যেভাবে ফাঁস হওয়া এক ফোন কলে পদচ্যুত থাই প্রধানমন্ত্রী, ক্ষমতা হারাল সিনাওয়াত্রা পরিবার

থাইল্যান্ডের সাংবিধানিক আদালত প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছেন। কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের সঙ্গে ফাঁস হওয়া একটি ফোনালাপে নৈতিক মানদণ্ড লঙ্ঘনের অভিযোগে শুক্রবার (২৯ আগস্ট) এ রায় দেন আদালত। সেই ফোনালাপ ফাঁস করেছিলেন হুন সেন নিজেই। খবর বিবিসি'র।
ফাঁস হওয়া ঐ কথোপকথনে শোনা যায়, সীমান্ত বিরোধ নিয়ে হুন সেনের সঙ্গে নরম সুরে কথা বলছেন পেতংতার্ন এবং নিজেদের এক সেনা কমান্ডারকে সমালোচনা করছেন।
আদালতে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পেতংতার্ন বলেন, 'হুন সেনের সঙ্গে তার আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল কূটনৈতিক অগ্রগতি ঘটানো।' তিনি আরও জানান, হুন সেন ছিলেন তার বাবা থাকসিন সিনাওয়াত্রার একজন পুরোনো বন্ধু এবং ব্যক্তিগত আলাপচারিতা গোপন থাকার কথা ছিল।
তবে ওই ফাঁস হওয়া আলাপ পেতংতার্ন এবং তার দল ফিউ থাইয়ের জন্য বড় ক্ষতি ডেকে আনে। বিরোধীরা তার পদত্যাগ দাবি করে এবং প্রধান জোটসঙ্গী সরকার থেকে সরে দাঁড়ায়, ফলে সরকার টিকে থাকে অতি দূর্বল সংখ্যাগরিষ্ঠতায়।
চলতি বছরের জুলাইয়ে আদালতের নয় বিচারকের মধ্যে সাতজন ভোট দিয়ে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছিলেন, যা থেকে বোঝা গিয়েছিল যে তিনি তার চার পূর্বসূরির মতো একই পরিণতির শিকার হবেন। তাই শুক্রবারের চূড়ান্ত রায়ে তার অপসারণ মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিল না।
পেতংতার্ন হলেন থাইল্যান্ডের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী, যাকে আদালত ক্ষমতাচ্যুত করল। সবাই ছিলেন তার বাবা থাকসিন সিনাওয়াত্রার ঘনিষ্ঠ মিত্র বা সমর্থিত সরকারপ্রধান। এর ফলে দেশটিতে ব্যাপক ধারণা তৈরি হয়েছে যে, আদালত প্রায় সব সময়ই রক্ষণশীল এবং রাজতান্ত্রিক শক্তির স্বার্থে রায় দেয়।
আদালত এ পর্যন্ত ১১২টি রাজনৈতিক দলও নিষিদ্ধ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ছোট দলগুলোর পাশাপাশি থাকসিনের ফিউ থাইয়ের দুটি আগের সংস্করণ এবং ২০২৩ সালের নির্বাচনে বিজয়ী সংস্কারপন্থী 'মুভ ফরোয়ার্ড' দল।
এইবার পেতংতার্নের পতন ঘটল হুন সেন ফাঁস করা এক ফোনালাপকে কেন্দ্র করে। কেন তিনি সিনাওয়াত্রা পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিন্ন করলেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে পেতংতার্ন কম্বোডিয়ার নেতৃত্বের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তাদের যুক্তি তুলে ধরার পদ্ধতিকে 'অপেশাদার' বলে মন্তব্য করেছিলেন, যার প্রতিক্রিয়ায় হুন সেন ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তিনি এটিকে 'অভূতপূর্ব অপমান' আখ্যা দিয়ে 'সত্য প্রকাশে' বাধ্য হয়েছিলেন বলে দাবি করেন।
কিন্তু তার এই পদক্ষেপ থাইল্যান্ডে রাজনৈতিক সংকট তৈরি করে এবং সীমান্ত উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে। এর জের ধরে গত মাসে থাইল্যান্ড-কাম্বোডিয়া সীমান্তে পাঁচ দিনের যুদ্ধে অন্তত ৪০ জন নিহত হন।
এখন সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের সীমিত তালিকা থেকে নতুন প্রধানমন্ত্রী বেছে নিতে হবে। গত নির্বাচনের আগে প্রতিটি দল তিনজন করে প্রার্থী মনোনীত করেছিল। এর মধ্যে ফিউ থাই ইতোমধ্যেই দুইজনকে হারিয়েছে—গত বছর ক্ষমতাচ্যুত স্রেত্থা থাভিসিন এবং এবার পেতংতার্ন। তৃতীয় প্রার্থী চাইকাসেম নিতিসিরি দলীয় প্রবীণ হলেও অসুস্থ এবং জনপরিসরে তার পরিচিতিও কম।
বিকল্প হিসেবে রয়েছেন ভুমজাইথাই দলের নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনুতিন চার্নভিরাকুল, যিনি ফাঁস হওয়া ফোনালাপের কারণেই ফিউ থাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। তবে সরকার গঠনে তাকেই আবার ফিউ থাইয়ের ওপর নির্ভর করতে হবে।
সংসদের বৃহত্তম শক্তি বর্তমানে ১৪৩ আসন নিয়ে নবগঠিত 'পিপলস পার্টি'। তারা ঘোষণা দিয়েছে, তারা কোনো জোটে যোগ দেবে না; নতুন নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত তারা বিরোধী দল হিসেবেই থাকবে।
যদিও নতুন নির্বাচনই বর্তমান সংকটের স্বাভাবিক সমাধান মনে হচ্ছে, ফিউ থাই তা চায় না। কারণ, দুই বছর ক্ষমতায় থেকেও তারা অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করার প্রতিশ্রুতি রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
অভিজ্ঞতাহীন পেতংতার্ন ক্ষমতায় থেকেও কোনো কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। অধিকাংশ থাই মনে করতেন, বড় সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তার বাবা থাকসিন।
কিন্তু থাকসিন সিনাওয়াত্রাও যেন তার 'যাদুকরী প্রভাব' হারিয়ে ফেলেছেন। নির্বাচনি প্রচারে ফিউ থাইয়ের মূল প্রতিশ্রুতি ছিল—প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে ১০ হাজার বাথের (৩৪৮ মার্কিন ডলার) ডিজিটাল ওয়ালেট দেওয়া। তা এখন স্থগিত হয়ে গেছে এবং ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে।
এছাড়া ক্যাসিনো চালু এবং ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরকে সংযোগকারী 'ল্যান্ড-ব্রিজ' প্রকল্পও আটকে আছে।
কাম্বোডিয়ার সঙ্গে সীমান্ত যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে হুন সেনের সঙ্গে সিনাওয়াত্রা পরিবারের দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক রক্ষণশীলদের মধ্যে সন্দেহ উসকে দিয়েছে যে তারা সবসময় জাতীয় স্বার্থের আগে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়।
এর ফলে ফিউ থাইয়ের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। এখনই নির্বাচন হলে তাদের ১৪০ আসনের অনেকটাই হারানোর সম্ভাবনা প্রবল।
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে থাইল্যান্ডের অপ্রতিরোধ্য নির্বাচনী শক্তি হিসেবে আধিপত্য বিস্তার করা ফিউ থাইয়ের সেই ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করা এখন প্রায় অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে।