ট্রাম্প নোবেল শান্তি পুরস্কার পাবেন কি না, সিদ্ধান্ত নেবেন যে পাঁচ বিচারক

সবধরণের জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে আজ ঘোষণা করা হচ্ছে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীর নাম। তবে এবারের পুরস্কারকে ঘিরে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
আটটি যুদ্ধের অবসান ঘটানোর দাবি করে পুরস্কারটি জেতার জন্য তিনি শুধু আশাবাদীই নন, রীতিমতো চাপও সৃষ্টি করেছেন। তার এই আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার নরওয়ের নোবেল কমিটির পাঁচ সদস্যের ওপর। বাংলাদেশ সময় আজ বিকেল তিনটায় অসলো থেকে বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে।
আলফ্রেড নোবেলের উইল অনুসারে, প্রতি বছর নরওয়ের সংসদ দ্বারা নির্বাচিত পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি এই পুরস্কার প্রদান করে। জাতিসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন, সামরিক বাহিনীর বিলুপ্তি বা হ্রাস এবং শান্তি সম্মেলনের আয়োজন ও প্রসারে যিনি সবচেয়ে বেশি বা সেরা কাজ করেছেন, তাকেই এই সম্মাননা দেওয়া হয়।
অত্যন্ত গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে বিজয়ীকে নির্বাচন করা হয়। ৩১ জানুয়ারি মনোনয়নের সময়সীমা শেষ হওয়ার পর থেকে গোটা বিশ্ব তাকিয়ে আছে এই ঘোষণার দিকে।
জানুয়ারিতে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করে আসছেন যে তিনি একাই বিশ্বের আটটি যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছেন। তিনি বারবার বলেছেন যে এ বছরের নোবেল পুরস্কারটি তারই প্রাপ্য এবং তিনি এ পুরস্কার না পেলে তা আমেরিকার জন্য 'বড় অপমান' হবে।
এখন প্রশ্ন হলো, কারা এই নোবেল কমিটির পাঁচ সদস্য, যারা এ বছরের এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নিতে চলেছেন?
১৮৯৭ সালে নরওয়ের পার্লামেন্ট 'স্টরটিং' এই নোবেল কমিটি প্রতিষ্ঠা করে। কমিটির সদস্যরা ছয় বছরের জন্য নির্বাচিত হন এবং পুনরায় নির্বাচিত হতে পারেন। নিয়ম অনুযায়ী, তারা সংসদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করলেও বর্তমান সংসদ সদস্য হতে পারেন না।
এ বছর নোবেল কমিটির সদস্যরা হলেন:
ইয়োর্গেন ভাৎনা ফ্রিডনেস
ফ্রিডনেস নোবেল কমিটির বর্তমান চেয়ারম্যান। ৪১ বছর বয়সী ফ্রিডনেস কমিটির ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ চেয়ারম্যান। মানবাধিকারকর্মী হিসেবে পরিচিত ফ্রিডনেস অতীতে ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস ও পেন নরওয়ের মতো সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছেন। ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির সমর্থক হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে অরাজনৈতিক।

অ্যাশলে তোয়ে
৫১ বছর বয়সী তোয়ে একজন রক্ষণশীল চিন্তাবিদ হিসেবে পরিচিত। তিনি নোবেল কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান। কমিটিতে যোগ দেওয়ার আগে তিনি নরওয়েজিয়ান নোবেল ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক ছিলেন।
অ্যানা এঙ্গার
৭৫ বছর বয়সী এঙ্গার একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। তিনি ২০১৮ সাল থেকে কমিটির সদস্য হিসেবে আছেন এবং ২০২১ থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত তার সদস্যপদ নবায়ন করা হয়েছে। এঙ্গার ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত নরওয়ের সংস্কৃতি মন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও, তিনি গর্ভপাতবিরোধী অবস্থানের জন্য পরিচিত।
ক্রিস্টিন ক্লেমেট
৬৮ বছর বয়সী ক্রিস্টিন ক্লেমেট ২০২১ সালে কমিটিতে নিযুক্ত হন। তিনি নরওয়ের কনজারভেটিভ পার্টির রাজনীতিবিদ এবং সাবেক শিক্ষামন্ত্রী। পেশায় অর্থনীতিবিদ ক্লেমেট দুইবার প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাও ছিলেন।
গ্রি লারসেন
৪৯ বছর বয়সী লারসেনকে তাকে ২০২৪-২০২৯ মেয়াদের জন্য কমিটিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি লেবার পার্টির সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেট সেক্রেটারি এবং নারী অধিকার সংস্থা 'কেয়ার নরওয়ে'র প্রধান। তিনি অতীতে ট্রাম্পের বৈদেশিক সাহায্য কমানোর নীতির কড়া সমালোচক ছিলেন।
তবে এই কমিটির সদস্যরাও সবসময় বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেননি। ২০১৯ সালে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদকে পুরস্কার দেওয়ার কমিটিতে ছিলেন অ্যাশলে তোয়ে ও অ্যানা এঙ্গার। কিন্তু পুরস্কার পাওয়ার পরের বছরই আবি আহমেদের সরকার টাইগ্রেতে সামরিক অভিযান শুরু করলে সেই সিদ্ধান্ত ব্যাপক সমালোচিত হয়।
এ বিষয়ে অ্যাশলে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'নোবেল শান্তি পুরস্কার যদি ক্ষোভ ও তীব্র আবেগ তৈরি না করে, তাহলে আমরা আমাদের সুনাম ধরে রাখতে পারতাম না।'
২০০৯ সালে বারাক ওবামা নোবেল পাওয়ার পর থেকেই এই পুরস্কারের জন্য মুখিয়ে আছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ বছর পুরস্কার জেতার জন্য তিনি রীতিমতো যা করছেন, যা নিয়ে কমিটির অন্দরমহলে অস্বস্তি রয়েছে।
কমিটির চেয়ারম্যান ফ্রিডনেস জানিয়েছেন, প্রতি বছর হাজারো অনুরোধ ও চাপ আসে, কিন্তু কমিটি স্বাধীনভাবেই সিদ্ধান্ত নেয়। তিনি সরাসরি ট্রাম্পের নাম না বললেও অতীতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের 'গণতান্ত্রিক দেশগুলোর' ওপর দমন-পীড়নের সমালোচনা করেছেন।
কমিটির সদস্য ক্রিস্টিন ক্লেমেট ট্রাম্পের বিষয়ে বেশ সংশয়বাদী। তিনি লিখেছেন, ট্রাম্প 'আমেরিকান গণতন্ত্রকে ভেঙে ফেলার পথে' এবং 'উদার ও নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা ধ্বংস করার' চেষ্টা করছেন। গ্রি লারসেনও নারী অধিকার ও বৈদেশিক সাহায্যের বিষয়ে ট্রাম্পের অবস্থানের সমালোচক।
তবে ভাইস চেয়ারম্যান আসলে তোয়ে কিছুটা ভিন্ন অবস্থানে। তিনি পশ্চিমা উদারপন্থীদের ট্রাম্প সম্পর্কে আরও 'সূক্ষ্ম' দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তবে তিনিও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, পুরস্কারের জন্য চাপ সৃষ্টি করাকে কমিটি পছন্দ করে না, এটি বরং নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আলোচনায় আরও যাঁরা
এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মোট ৩৩৮টি মনোনয়ন জমা পড়েছে, যার মধ্যে ২৪৪ জন ব্যক্তি এবং ৯৪টি সংস্থা। বাজিকরদের মতে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাশাপাশি সুদানের যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের জন্য কাজ করা স্বেচ্ছাসেবক দল 'ইমার্জেন্সি রেসপন্স রুমস' পুরস্কার জয়ের দৌড়ে এগিয়ে রয়েছে।
পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট অসলোর পরিচালক নিনা গ্রেগারের সম্ভাব্য বিজয়ীদের তালিকাতেও সুদানের এই সংগঠনটি রয়েছে। এছাড়া সাংবাদিকদের সুরক্ষায় কর্মরত সংস্থা 'কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস' (সিপিজে) এবং রুশ বিরোধী নেতা আলেক্সেই নাভালনির স্ত্রী ইউলিয়া নাভালনায়ার নামও আলোচনায় রয়েছে।
চলমান যুদ্ধ, গণতান্ত্রিক দমন-পীড়ন এবং ট্রাম্পের চাপের মধ্যে নোবেল কমিটির এ বছরের সিদ্ধান্তটি নিঃসন্দেহে কঠিন। তবে কমিটির চেয়ারম্যান ফ্রিডনেস যেমনটি বলেছেন, 'আমাদের পছন্দে শক্তিশালী এবং নীতিগতভাবে অবিচল থাকতে হবে... এটাই আমাদের কাজ।' এখন দেখার বিষয়, সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে কার নাম ঘোষিত হয় বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক এই পুরস্কারের জন্য।