বিরল খনিজ, কূটনৈতিক কৌশল ও প্রশংসা—ট্রাম্প ২.০ যুগে পাকিস্তানের কৌশলী সাফল্য

গত সোমবার গাজা যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর বিশ্বনেতাদের সামনে বিজয়োচ্ছ্বাসে ভাসছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই মঞ্চেই তিনি পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে অভিহিত করলেন তার "প্রিয় ফিল্ড মার্শাল" হিসেবে।
এরপর তিনি নিজেই মঞ্চ ছেড়ে দিলেন পাকিস্তানের বেসামরিক নেতা প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফকে, যাতে তিনি গণমাধ্যমের সামনে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধবিরতি আনতে ভূমিকার প্রশংসা করেন। শেহবাজ সেদিনই ঘোষণা দিলেন—তিনি আবারও ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করতে চান।
অথচ মাত্র এক বছর আগেও এমন দৃশ্য ছিল অকল্পনীয়।
দীর্ঘদিন ধরে ওয়াশিংটন পাকিস্তানকে দূরে রেখেছিল—রাজনৈতিক অস্থিরতা, ইসলামী উগ্রপন্থী সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতাধীন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি নরম অবস্থানের কারণে। তার ওপর, পাকিস্তান যে চীনের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র, সেটাও সম্পর্ক ঠাণ্ডা রাখার বড় কারণ ছিল।
ট্রাম্পের পূর্বসূরি জো বাইডেন এর মেয়াদকালে দুইজন হন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, যাদের কাউকে ফোন করারঅ প্রয়োজন মনে করেননি তিনি। ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিশৃঙ্খল সেনা প্রত্যাহারের পর বাইডেন পাকিস্তানকে "বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর একটি" বলে অভিহিত করেন, যা ইসলামাবাদকে ক্ষুব্ধ করে।
কিন্তু ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদে এসে, আমেরিকান কূটনীতির মানচিত্রটাই বদলে ফেলেছেন—পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে শীতল সম্পর্ক রেখে প্রতিপক্ষকে আলিঙ্গনে টেনে নিচ্ছেন, যদি তারা কিছু দিতে পারে এই আশায়।
আর এখনও পর্যন্ত, পাকিস্তান দেখিয়ে দিয়েছে—কীভাবে এই খেলার নিয়মে জয়ী হতে হয়।
দেশটির নেতারা নিয়মিত হোয়াইট হাউসের অতিথি হচ্ছেন, এবং অন্য অনেক রাষ্ট্রপ্রধানের মতো কড়া সমালোচনার মুখে পড়েননি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এখন যুক্তরাষ্ট্রের রেথিয়ন নির্মিত মিসাইলের নতুন চালান পাওয়ার অপেক্ষায়, আর দেশটির কূটনীতিকরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমন বাণিজ্য চুক্তি করেছেন—যেখানে চিরশত্রু ভারতের তুলনায় অনেক কম শুল্ক হার রয়েছে।
পাকিস্তান এই সাফল্য পেয়েছে, চীনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা বিরল খনিজে যুক্তরাষ্ট্রকে অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং ট্রাম্পের প্রতি কৌশলী প্রশংসার মাধ্যমে।
পাকিস্তানের ভেতরে সরকারের এই কূটনৈতিক চাতুর্য প্রশংসা কুড়িয়েছে। তবে এতে ক্ষুব্ধ ভারত—যারা এখনো রাশিয়ার সস্তা তেল কিনছে এবং ট্রাম্প প্রশাসনের উচ্চ শুল্ক আরোপও নাখোশ দিল্লি।

ফিল্ড মার্শালের ভূমিকা
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নয়া এই উষ্ণ সম্পর্কের কেন্দ্রে রয়েছেন, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এমন এক প্রতিষ্ঠান, যার প্রভাব দেশটির রাজনীতিতে ঐতিহাসিকভাবে গভীর। এবং, কার্যত মুনিরই হলেন সর্বেসর্বা।
স্কুলশিক্ষকের সন্তান ৫৭ বছর বয়সী মুনির ২০২২ সালে সেনাপ্রধান হওয়ার আগে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই–এর প্রধান ছিলেন। তার ঘনিষ্ঠ মহলের মতে, তিনি এক রহস্যময় ব্যক্তি—যিনি জনসমক্ষে নিজের ভাবমূর্তি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন।
কিন্তু গত মে মাসে পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে চার দিনের রক্তক্ষয়ী সংঘাত তার নাম আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। সীমিত ওই যুদ্ধে উভয়পক্ষের ডজন ডজন সেনা ও বেসামরিক মানুষ নিহত হয়, আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আশঙ্কা করে—এটি হয়তো পারমাণবিক যুদ্ধের দিকেও গড়াতে পারে।
ঠিক তখনই ডোনাল্ড ট্রাম্প হস্তক্ষেপ করেন—উভয় দেশকে যুদ্ধ থামাতে আহ্বান জানান। যুদ্ধ থামলে তিনি নিজেই এর কৃতিত্ব নেন, যে দাবিকে পাকিস্তান প্রকাশ্যে সমর্থন করে। এরপর পাকিস্তান ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে—তার দ্বিতীয় মেয়াদকালে এমন পদক্ষেপ নেওয়া প্রথম দেশ হিসেবে।
অন্যদিকে ভারত কঠোর ভাষায় অস্বীকার করে ট্রাম্পের কোনো ভূমিকা, জানিয়ে দেয়—যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত ছিল সম্পূর্ণভাবে ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক ব্যাপার।
পাকিস্তান দাবি করেছে, মে মাসের সংঘাতে তারা ভারতের সাতটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে— এই সংখ্যা ট্রাম্প নিজেও একাধিকবার প্রকাশ্যে উল্লেখ করেন। তবে ভারত কখনোই তা স্বীকার করেনি।
কয়েক দিন পর মুনির—যিনি এ সংকট মোকাবিলায় বলিষ্ঠ ভূমিকার জন্য ফিল্ড মার্শাল উপাধিতে ভূষিত হন—ওয়াশিংটনে যান এবং হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে যোগ দেন। পাকিস্তানের কোনো সেনাপ্রধানের মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এমন একান্ত সাক্ষাৎ এই প্রথম।
ওয়াশিংটনভিত্তিক লেখক ও বিশ্লেষক সুজা নওয়াজ সিএনএনকে বলেন, "ট্রাম্প বিজয়ীদের পছন্দ করেন, পরাজিতদের না। তিনি ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের মধ্যে এমন একজন সিদ্ধান্তগ্রহণকারী নেতাকে দেখেছেন, যার সঙ্গে তার দৃষ্টিভঙ্গি মিলে গেছে—বিশেষ করে যুদ্ধবিরতি প্রসঙ্গে।"

খনিজের উপহার
গাজার যুদ্ধবিরতি নিয়ে ট্রাম্পের বক্তব্যে পাকিস্তানের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, "বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের অবস্থান লাভজনক—কারণ তার ভৌগোলিক নিকটতা এবং উপসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।"
তিনি যোগ করেন, পাকিস্তানের ইরানের সঙ্গে "যথেষ্ট মসৃণ সম্পর্ক" রয়েছে, যা ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে ইসলামাবাদকে একটি আদর্শ মাধ্যম করে তুলেছে—ওয়াশিংটন থেকে তেহরানে বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য।
এটা নতুন কিছু নয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানই হেনরি কিসিঞ্জারের গোপন ইসলামাবাদ–বেইজিং সফর আয়োজন করেছিল, যা পরে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথ খুলে দেয়।
কিন্তু আজকের পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক হাতিয়ার হলো চীনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা বিরল খনিজে প্রবেশাধিকার। এই ১৭ ধরনের ধাতু–খনিজই আধুনিক প্রযুক্তি, আইফোন থেকে শুরু করে এমআরআই মেশিন, এমনকি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান তৈরিতে অপরিহার্য।
চীন এই খনিজ প্রক্রিয়াকরণে প্রায় একচেটিয়া দখল রাখে এবং বাণিজ্য ও প্রযুক্তি যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ প্রয়োগে তা ব্যবহার করে আসছে।
এ কারণেই প্রায় ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের অনাবিষ্কৃত খনিজ সম্পদ থাকা পাকিস্তান এখন নিজেকে "ক্রিটিক্যাল মিনারেল হাব" হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় ট্রাম্পের নজর কেড়েছে।
গত সেপ্টেম্বরের এক বৈঠকে হোয়াইট হাউস প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, ফিল্ড মার্শাল মুনির প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে পাকিস্তানের খনিজ সম্পদের নমুনাসজ্জিত একটি কাঠের বাক্স উপহার দিচ্ছেন।
একই মাসে মার্কিন কোম্পানি ইউএস স্ট্র্যাটেজিক মেটালস ঘোষণা করে—তারা পাকিস্তান থেকে "বিরল খনিজ ও ক্রিটিক্যাল মিনারেলস"-এর প্রথম চালান পেয়েছে। ৫০০ মিলিয়ন ডলারের অংশীদারত্ব চুক্তির আওতায়, এই চালানে ছিল অ্যান্টিমনি, কপার কনসেনট্রেট, নিওডিমিয়াম ও প্রাসিওডিমিয়াম সমৃদ্ধ বিরল ধাতু।
বলা হয়, পাকিস্তানের বেশিরভাগ বিরল খনিজের মজুদই রয়েছে বেলুচিস্তান প্রদেশে, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে।
গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ)–কে আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। পাকিস্তান দীর্ঘকাল ধরে অভিযোগ করে আসছে যে, ভারতের অর্থায়ন ও গোয়েন্দা সহায়তায় পরিচালিত হয় বিএলএ।
পরের মাসেই যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের কাছে রেথিয়নের তৈরি অ্যামর্যাম শ্রেণির মধ্য-পাল্লার এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল বিক্রির অনুমোদন দেওয়ার ঘোষণা করে।
"কারণ পাকিস্তান তার প্রশংসা করে"
পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের এই ঘনিষ্ঠতায় অনেকেই আবারও উদ্বিগ্ন—বিশেষত দেশটির সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক প্রভাব পুনরায় বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায়।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর দেশটি চারবার সেনাশাসনের অধীনে গেছে এবং তিনটি সামরিক অভ্যুত্থান দেখেছে। এমনকী ১৯৭৩ সালের সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর থেকে কোনো প্রধানমন্ত্রীই পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেননি।
সমালোচকদের মতে, মুনির সেনাবাহিনীর ওপর আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং সরকার ও বিচার বিভাগের ওপর যথেষ্ট প্রভাবও তাঁর রয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তান রাষ্ট্র এখনো "মানবাধিকারকর্মী ও বিরোধী দলের নেতাদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে, বিশেষত সেনাবাহিনীর সমালোচনার কারণে।"
ইউএস স্ট্র্যাটেজিক মেটালসের সঙ্গে স্বাক্ষরিত যে অংশীদারিত্ব চুক্তি, তার পাকিস্তানি অংশীদার 'ফ্রন্টিয়ার ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন (এফডব্লিউও) হচ্ছে একটি সেনা পরিচালিত প্রতিষ্ঠান। ফলে প্রকল্পটি সফল হলে লাভ ও প্রভাবের একটি বড় অংশ সেনাবাহিনীর হাতেই থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সিএনএনকে বলেন, "আমাদের দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্ব যৌথ স্বার্থের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে—যার মধ্যে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা অন্তর্ভুক্ত।"
তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই উষ্ণতারও সীমা আছে।
যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুসেইন হাক্কানি বলেন, সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সম্পূর্ণভাবে ট্রাম্পের মেজাজের ওপর। "ট্রাম্পের শাসনধারা প্রচলিত নয়," বলেন হাক্কানি, যিনি বর্তমানে ওয়াশিংটন ডিসির হাডসন ইনস্টিটিউট ও আনোয়ার গারগাশ ডিপ্লোম্যাটিক একাডেমির ফেলো।
হাক্কানির মতে, "তিনি (ট্রাম্প) এখন পাকিস্তানকে পছন্দ করেন, কারণ পাকিস্তান তাকে ভালোবাসা দেখিয়েছে—প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছে, এমনকি নোবেল পুরস্কারের মনোনয়নও দিয়েছে।"