টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র পাবে না ইউক্রেন, জেলেনস্কিকে শান্তি চুক্তিতে আসার চাপ ট্রাম্পের

রাশিয়ার সঙ্গে চলমান যুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন অস্ত্র সহায়তা চাওয়ার উদ্দেশ্যে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি শুক্রবার হোয়াইট হাউসে যান। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেনের অস্ত্রভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার চেয়ে শান্তি চুক্তির ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিলেন।
জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ-পাল্লার টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র চাইলেও ট্রাম্প এ বিষয়ে নিরুৎসাহিত মনোভাব দেখান। তিনি শিগগিরই হাঙ্গেরিতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
দুই ঘণ্টার বেশি সময় ধরে বৈঠকের পর ট্রাম্প বলেন, ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়কেই এখনই যুদ্ধ থামাতে হবে— প্রয়োজনে ইউক্রেনকে কিছু এলাকা ছেড়েও দিতে হতে পারে।
ফ্লোরিডার ওয়েস্ট পাম বিচে ফেরার পথে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, "যুদ্ধক্ষেত্রে যেখানে লড়াই থেমেছে, সেখানেই থেমে যাক যুদ্ধ। দুই পক্ষই বাড়ি ফিরে যাক, পরিবারের কাছে। হত্যা বন্ধ হোক— এখনই।"
পুতিনের সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগের এই উদ্যোগে জেলেনস্কি ও কিছু ইউরোপীয় মিত্র বিরক্ত হলেও, ট্রাম্প নিজেকে যুদ্ধের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দেখাতে চাইছেন।
সাংবাদিকদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলাপের পর দুই নেতা একান্ত বৈঠকে বসেন। সেখানে আগের দিন ট্রাম্প ও পুতিনের ফোনালাপ নিয়েও আলোচনা হয়। ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি দুই দেশের মধ্যে শান্তির মধ্যস্থতা করতে চান— যদিও রাশিয়া ২০২২ সালে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালিয়েছিল।
'একটু সমঝোতা করতে হবে'
ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, "আমার মনে হয় প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি যুদ্ধ থামাতে চান, আর প্রেসিডেন্ট পুতিনও চান। এখন তাদের শুধু একটু সমঝোতা করতে হবে।"
তবে ভলোদিমির জেলেনস্কি জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতি অর্জন করা মোটেও সহজ নয়। তিনি বলেন, "আমরাও এটা চাই, কিন্তু পুতিন চান না।"
জেলেনস্কি সরাসরি ট্রাম্পকে জানান, ইউক্রেনের কাছে হাজার হাজার ড্রোন আছে রুশ লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণের জন্য, তবে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র দরকার। তিনি বলেন, "আমাদের টমাহক নেই, তাই টমাহক প্রয়োজন।"
এতে ট্রাম্প জবাব দেন, "আমরা বরং চাই, তাদের যেন টমাহকের প্রয়োজনই না পড়ে।" পরে তিনি আবার বলেন, "আমরাও টমাহক চাই। আমাদের নিজেদের দেশ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র আমরা দিতে চাই না।"
বৈঠকের পর জেলেনস্কি একে "ফলপ্রসূ" বলে উল্লেখ করেন। তবে জানান, তিনি আর দীর্ঘ-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের বিষয়ে কথা বলতে চান না। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্র এখন যুদ্ধ আরও বাড়াতে চায় না এবং তিনি নিজেও এ বিষয়ে বাস্তববাদী।
বৈঠকের পর ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন জেলেনস্কি। তিনি বলেন, যুদ্ধ থামাতে পুতিনের ওপর চাপ দিতে এখন তিনি ট্রাম্পের দিকেই তাকিয়ে আছেন।
ট্রাম্পের মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জেলেনস্কি বলেন, "প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঠিক বলেছেন। আমাদের এখন যেখানে আছি, সেখানেই থামতে হবে। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ— এখন থামতে হবে, তারপর কথা বলতে হবে।"
আবার আলোচনায় ফিরছেন ট্রাম্প–পুতিন
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ট্রাম্পকে কী বলেছিলেন, যার পর তিনি আসন্ন বৈঠকে সম্মত হন— তা স্পষ্ট নয়। আগস্টে আলাস্কায় তাদের আগের বৈঠক কোনো বড় অগ্রগতি ছাড়া আগেভাগেই শেষ হয়।
ক্রেমলিন জানিয়েছে, বৈঠকের আগে এখনো অনেক বিষয় নির্ধারণ বাকি আছে এবং এটি ট্রাম্পের উল্লেখ করা দুই সপ্তাহের সময়সীমার চেয়ে "কিছুটা পরে" হতে পারে।
পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপের পর ট্রাম্পের নমনীয় মনোভাব ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সহায়তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি করেছে। ইউরোপে আবারও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, হয়তো এমন একটি চুক্তি হবে যা রাশিয়ার জন্য সুবিধাজনক।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এক বিবৃতিতে জানায়, যদি আলোচনার মাধ্যমে ইউক্রেনে শান্তি আসে, তারা তা স্বাগত জানাবে।
শুক্রবার ট্রাম্পকে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেন, পুতিন কি সময়ক্ষেপণ করার জন্য তাকে নিয়ে "খেলছেন কি-না"? ট্রাম্প জবাব দেন, "আমার জীবনে আমার সাথে অনেকেই খেলতে চেয়েছে, সেরা খেলোয়াড়েরাও। কিন্তু আমি সব সময় ভালোভাবে বেরিয়ে এসেছি। তাই এটা সম্ভব।"
সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা ও বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো মাইকেল কার্পেন্টার বলেন, এই বৈঠক জেলেনস্কির কাছে প্রত্যাশিত ছিল না। তবে এটি ট্রাম্প প্রশাসনের যুদ্ধনীতি অনুযায়ীই হয়েছে।
তিনি বলেন, "বাস্তবতা হলো, রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করার কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।"
বৈঠকে ট্রাম্প জেলেনস্কির প্রশংসাও করেন। তিনি বলেন, "আজ প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি খুব স্টাইলিশ কালো জ্যাকেট পরে এসেছেন। এই বছর শুরুর দিকে যখন তিনি জ্যাকেট ছাড়া হোয়াইট হাউসে এসেছিলেন, তখন সমালোচিত হয়েছিলেন। আজ তাকে দারুণ লাগছে। আশা করি সবাই খেয়াল করেছেন।"
যুদ্ধ আরও তীব্র হয়েছে
নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য প্রচারণা চালানো ট্রাম্প নিজেকে একাধিক সংঘাতের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন।
ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার রুশ আগ্রাসনের সাড়ে তিন বছর পরও যুদ্ধ অব্যাহত। এ বছর কিছু জায়গায় রাশিয়া দখল বাড়ালেও ইউক্রেনের সেনাপ্রধান ওলেক্সান্দর সিরস্কি বৃহস্পতিবার বলেছেন, রুশ আক্রমণ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে।
পুতিন এ মাসে দাবি করেছেন, ২০২৫ সালে রুশ বাহিনী ইউক্রেনে প্রায় ৫,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করেছে— যা ইউক্রেনের মোট ভূখণ্ডের আরও ১ শতাংশ এবং সেটি ইতোমধ্যেই পূর্বে দখলকৃত ২০ শতাংশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
দুই পক্ষই একে অপরের জ্বালানি স্থাপনায় হামলা বাড়িয়েছে। এ ছাড়া রুশ ড্রোন ও যুদ্ধবিমান সম্প্রতি কয়েকবার ন্যাটো দেশগুলোর সীমান্তে ঢুকে পড়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে আলোচনাটি সময়ক্ষেপণের কৌশল
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে হোয়াইট হাউস রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রতি ক্রমেই বিরক্তি প্রকাশ করছিল এবং ইউক্রেনকে নতুন সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে ভাবছিল, যার মধ্যে ছিল টমাহক ক্ষেপণাস্ত্রও। ইউক্রেন মনে করে, এসব ক্ষেপণাস্ত্র রুশ যুদ্ধযন্ত্রের বড় ক্ষতি করতে পারে।
শুক্রবারের বৈঠকের পর প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেন, রাশিয়া টমাহক ক্ষেপণাস্ত্রকে ভয় পায়। অন্যদিকে মস্কো সতর্ক করেছে, এসব অস্ত্র সরবরাহ বড় ধরনের উত্তেজনা তৈরি করবে।
কৌশলগত বিশ্লেষক ম্যাক্স বার্গম্যান বলেন, পুতিনের এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য যুক্তরাষ্ট্রকে ওই অস্ত্র সরবরাহ থেকে বিরত রাখা।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা সহায়তাকারী সংস্থা 'কাম ব্যাক অ্যালাইভ'-এর সিনিয়র বিশ্লেষক মিকোলা বিলিয়েস্কভ বলেন, টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনকে রাশিয়ার সমান শক্তিতে পৌঁছাতে সহায়তা করবে।
তিনি বলেন, 'এক-দুইবার হামলায় রাশিয়া ভেঙে পড়বে, তা আমরা ভাবি না। কিন্তু ধারাবাহিক চাপই আসল বিষয়— যা তাদের সামরিক শিল্পব্যবস্থায় বড় ধাক্কা দেবে।'