন ব্যুরোর প্রধান ভিক্টর দোলগোপিয়াতভ। ২,০০০ কিলোমিটারের ফ্রন্টলাইনে এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কল্পনাতীত। ফলে কয়েক লাখ ডলারের পশ্চিমা গ্রাউন্ড সিস্টেম পাঠানোর কোনো যুক্তি নেই, যখন একই কাজের ইউক্রেনীয় ড্রোন তৈরি হচ্ছে মাত্র ১০ থেকে ২০ হাজার ডলারে। ইউক্রেনের সরকারি প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ইউনিট ব্রেভ-১-এর কর্মকর্তা এদুয়ার্ড লিসেঙ্কো বলেন, "এটা ঠিক এমন যেন সবাইকে গাড়ি দেওয়ার জন্য আপনি বিএমডব্লিউ বেছে নিচ্ছেন, তুলনামূলক কম দামের স্কোডা অক্টাভিয়াস নয়।"
তিনি বলেন, বিএমডব্লিউ দ্রুত চলতে পারে ঠিক এবং তাতে যাত্রা বেশি আরামদায়কও — কিন্তু সেটা সব কাজের জন্য ভালো না-ও হতে পারে।
ইউক্রেনের নিজস্ব ড্রোন উৎপাদনে এই "স্কোডা মডেল" চিন্তাধারার প্রতীক হলো ব্লিসকাভকা ড্রোন, যা রাশিয়ার মলনিয়া ড্রোনের রিভার্স ইঞ্জিনিয়ার করা সংস্করণ। এটি অত্যন্ত সস্তা উপকরণে তৈরি, দেখতে তেমন আকর্ষণীয় নয়, কিন্তু সামনের সারির সৈন্যদের জন্য কার্যকর। মাত্র ৮০০ ডলারে তৈরি এই ড্রোন ৮ কেজি বিস্ফোরক ৪০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত বহন করতে পারে। প্রকৌশলীরা বলছেন, পশ্চিমা কোম্পানিগুলো এখনো অতিরিক্ত নকশা ও অত্যধিক ব্যয়ের চক্রে আটকে আছে। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়ে কার্যকর ড্রোন উৎপাদনে মনোযোগ দিচ্ছে ইউক্রেন, আর তাতে আশাতীত সাফল্য পাচ্ছে।
যেসব পশ্চিমা কোম্পানি ইউক্রেনে সাফল্য পেয়েছে, তারা প্রথম থেকেই স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের কার্যক্রম শুরু করেছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুত পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েও গেছে তারা। এর মধ্যে রয়েছে গুগলের সাবেক সিইও এরিক শ্মিটের সমর্থিত প্রতিষ্ঠান এবং নজরদারি ড্রোন প্রস্তুতকারক জার্মানির কোয়ান্টাম সিস্টেমস। কোয়ান্টাম সিস্টেমসের ভেক্টর ড্রোনটি তুলনামূলক ব্যয়বহুল হলেও, সামরিক কমান্ডারদের কাছে এটি ভালো প্রশংসা পেয়েছে। কোম্পানির ইউক্রেন অফিসের প্রধান ওলেক্সান্দর বেরেজনি বলেন, "যুদ্ধক্ষেত্রের পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির গতির সঙ্গে তাল মেলাতে স্থানীয়ভাবে কাজ করা আমাদের সচেতন সিদ্ধান্ত ছিল।"
তবে ইউক্রেনের এই উদ্ভাবন এখনো আন্তর্জাতিক অর্থ প্রবাহের কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেনি। ন্যাটো দেশগুলো প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির ৫% পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে, যার ৩.৫% সরাসরি সামরিক খাতে যাবে। কিন্তু বেশিরভাগ বিনিয়োগই এখনো এমন ইউরোপীয় প্রযুক্তিতে যাচ্ছে যা রাশিয়ার যুদ্ধ বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না। এদিকে ইউক্রেনের অনেক পরীক্ষিত কোম্পানি অর্থাভাবের কারণে নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে — তাদের প্রায় ৪০% ড্রোন উৎপাদন ক্ষমতা অলস পড়ে আছে। সম্প্রতি ইউক্রেনের লাভিভে অনুষ্ঠিত ব্রেভ-১ ইভেন্টে ইউক্রেনীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ১০০ মিলিয়ন ডলার নতুন বিনিয়োগ তুলতে সক্ষম হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে চারগুণ বেশি হলেও, বৈশ্বিক তুলনায় অতি ক্ষুদ্র। ব্রেভ-১ হলো দ্বৈত ব্যবহারযোগ্য (সামরিক-বেসামরিক) প্রযুক্তিখাতে বিনিয়োগের সম্মেলন।
অবশ্য ইউক্রেনে বিনিয়োগ করাও ঝুঁকিমুক্ত নয়। দেশটির মেধাস্বত্ব সুরক্ষা দুর্বল, আইনশৃঙ্খলা অস্থির, আর যুদ্ধকালীন অস্ত্র রপ্তানিতে কড়া নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে বেসামরিক প্রযুক্তিকে সামরিক ব্যবহারের জন্য রূপান্তর করছে, ফলে অনেক উদ্ভাবন সহজেই নকলযোগ্য। তবুও বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিমা দেশ ও প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর উচিত ইউক্রেনের ড্রোন উৎপাদনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে শেখা।
আবার অনেকে ধারণা করছেন, পশ্চিমা কোম্পানিগুলো তাদের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি এখনো ইউক্রেনে পাঠাচ্ছে না — কিন্তু সুইচব্লেড-৩০০ এর ব্যর্থতা দেখিয়ে দিয়েছে, প্রযুক্তির 'মেয়াদ' সীমিত। নতুন সুইচব্লেড সংস্করণ রাশিয়ার সীমিত জ্যামিংয়ের মধ্যে কিছুটা সাফল্য দেখালেও, ইউক্রেনের যুদ্ধ প্রমাণ করেছে— এখন "সস্তা ও ব্যাপক" উৎপাদননির্ভর প্রযুক্তিই ভবিষ্যতের যুদ্ধের মুখ্য উপাদান হতে যাচ্ছে।
"এই পৃথিবীতে কেউ জানে না আগামীকাল কী ধরনের হুমকি আসবে — কোনো বিশ্লেষক না, কোনো জেনারেলও না," বলেন বোরোভিক। "আমার পরামর্শ, যদি আপনি আজ ইউক্রেনের যুদ্ধের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত না থাকেন, তবে আগামীকাল (প্রতিরক্ষায়) দেউলিয়াত্বের পথে হাঁটছেন।"
