‘শত শত কোটি টাকা’ ক্ষতি: আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে অভিযোগ দায়ের এস আলমের
আলোচিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ সাইফুল আলম (এস আলম) আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে অভিযোগ দায়ের করেছেন। তার দাবি, বিদেশে অবৈধভাবে পাচার করা সম্পদ উদ্ধারের জন্য সরকারের উদ্যোগে তার পরিবারের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান 'শত শত কোটি টাকা' ক্ষতির মুখে পড়েছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর হাতে পাওয়া নথি অনুযায়ী, এস আলম এবং তার পরিবারের পক্ষের আইনজীবীরা সোমবার ওয়াশিংটনভিত্তিক বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বিরোধ নিষ্পত্তি কেন্দ্র (আইসিএসআইডি)-এ এই সালিশি আবেদন জমা দেন।
সালিশি আবেদনে সাইফুল আলমের পরিবার অভিযোগ করেছে, মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে তারা 'নির্বিচারে সম্পদ জব্দ, বাজেয়াপ্ত ও মূল্য ধ্বংসের লক্ষ্যভিত্তিক অভিযানের' শিকার হয়েছে।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে এই মামলাটিকে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি সম্ভাব্য বাধা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, সরকার শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে বিদেশে পাচার হওয়া বিলিয়ন ডলার ফেরত আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত সরকারের 'অর্থনীতির শ্বেতপত্রে' এ অর্থের পরিমাণ আনুমানিক ২৩৪ বিলিয়ন ডলার হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান মনসুর সরকারের সম্পদ উদ্ধারের প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি অভিযোগ করেছেন, এস আলম পরিবার দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করেছে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, 'অর্থটা কোথায় গেল?'
খাদ্য, নির্মাণ, পোশাক ও ব্যাংকিংসহ নানা খাতে ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকা এস আলম গ্রুপ আহসান মনসুরের এই অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছে, এর মধ্যে 'কোনো সত্যতা নেই।'
গত ডিসেম্বরে এস আলম পরিবারের পক্ষে কাজ করা আইনজীবীরা ইউনূস সরকারকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ছয় মাসের মধ্যে বিরোধ মীমাংসা না হলে তারা আন্তর্জাতিক সালিশি মামলা করবেন।
সালিশি আবেদনে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আইন সংস্থা কুইন ইমানুয়েল আরকহার্ট অ্যান্ড সুলিভানের আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন, সরকার এস আলম পরিবারের ব্যাংক হিসাব ও সম্পদ জব্দ করেছে, তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম নিয়ে 'ভিত্তিহীন' তদন্ত চালিয়েছে এবং পরিবারটিকে লক্ষ্য করে 'উসকানিমূলক প্রচার অভিযান' সমন্বয় করেছে।
আবেদনে বলা হয়েছে, এসব কর্মকাণ্ডের ফলে 'শত শত কোটি ডলারের সমপরিমাণ বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি' হয়েছে। তবে পরিবারটি কত অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দাবি করছে, তা সেখানে উল্লেখ করা হয়নি।
এস আলম পরিবারের সালিশি আবেদনের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান মনসুর ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, 'বিষয়টি যখন আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের কাছে পৌঁছাবে, তখন আমরা যথাযথ মাধ্যমে জবাব দেব।' প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
এই সালিশি মামলা দায়ের করা হয়েছে ২০০৪ সালে বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের মধ্যে স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ চুক্তির আওতায়। আইনি নথি অনুযায়ী, এস আলম পরিবারের সদস্যরা ২০২০ সালে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করে ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন এবং বর্তমানে সেখানেই বসবাস করছেন।
এর আগে এস আলম পরিবার যুক্তি দেখিয়েছিল, তারা যেহেতু সিঙ্গাপুরের নাগরিক, তাই বাংলাদেশের ১৯৮০ সালের বৈদেশিক বেসরকারি বিনিয়োগ আইনে প্রদত্ত সুরক্ষার অধিকার তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক কর্মকর্তা আহসান মনসুর এর আগে অভিযোগ করেছিলেন, সাইফুল আলম, তার পরিবার ও সহযোগীরা দেশের শক্তিশালী সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় জোরপূর্বক ব্যাংক দখল করে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে অর্থ পাচার করেছেন।
মনসুর বলেন, 'আমরা বিপুল পরিমাণ প্রমাণ পেয়েছি, যা থেকে বোঝা যায় তারা কত সম্পদ সরিয়ে নিয়েছে। এখন আমরা তাদের ব্যাংকগুলো নিয়ে কাজ করছি, যেগুলোর নিট সম্পদ ঋণাত্মক অবস্থায় আছে… এবং সরকারকে সেগুলো উদ্ধার করতে হচ্ছে।'
অন্যদিকে, সালিশি আবেদনে এস আলম পরিবার যুক্তি দেখিয়েছে যে সরকার এখনো তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি।
চলতি বছরের শুরুর দিকে মনসুর বলেছিলেন, যারা বিদেশে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত, এমন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আর্থিক সমঝোতার বিষয়টি তিনি বিবেচনা করতে পারেন।
