ইউক্রেন ইস্যুতে রুশ তেল কোম্পানির ওপর ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞার পরও অনড় পুতিন
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বৃহস্পতিবার জানালেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তিনি তার অবস্থান থেকে সরে আসছেন না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটাতে রাশিয়ার দুই বৃহত্তম তেল কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন, যার ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ৫ শতাংশ বেড়ে গেছে।
চীনের রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানিগুলো সাময়িকভাবে রুশ তেল কেনা স্থগিত করেছে বলে বাণিজ্যিক সূত্রগুলো বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছে। ভারতের তেল শোধানারগুলো রুশ তেলের আমদানি ব্যাপকভাবে কমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে শিল্পসূত্র জানিয়েছে।
রাশিয়ার সবচেয়ে বড় দুটি তেল কোম্পানি রোসনেফট ও লুকওয়েলের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, 'প্রতিবার ভ্লাদিমিরের (পুতিন) সঙ্গে কথা হয়, ভালোভাবেই আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু পরে আর সেগুলোর কোনো অগ্রগতি হয় না।'
রাশিয়ার এই দুটি তেল কোম্পানি প্রতিদিন প্রায় ৩১ লাখ ব্যারেল তেল রপ্তানি করে। যুক্তরাজ্য সরকারের হিসাব অনুযায়ী, এর মধ্যে রোসনেফট একাই রাশিয়ার মোট তেল উৎপাদনের প্রায় অর্ধেকের সাথে যুক্ত, যা বিশ্ব তেল উৎপাদনের প্রায় ৬ শতাংশ।
ট্রাম্প ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুত্তের সঙ্গে বৈঠকের পর এ কথা বলেন। বৈঠকে ইউক্রেন সংকট ও শান্তি আলোচনার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়। এর এক দিন আগে ট্রাম্প জানান, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে নির্ধারিত বুদাপেস্ট বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।
স্বল্পমেয়াদে রাশিয়ার আর্থিক ক্ষতি সীমিত থাকতে পারে, তবে এই পদক্ষেপ ট্রাম্পের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করেছে— রুশ অর্থনীতি চাপে ফেলে ক্রেমলিনকে শান্তিচুক্তিতে বাধ্য করা।
পুতিন নিষেধাজ্ঞাকে 'বিরূপ আচরণ' আখ্যা দিয়ে বলেন, এটি রুশ অর্থনীতিকে তেমন প্রভাবিত করবে না। তিনি বিশ্ববাজারে রাশিয়ার গুরুত্ব তুলে ধরে সতর্ক করেন, সরবরাহে হঠাৎ ঘাটতি তৈরি হলে দাম আরও বেড়ে যাবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোর জন্যও 'অস্বস্তিকর' হবে।
পুতিন বলেন, 'এটি নিঃসন্দেহে রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা। কিন্তু কোনো আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন দেশ বা জনগণ কখনো চাপের মুখে সিদ্ধান্ত নেয় না।'
পুতিনের মন্তব্য নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, 'ভালোই তো, যদি তিনি এভাবে ভাবেন। ছয় মাস পর দেখবেন কেমন যায়।'
ইউক্রেন যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্রদের কাছে দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র চাইছে, পুতিন সতর্ক করেন— রুশ ভূখণ্ডের গভীরে হামলা হলে মস্কোর প্রতিক্রিয়া হবে 'খুবই গুরুতর, এমনকি ধ্বংসাত্মক।'
ট্রাম্পের অবস্থান পরিবর্তন
সংঘাত নিয়ে নিজের অবস্থানে নতুন মোড় নিয়ে ট্রাম্প বুধবার জানান, পুতিনের সঙ্গে পরিকল্পিত বৈঠকটি বাতিল করা হয়েছে। কারণ, তা কাঙ্ক্ষিত ফল আনবে না। তিনি অভিযোগ করেন, পুতিনের সঙ্গে বহু 'ভালো আলোচনা' হলেও তাতে 'কোনো অগ্রগতি হয়নি'।
হোয়াইট হাউসে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেন, 'আমরা বৈঠক বাতিল করেছি— আমার কাছে ঠিক মনে হয়নি। মনে হয়নি আমরা যেখানে যেতে চাই, সেখানে পৌঁছাতে পারব। তাই বাতিল করেছি, তবে ভবিষ্যতে করব।'
পুতিন বলেন, ট্রাম্প সম্ভবত বোঝাতে চেয়েছেন বৈঠক স্থগিত করা হয়েছে। দুই নেতা সর্বশেষ আগস্টে আলাস্কায় সাক্ষাৎ করেছিলেন।
রাশিয়া জানিয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার বিষয়ে তাদের শর্ত অপরিবর্তিত আছে— যা কিয়েভ ও ইউরোপের অনেক দেশ আত্মসমর্পণের সমান বলে মনে করে।
সংঘাতের মধ্যেই বৃহস্পতিবার ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নেতারা ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বৈঠক করেন ইউক্রেনের অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা করতে।
ইইউ নেতারা আগামী দুই বছরের জন্য ইউক্রেনের জরুরি আর্থিক চাহিদা পূরণের বিষয়ে একমত হয়েছেন। তবে জব্দ করা রুশ সম্পদ ব্যবহার করে বড় ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব বেলজিয়ামের আপত্তির কারণে অনুমোদন পায়নি।
মস্কো হুঁশিয়ারি দিয়েছে, সম্পদ জব্দ করা হলে তারা 'কঠোর জবাব' দেবে।
মস্কোর ওপর আরও চাপ চান জেলেনস্কি
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি নতুন নিষেধাজ্ঞাকে 'খুবই গুরুত্বপূর্ণ' আখ্যা দিয়ে বলেন, যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে রাশিয়ার ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
গত আগস্টে পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প ইউক্রেনের তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির দাবি থেকে সরে এসে মস্কোর পছন্দের বিকল্প— সমগ্র শান্তি আলোচনায় যাওয়ার প্রস্তাবকে সমর্থন করেছিলেন।
তবে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ট্রাম্প আবার তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। এটি কিয়েভের সমর্থিত হলেও মস্কো একে বারবার প্রত্যাখ্যান করেছে, কারণ রুশ বাহিনী বর্তমানে যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করছে।
রাশিয়ার দাবি, যুদ্ধবিরতি কেবল সাময়িক বিরতি সৃষ্টি করবে, যা ইউক্রেনকে পুনরায় অস্ত্র বাড়ানোর সুযোগ দেবে।
অন্যদিকে বৃহস্পতিবার লিথুয়ানিয়া জানিয়েছে, দুই রুশ যুদ্ধবিমান সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তাদের আকাশসীমায় প্রবেশ করেছে। এতে ন্যাটো বাহিনী সাড়া দেয় এবং দেশটি আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানায়। তবে রাশিয়া ঘটনাটি অস্বীকার করেছে।
রুশ এলএনজির ওপর ইইউর নতুন নিষেধাজ্ঞা
রাশিয়ার আয়ের উৎস বন্ধ করতে ইইউ বৃহস্পতিবার রুশ তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি নিষিদ্ধ করে ১৯তম নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর আওতায় চীনা রিফাইনারি ও মধ্য এশীয় ব্যাংকসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
২০২২ সালে সংঘাত শুরুর পর থেকে ইইউ রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা প্রায় ৯০ শতাংশ কমিয়েছে। তবু এ বছরের প্রথম আট মাসে তারা ১১ বিলিয়ন ইউরোর বেশি রুশ জ্বালানি আমদানি করেছে, যার মধ্যে এলএনজিই এখন সবচেয়ে বড় অংশ।
রাশিয়ার তেল ও গ্যাস থেকে পাওয়া রাজস্ব, যা বছরে ২১ শতাংশ কমে গেছে, এখনো দেশটির মোট বাজেটের এক-চতুর্থাংশ জোগায়। যুদ্ধের এই চতুর্থ বছরে সেটিই মস্কোর প্রধান অর্থের উৎস।
তবে রুশ সরকার মূলত উৎপাদনের ওপর কর আদায় করে, রপ্তানির ওপর নয়— যা এই নিষেধাজ্ঞার তাৎক্ষণিক আর্থিক প্রভাব কিছুটা হ্রাস করতে পারে।
