পুতিনের ইউক্রেন প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য দনবাস; এ অঞ্চলের দখল নিতে মরিয়া কেন তিনি?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে আলাস্কায় অনুষ্ঠিত বৈঠক থেকে ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের যে প্রস্তাব উঠে এসেছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে কিয়েভকে পূর্বাঞ্চলের শিল্প এলাকা দনবাস ছেড়ে দিতে রাজি করানো।
ঐতিহ্যগতভাবে রুশভাষী এই অঞ্চলটিকেই পুতিন যুদ্ধের 'মূল কারণ' হিসেবে অভিহিত করে আসছেন। এ অঞ্চল দখল করাই তার ভূখণ্ডগত ও রাজনৈতিক দাবির তালিকার প্রায় শীর্ষে রয়েছে।
পুতিন ২০১৪ সালে ইউক্রেন নিয়ন্ত্রণের অভিযান শুরু করার পর থেকেই দনবাসের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে আসছেন: প্রথমে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ব্যবহার করে, পরে ২০২২ সালে এ অঞ্চলে আক্রমণ ও নিজ দেশের ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করার মাধ্যমে। পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের পর থেকে দনবাস যুদ্ধের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী লড়াইগুলোর সাক্ষী হয়েছে। এ অঞ্চলে রাশিয়ার বর্তমান গ্রীষ্মকালীন আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য।
যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী ইউক্রেনীয় গোষ্ঠী ডিপস্টেট-এর তথ্যমতে, ২০১৪ সাল থেকে ক্রেমলিনের বাহিনী এবং তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী মিত্ররা দনবাসের প্রায় ৮৭ শতাংশ দখল করেছে। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে রুশ বাহিনী এখন ইউক্রেনের হাতে থাকা এই অঞ্চলের বাকি ২ হাজার ৬০০ বর্গমাইল এলাকা ধীরে ধীরে দখল করছে।
সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধবিরতি না হলে দনবাসের লড়াই প্রায় নিশ্চিতভাবে আগামী বছর পর্যন্ত গড়াবে। এতে প্রাণহানি ঘটবে আরও হাজার হাজার মানুষের।
এই অঞ্চলের পরিণতিই ভাগ্যই যুদ্ধের ফলাফল নির্ধারণ করে দিতে পারে।

পুতিনের প্রস্তাব কী?
শুক্রবার আলাস্কায় ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যে আলোচিত শান্তি চুক্তির মূল বিষয়বস্তু এখনও অস্পষ্ট। যে কয়েকটি বিষয় জানা গেছে, তা মূলত পরে ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের একটি ফোনালাপে আলোচনার বিবরণ থেকে এসেছে।
আলোচনা সম্পর্কে অবগত দুজন ঊর্ধ্বতন ইউরোপীয় কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, পুতিন দনবাস থেকে ইউক্রেনীয় সেনা প্রত্যাহারের দাবি করছেন। এর বিনিময়ে রুশ প্রেসিডেন্ট বর্তমান ফ্রন্টলাইন বরাবর ইউক্রেনের বাকি অংশে সংঘাত থামিয়ে দেওয়ার এবং ফের আক্রমণ না করার লিখিত প্রতিশ্রুতি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে এই চুক্তি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ট্রাম্প। পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি ফক্স নিউজকে বলেন, 'রাশিয়া অনেক বড় শক্তি, কিন্তু তারা (ইউক্রেন) তা নয়।'
জেলেনস্কি এরইমধ্যে রাশিয়ার দখলে না থাকা কোনো অঞ্চল ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। গত সপ্তাহে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'আমরা দনবাস ছাড়ব না। আমরা তা করতে পারি না।'
সোমবার হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করবেন জেলেনস্কি।
ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষের হিসাবমতে, দনবাসের যে অংশটুকু এখনও তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেখানে ২ লাখের বেশি বেসামরিক নাগরিক বসবাস করে। তাদের অধিকাংশই স্লোভিয়ানস্ক ও ক্রামাতোরস্ক শহরের আশেপাশের ঘনবসতিপূর্ণ ও সুরক্ষিত শিল্পাঞ্চলে থাকেন।

পুতিন কেন দনবাস দাবি করছেন?
২০২২ সালে ইউক্রেনে আক্রমণের পর মস্কো চারটি ইউক্রেনীয় অঞ্চলে গণভোট আয়োজন করে সেগুলো সংযুক্ত করে নেয়। এই অঞ্চলগুলোর মধ্যে দোনেৎস্ক ও লুহানস্কও ছিল। এ দুটি অঞ্চল মিলে দনবাস গঠিত।
সংযুক্ত করা চারটি অঞ্চলের মধ্যে রাশিয়া শুধুমাত্র একটি, অর্থাৎ লুহানস্ক, পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে।
রুশ স্থলবাহিনী ২০২২ সাল থেকে ইউক্রেনের আরও আটটি অঞ্চলে যুদ্ধ করেছে। এর মধ্যে কিছু অঞ্চল থেকে তারা শেষপর্যন্ত পিছু হটেছে, অন্যগুলোর সামান্য অংশ দখল করে রেখেছে।
তবে দনবাসই পুতিনের যুদ্ধ-ভাবনার কেন্দ্রে রয়েছে।
তিনি প্রথমে এই আক্রমণকে এ অঞ্চলের রুশপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের রক্ষা করার পদক্ষেপ হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। এই বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ২০১৪ সাল থেকে ক্রেমলিনের সামরিক ও আর্থিক সহায়তায় কিয়েভ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল।
ক্রেমলিনের সঙ্গে যোগাযোগ থাকা মস্কোর একজন সম্পাদক কন্সট্যান্টিন রেমচুকভ বলেন, ওই প্রতিশ্রুতির কারণেই ইউক্রেনে 'কাজ সম্পন্ন' হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার জন্য দনবাসের নিয়ন্ত্রণ পুতিনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।

রেমচুকভ ও ক্রেমলিনের অন্যান্য ভাষ্যকাররা ধারণা করছেন, দখলকৃত অন্যান্য অঞ্চলের বিনিময়ে দনবাসের বাকি অংশ পাওয়ার জন্য আলোচনা করতে ইচ্ছুক হতে পারেন পুতিন।
মস্কোভিত্তিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ক্রেমলিনের সাবেক উপদেষ্টা সের্গেই মার্কভ বলেন, ''নিপ্রো, সুমি বা খারকিভের চেয়ে দোনেৎস্ককে অনেক বেশি "আমাদের" হিসেবে দেখা হয়।' রুশ সেনাদের সীমিত উপস্থিতি রয়েছে এমন ইউক্রেনীয় অঞ্চলগুলোর কথা উল্লেখ করে তিনি এই মন্তব্য করেন।
পুতিনের দাবির ভিত্তি কী?
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইউক্রেন যখন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন থেকেই দনবাস নিয়ে বিরোধ চলছে। বলশেভিক বিপ্লবের পর বিশৃঙ্খল সময়ে এ অঞ্চলের শিল্প সম্পদের জন্য ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদী, কমিউনিস্ট ও রুশ রাজতন্ত্রীদের মধ্যে লড়াই বাধে।
স্তালিনের শিল্পায়ন এবং দমন-পীড়নমূলক নীতির আগপর্যন্ত এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষই ছিল ইউক্রেনীয়। কিন্তু স্তালিনের নীতির ফলে রুশ শ্রমিকরা এ অঞ্চলের কয়লা খনি ও কারখানায় অভিবাসন করতে শুরু করে। ইউক্রেনীয় ভাষাকে দমিয়ে রাখা হয়।
জনশুমারির তথ্যমতে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় দনবাসের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বাসিন্দা রুশকে তাদের প্রথম ভাষা হিসেবে বিবেচনা করত। ইউক্রেনের স্বাধীনতার পর প্রথম দশকগুলোতে রুশ সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং ভাষা আরও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।

ইউক্রেনের ২০১০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দনবাসের প্রায় ৯০ শতাংশ ভোটার রুশপন্থি প্রার্থী ভিক্টর এফ. ইয়ানুকোভিচের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। চার বছর পর কিয়েভে বিক্ষোভকারীরা তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতাচ্যুত করলে পুতিন ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করেন এবং দনবাসে বিদ্রোহ উসকে দেন।
এই বিদ্রোহের ফলে দেশটিতে এ অঞ্চলে রুশ-বিরোধী মনোভাবের জন্ম হয়। ২০১৯ সালে ইউক্রেনের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দনবাসের ইউক্রেন-নিয়ন্ত্রিত অংশটি ব্যাপক হারে জেলেনস্কিকে ভোট দেয়। তিনি রুশভাষী হলেও ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব বিসর্জন না দিয়ে শান্তি আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
এদিকে পুতিন কয়েক বছরের অর্থনৈতিক স্থবিরতার পর জনগণের সমর্থন জোগাড়ের জন্য ক্রমবর্ধমান যুদ্ধংদেহী জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকছিলেন। তার প্রচারযন্ত্র দনবাসের পক্ষে রুশদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করে। শেষপর্যন্ত তা সর্বাত্মক যুদ্ধে গড়ায়।
পুতিন কি দনবাসেই থেমে যাবেন?
পুতিন বিভিন্ন সময়ে ইউক্রেনের অন্যান্য অংশ দখলের ইঙ্গিত দিয়েছেন। এর ফলে ইউক্রেনীয় কর্মকর্তা এবং অনেক পশ্চিমা রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষক যুক্তি দেন, রাশিয়া বলপ্রয়োগে বা কূটনীতির মাধ্যমে দনবাস দখল করার পরও যুদ্ধ চলতে থাকবে।
অনেক রুশ জাতীয়তাবাদী ও সৈন্য দনবাসের বাইরেও খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়ার বাকি ভূখণ্ড দখলের জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
অন্যান্য যুদ্ধপন্থী ভাষ্যকাররা বলেছেন, জেলেনস্কির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত রাশিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।
তবে অনেক স্বাধীন বিশ্লেষক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, দনবাসের বাইরে আক্রমণ আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো অর্থনৈতিক ও সামরিক সামর্থ্য রাশিয়ার আছে কি না। রাশিয়ার অর্থনীতির গতি ধীর হয়ে পড়ছে, রাজস্ব আয় কমছে। ফলে রুশদের জীবনযাত্রার মান ব্যাপক না কমিয়ে আগামী বছর পর্যন্ত যুদ্ধের বর্তমান গতি বজায় রাখা ক্রেমলিনের জন্য কঠিন হবে।
কিছু বিশ্লেষকের মতে, কিছুটা দুর্বল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পুতিনকে অন্তত কিছুদিনের জন্য দনবাস নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে প্ররোচিত করতে পারে।
কার্নেগি রাশিয়া ইউরেশিয়া সেন্টারের রুশ রাজনীতি বিশেষজ্ঞ তাতিয়ানা স্টানোভায়া বলেন, 'রুশ সমাজ এমন শোচনীয় অবস্থায় আছে যে তারা যুদ্ধের প্রায় যেকোনো ফলাফল মেনে নিতে প্রস্তুত থাকবে। সমাজের কিছু প্রান্তিক অংশ, যেমন উগ্র-দেশপ্রেমিক ও তাদের মতো অন্যদের কাছ থেকে বিভিন্ন মাত্রার অসন্তোষ আসতে পারে। তবে ক্রেমলিন তা সামাল দিতে পারবে।'