সিলেটের বন থেকে যে সুগন্ধি পৌঁছায় ফরাসি ব্র্যান্ড ক্রিডের অভিজাত বিপণিতে

কিছু গল্প শুধু ঘ্রাণে ভাসে। প্যারিসের ঝলমলে কোনো বিপণি থেকে ভেসে আসা অভিজাত এক সুবাসের উৎস খুঁজতে গেলে হয়তো অবাকই হতে হবে। কারণ, সে গল্পের শেকড় লুকিয়ে আছে আমাদের সিলেটের গহিন অরণ্যে।
ফরাসি সুগন্ধি নির্মাতা 'হাউস অব ক্রিড'-এর বিখ্যাত 'উদ জারিয়ান' (Oud Zarian) সেই গল্পই বলে, যার শুরুটা প্যারিস বা লন্ডনে নয়, সিলেটের মাটিতে।
প্রায় চার শতাব্দী ধরে সিলেটের জালালী পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আগর গাছের যত্ন নিয়ে আসছেন। এই গাছের বুকে সুগন্ধি তৈরির রহস্য লুকিয়ে আছে প্রকৃতির এক অদ্ভুত খেয়ালে। এক বিশেষ ছত্রাকের আক্রমণ থেকে নিজেকে বাঁচাতে গাছটি নিঃসরণ করে একধরনের গাঢ়, সুগন্ধি রজন।
গাছের এই সংগ্রাম আর বেঁচে থাকার আর্তি থেকেই জন্ম নেয় আগর কাঠ—বিশ্বের সবচেয়ে দুর্লভ আর মূল্যবান সুগন্ধির উৎস, যা কখনও কখনও সোনার চেয়েও দামি।
জালালী পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা সহজ ছিল না। প্রচারবিমুখ এই পরিবার তাদের কাজ নিয়ে জনসমক্ষে কথা বলতে স্বচ্ছন্দ নন। জালালী পরিবারের এই ব্যবসার বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'আমরা কখনো প্রচার বা হইচই চাইনি। এটা আমাদের স্বভাববিরুদ্ধ। শত শত বছরের পুরোনো এই পারিবারিক শিল্পকে আমরা সেই আদি ঐতিহ্যেই বাঁচিয়ে রেখেছি।'
তাদের এই শিল্পের প্রধান উপাদান হলো সময়।
একটি আগর গাছকে পরিপূর্ণ হতে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ বছর সময় দেওয়া হয়। এরপর পরিপক্ক প্রতিটি গাছকে পরম যত্নে কেটে, ভিজিয়ে রেখে ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে পরিশোধন করা হয়। সুগন্ধি নির্মাতারা একে 'কালো সোনা' নামে ডাকেন।
এই প্রক্রিয়ায় তাড়াহুড়ো সুগন্ধের শত্রু। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর যে তেল মেলে, তার এক ফোঁটাই বদলে দিতে পারে ঘরের আবহ।
বিশ্বজুড়ে জালালী পরিবারের আগর কাঠ এখন ক্রিডের 'উদ জারিয়ান'-এর সঙ্গে পরিচিত হলেও তাদের কাজ শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। ডিওর, লুই ভিতোঁর মতো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গেও তাদের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমরা যেখানেই যাই, নিশ্চিত করি যেন আমাদের শেকড়ের স্বীকৃতি থাকে। আমরা সব সময় আমাদের পূর্বপুরুষ এবং আমাদের বাড়ি, সিলেটের কথা উল্লেখ করি।'
ক্রিডের এই তেলের সন্ধান পাওয়া ছিল অনেকটা শতবর্ষী সংগ্রাহকের আরেক সংগ্রাহককে খুঁজে পাওয়ার মতো। ১৭৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত ফরাসি বিলাসবহুল সুগন্ধি প্রতিষ্ঠান ক্রিড বরাবরই ঐতিহ্যের ধারক। তারা আজও পুরোনো পদ্ধতিতে হাতে করে সুগন্ধি তৈরি করে, যেখানে এমন সব উপাদান ব্যবহৃত হয় যা অন্যরা অত্যন্ত দুর্লভ, সময়সাপেক্ষ বা ব্যয়বহুল বলে এড়িয়ে যায়।
ক্রিড তাদের 'উদ জারিয়ান' সুগন্ধিতে সিলেটের আগর কাঠ থেকে তৈরি 'উদ শোরোন' ব্যবহার করেছে। ক্রিডের ভাষ্যে, 'এটি ৮০ বছরের পুরোনো আগর দিয়ে তৈরি এক বিরল রত্ন।'
জালালি আগারউডের বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক স্পষ্ট করে বলেন, 'বিষয়টি এমন নয় যে তেলটি ৮০ বছরের পুরোনো। বরং যে গাছ থেকে তেলটি আহরণ করা হয়েছে, তার বয়স এবং পরিশোধন প্রক্রিয়াটি প্রায় ৮০ বছরের ঐতিহ্য বহন করে। সুগন্ধিতে ব্যবহারের জন্য তেলটি সতেজ অবস্থাতেই পরিশোধন করা হয়, যা এর শক্তি আর গভীরতা ধরে রাখে।'
আগর চাষ ও তেল তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে জানতে চাইলে তিনি সিলেটের দুই ধরনের চাষ পদ্ধতির কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, "কিছু গাছ সরকারি উদ্যোগে রোপণ করা হয়, আর কিছু থাকে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন গাছ কাটার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সনদপত্রের প্রয়োজন হয়, কারণ এই গাছ 'সাইটস' (CITES - Convention on International Trade in Endangered Species of Wild Fauna and Flora) অর্থাৎ বিপন্ন প্রজাতির গাছপালার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ সনদের অন্তর্ভুক্ত। যথাযথ পরিদর্শন ও ছাড়পত্র পাওয়ার পরই কেবল আমরা গাছ কাটার কাজ শুরু করতে পারি।'
তিনি বলেন, সিলেটে দুই ধরনের আগর চাষ হয়—একটি নিবিড় পরিচর্যায়, অন্যটি প্রাকৃতিক। নিবিড় পদ্ধতিতে ৩০-৩৫ বছর বয়সী গাছে পেরেক বিঁধিয়ে ক্ষত তৈরি করে রজন উৎপাদন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা হয়। কিন্তু প্রাকৃতিক পদ্ধতি অনেক ধীর ও ধৈর্য্যের। সেখানে প্রকৃতির নিয়মেই গাছ বেড়ে ওঠে, যাতে শত বছরও লেগে যেতে পারে। জালালী পরিবারের মতে, 'এটি অবিশ্বাস্যরকম দুর্লভ, কিন্তু এর সুবাস, গভীরতা এবং স্থায়িত্ব অতুলনীয়। উদ শোরোন এমনই এক প্রাকৃতিক উদ।'
প্রস্তুত হয়ে গেলে, সংক্রমিত কালো কাঠ থেকে বর্ণহীন, গন্ধহীন অংশগুলো হাতে আলাদা করা হয়। এরপর কালো কাঠ পানিতে ডুবিয়ে রেখে ঐতিহ্যবাহী চুল্লিতে ফোঁটায় ফোঁটায় তেল সংগ্রহ করা হয়। সেই তেল রোদে রেখে দেওয়া হয় পরিপক্ক হওয়ার জন্য।
তিনি যোগ করেন, 'আমাদের কিছু ফর্মুলেশন মোগল আমলের। আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে সম্রাট আকবরের সুগন্ধি তৈরির বিভাগের উল্লেখ ছিল। আমরা সেখান থেকেও কিছু কৌশল গ্রহণ করেছি।'
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের সুনাম ধরে রাখতে জালালী পরিবারকে আধুনিক পেশাদারত্বের ছাপও রাখতে হয়। শ্রমিকের অধিকার, ন্যায্য মজুরি এবং কাজের নিরাপদ পরিবেশ—ইউরোপীয় ব্র্যান্ডগুলোর নির্ধারিত সব নিরীক্ষা মান কঠোরভাবে মেনে চলা হয়।
'উদ জারিয়ান'-এর দামও তার আভিজাত্যের মতোই আকাশছোঁয়া। ক্রিডের ওয়েবসাইটে এর ৫০ মিলিলিটার বোতলের দাম ৩৫০ ইউরো এবং ১০০ মিলিলিটারের দাম ৪৯৫ ইউরো, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫২ হাজার ৫০০ টাকা।
'উদ জারিয়ান' তাই শুধু একটি সুগন্ধি নয়, এটি দুটি ভিন্ন প্রান্তের দুই শিল্পীর ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধার এক মেলবন্ধন। আজ কাচের দেয়ালে বন্দী হয়ে এই সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের অভিজাত বিপণিতে। আর সেই বোতলের সুবাসে মুগ্ধ মানুষগুলো হয়তো ঘুণাক্ষরেও টের পান না, যে মোহনীয় ঘ্রাণ তারা শরীরে মাখছেন, তার শেকড় প্রোথিত আমাদের সিলেটেরই মাটিতে।