গাঁজা বৈধকরণে নেতৃত্ব দেওয়া অনুতিন চার্নভিরাকুল থাইল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী

ভুমজাইথাই পার্টির নেতা ৫৮ বছর বয়সী অনুতিন চার্নভিরাকুলকে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করেছে থাইল্যান্ডের পার্লামেন্ট।
এর আগে গত জুনে কম্বোডিয়ার সাবেক নেতা হুন সেনের সঙ্গে ফাঁস হওয়া ফোনালাপের জেরে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রাকে বরখাস্ত করেন দেশটির সাংবিধানিক আদালত।
ফোনালাপ ফাঁসের পর ক্ষমতাসীন ফিউ থাই পার্টির জোট থেকে নিজের দল ভুমজাইথাই পার্টিকে সরিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। এরপর তিনি প্রধান বিরোধীদলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
দেশটির রাজনীতিতে অনুতিন চার্নভিরাকুলের পথচলা দীর্ঘদিনের। পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রার বাবা থাকসিন সিনাওয়াত্রার প্রতিষ্ঠিত 'থাই রাক থাই' পার্টিতে যোগ দেওয়ার মধ্যে দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়।
পরবর্তী সময়ে তিনি ভুমজাইথাই পার্টির নেতৃত্বে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কৃষিপ্রধান এলাকায় নিজের যোগাযোগ বাড়ান।
২০১৯ ও ২০২৩ সালে নির্বাচনে তাকে সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিবেচনা করা হলেও, বাস্তবে তা হয়নি। তবে অনুতিন দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে কোভিড ১৯ মোকাবিলায় বেশ দক্ষতা দেখান তিনি। তবে ২০২২ সালে থাইল্যান্ডে গাঁজা বৈধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার মধ্যদিয়ে তিনি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পান।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ থাইল্যান্ডে অনুতিনের প্রভাব ক্রমেই বেড়েছে। থাই রাজনীতিতে তুলনামূলক নতুন ভুমজাইথাই পার্টি দেশটির নিম্ন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কৃষি সম্প্রদায়ের মধ্যে জনপ্রিয়।
২০২৩ সালে রয়টার্সকে তিনি বলেন, 'আমি তরুণ, উদ্যমী এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার রাজনীতি বোঝার ক্ষমতা রাখি।'
এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রতি তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস কতটা প্রবল ছিল।
সর্বশেষ নির্বাচনে ভুমজাইথাই পার্টি ৫০০ আসনের মধ্যে মাত্র ৭০টি আসন জিতেছিল, কিন্তু তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া মুভ ফরোয়ার্ড পার্টিকে সরকার গঠনে বাধা দিয়ে ফিউ থাই পার্টির অংশীদার হিসেবে সরকার গঠন করে, যা দুই বছর টিকে ছিল।
সিঙ্গাপুরের আইএসইএএস-ইউসুফ ইসহাক ইনস্টিটিউটের থাইল্যান্ড স্টাডিজ প্রোগ্রামের ভিজিটিং ফেলো ও ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়ক নাপন জাতুস্রিপিতাক নাপন জাতুসরিপিতাক বলেন, অনুতিন ও তার দল প্রাদেশিক রাজনীতিতে ক্ষমতাধর পরিবারগুলোর সঙ্গে প্রভাবশালী রাজতান্ত্রিক-সংরক্ষণশীল গোষ্ঠীর মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি করেছে।
তিনি বলেন, 'অনুতিন খুবই বাস্তববাদী রাজনীতিক। তাকে থাকসিন সিনাওয়াত্রার ধারার রাজনীতিক বলা যায়।'
নাপন আরও বলেন, অনুতিন রাজতন্ত্রের প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং নিজের দলকে থাইল্যান্ডের সংরক্ষণশীল স্বার্থ রক্ষার অন্যতম নির্ভরযোগ্য ভিত্তিতে পরিণত করেছেন।
গত ২৫ বছরে থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে রাজতান্ত্রিক-সংরক্ষণশীল গোষ্ঠী ও থাকসিনপন্থী জনবান্ধব দলগুলোর মধ্যে অবিরাম সংঘর্ষ থাইল্যান্ডের রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে। এর ফলে সামরিক অভ্যুত্থান ও আদালতের রায়ের মাধ্যমে ছয়জন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণ করা হয়েছে।
ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক বাবার সন্তান অনুতিন ব্যাংককের একটি অল-বয়েজ প্রাইভেট স্কুলে পড়াশোনা করেন। পরে যুক্তরাষ্ট্রে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ১৯৯০ সালে তিনি তার বাবার প্রতিষ্ঠিত নির্মাণ প্রতিষ্ঠান সিনো-থাইয়ে যোগ দেন এবং পরে প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট হন।
২০০৪ সালে থাকসিন সরকারের সময় তিনি জনস্বাস্থ্য উপমন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। তবে ২০০৭ সালে 'থাই রাক থাই' পার্টি বিলুপ্ত হওয়ার পর তিনি পাঁচ বছরের জন্য রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ হন।
২০১২ সালে ভুমজাইথাই পার্টির নেতৃত্বে রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করেন।
এরপরের এক দশকে তিনি ভুমজাইথাই প্রতিষ্ঠাতা নিউইন চিদচবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং নিজের অভিজাত মহলে প্রভাব কাজে লাগিয়ে বারবার সরকারে অংশীদার হয়েছেন। ২০২৩ সাল থেকে তিনি ফিউ থাই সরকারের অধীনে দুটি মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
নাপন বলেন, 'ভুমজাইথাই বহু বছর ধরে সরকারে রয়েছে, প্রায় প্রতিটি মন্ত্রিসভায়ই তারা অংশ নিয়েছে এবং সাধারণত লাভজনক মন্ত্রণালয়গুলো নিয়ন্ত্রণে রাখে।'
ক্ষমতার এই যাত্রায় অনুতিনের ভরসা হয়ে ওঠে 'পিপলস পার্টি'—যা ২০২৩ সালে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির সরকার গঠনে বাধা দেওয়ার পর এবার ভুমজাইথাইয়ের নেতৃত্বাধীন জোটকে বাইরে থেকে সমর্থন দিচ্ছে।
গত বুধবার সমর্থন নিশ্চিত হওয়ার পর অনুতিন বলেন, 'থাইল্যান্ডের সংকটময় সময়ে সমাধান খুঁজে পেতে পিপলস পার্টি সহযোগিতা করেছে এবং ত্যাগ স্বীকার করেছে।'
বর্তমানে থাইল্যান্ডের অর্থনীতি সংকটে, প্রতিবেশী কম্বোডিয়ার সঙ্গে উত্তেজনা তীব্র এবং নতুন রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা প্রবল। এসব প্রেক্ষাপটে উত্তেজনা প্রশমনে তার দক্ষতা কাজে লাগতে পারে।