পুঁজিবাজারে বেক্সিমকো সংশ্লিষ্ট ৬,৭৯৮ কোটি টাকার বিনিয়োগ, শেয়ার কারসাজির সন্দেহে তদন্ত শুরু

দেশের পুঁজিবাজারে বেক্সিমকো গ্রুপ সংশ্লিষ্ট আটটি প্রতিষ্ঠান ও গ্রুপ-সংশ্লিষ্ট ৩৪ ব্যক্তির ৬ হাজার ৭৯৭.৭৮ কোটি টাকা বিনিয়োগের তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। অভিযোগ অনুযায়ী, ব্যাংক থেকে অনিয়মিতভাবে ঋণ নিয়ে এসব বিনিয়োগ করা হয়েছে।
বিএফআইইউ'র প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, এসব বিনিয়োগের অর্থ আইএফআইসিসহ কয়েকটি ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা হয়। এই বিনিয়োগের টাকা দিয়ে কৃত্রিমভাবে শেয়ারমূল্য বাড়িয়ে কারসাজি করা হয়েছে বলে সন্দেহ করছে আর্থিকখাতের গোয়েন্দা সংস্থাটি।
বিএফআইইউ তাদের অনুসন্ধানের তথ্য পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ– বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) পাঠিয়েছে। বিএসইসি বিষয়টি গভীরভাবে অনুসদ্ধানের জন্য চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে, যাতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা ও বাজারে শৃঙ্খলা বজায় রাখা যায়।
বিএসইসি'র আদেশে বলা হয়, সালমান এফ রহমান আইএফআইসি ব্যাংকের বোর্ড চেয়ারম্যান থাকাকালীন ওই ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নেওয়া হয়। ঋণের এসব অর্থ তার স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ৮ প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা হিসাবগুলোতে জমা হয় এবং পরবর্তীতে সেখান থেকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা হয়।
বিএসইসির মুখপাত্র আবুল কালাম টিবিএসকে বলেন, "পুঁজিবাজারের বেক্সিমকো গ্রুপসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের বিস্তারিত তথ্য কমিশনকে জানিয়েছে বিএফআইইউ। বিএফআইইউ এর তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিস্তারিত অনুসদ্ধানের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিএসইসি।"
সূত্র জানায়, সালমান এফ রহমান আইএফআইসি ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ও পতিত সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা থাকাকালীন এসব ঋণের অনুমোদন দেওয়া হয়।
তদন্তে চিহ্নিত আটটি প্রতিষ্ঠান হলো — অ্যাবসলুট কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, অ্যাপোলো ট্রেডিং, বেক্সিমকো হোল্ডিংস, জুপিটার বিজনেস, নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ, ক্রিসেন্ট, ট্রেডনেক্সট ইন্টারন্যাশনাল, এবং সেন্ট্রাল ল্যান্ড অ্যান্ড বিল্ডিং।
আইএফআইসি ব্যাংকের নথি অনুযায়ী, সালমান এফ রহমান ২০১০ সাল থেকে ২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন পর্যন্ত ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন। লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক আইএফআইসি'র বোর্ড বিলুপ্ত করে নতুন পরিচালক নিয়োগ দেয়।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন সালমান এফ রহমান। ইতোমধ্যে বেক্সিমকো লিমিটেডের নামে ইস্যু করা ৩,০০০ কোটি টাকার গ্রিন সুকুক ও ১,০০০ কোটি টাকার আমার বন্ডে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ায় বিএসইসি সালমান এফ রহমান ও তার ছেলে সায়ান এফ রহমানকে পুঁজিবাজার থেকে আজীবনের জন্য পারসনা নন গ্রাটা (অবাঞ্ছিত) ঘোষণা করেছে।
বিএফআইইউ প্রাপ্ত তথ্য ও বিএসইসির অনুসন্ধান কমিটি গঠনের বিষয়ে মন্তব্য জানতে বেক্সিমকো গ্রুপের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাদের কেউ নতুন তদন্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, "পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়গুলো সালমান এফ রহমান নিজেই দেখভাল করতেন। কোথা থেকে ঋণ আসবে এবং কোথায় বিনিয়োগ করা হবে, বিষয়গুলো তিনি নিজেই দেখাশুনা করেছেন। একমাত্র তিনিই পুরো চিত্র জানতেন।"
তিনি বলেন, "আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই তিনি (সালমান) কারাগারে রয়েছেন। ইতোমধ্যে বিএসইসি বিভিন্ন বিষয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। বিভিন্ন কোম্পানিতে থাকা বিনিয়োগ ফ্রিজ করা হয়েছে। যেকারণে গ্রুপের অনেক প্রতিষ্ঠান পুঁজির সংকটে থেকেও শেয়ার বিক্রি করতে পারছে না।"
বেক্সিমকো গ্রুপের ফ্লাগশিপ কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরীকে ফোন করে ও তার হোয়াটসঅ্যাপে বিএফআইইউ'র অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চেয়ে প্রশ্ন পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
বেক্সিমকো লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরী ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় বারবার যোগাযোগের পরও কোনো সাড়া দেননি। ধানমন্ডির বেক্সিমকো বেল টাওয়ারে গেলে কর্মকর্তারা জানান, "এমডি বিদেশে আছেন,"—এবং তারা আর কিছু বলতে চাননি।
বিএসইসি'র তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন— অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান, উপ-পরিচালক মওদুদ মোমেন, দুই সহকারী পরিচালক মিজানুর রহমান ও অমিত অধিকারী। কমিটিকে ৬০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
তদন্ত আদেশে আরও বলা হয়, সালমান এফ রহমান ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোম্পানির মাধ্যমে পুঁজিবাজার, ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা ব্যবহার করে বেক্সিমকো— গ্রিন সুকুক ও আইএফআইসি আমার বন্ড (শ্রীপুর টাউনশিপ) বিনিয়োগকারীদের মোট প্রায় ৩,০০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়।
শেয়ার কিনে পরিচালা পর্ষদে প্রভাব বিস্তার
বেক্সিমকো গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠান — বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস ও শাইনপুকুর সিরামিকস — পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। এই প্রতিষ্ঠানগুলো জিরো-কুপন বন্ড ও সুকুকের মাধ্যমে ৪,০০০ কোটি টাকা তুলেছিল, এবং পরে আরও ১,০০০ কোটি টাকার নতুন বন্ড ইস্যুর অনুমোদন পায়। তবে লীগের সরকার পতনের পর বন্ডটির পুরোপুরি সাবক্রিপশন হয়নি। মাত্র ৫০০ কোটি টাকার সাবক্রিপশন হয়।
নিজেদের এসব তালিকাভুক্ত কোম্পানির বাইরে অন্তত আরও দুটি কোম্পানির শেয়ার কিনে পরিচালনা পর্ষদে বসেছিল বেক্সিমকো। নিয়ন্ত্রক সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, বেক্সিমকো গ্রুপসংশ্লিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ফার ইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স এবং বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)–এর বোর্ডে প্রভাব অর্জন করে।
২০২২ সালে বেক্সিমকো সংশ্লিষ্ট ট্রেডনেক্সট ইন্টারন্যাশনাল ও জুপিটার বিজনেস— ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের যথাক্রমে ৯.৯১ ও ৯.৯ শতাংশ শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে মোট ১৯.৮১ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা অর্জন করে এবং কোম্পানির বোর্ডে চারজন পরিচালক মনোনয়ন দেয়। একই বছর বেক্সিমকো লিমিটেড বিএসসি'র ৫.২৫ শতাংশ শেয়ার কিনে একজন পরিচালক নিয়োগ দেয়।
আওয়ামী সরকারের পতনের পর ওই দুই কোম্পানি থেকে বেক্সিমকো গ্রুপ তার মনোনীত পরিচালকদের প্রত্যাহার করে নেয়। বর্তমানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিও হিসাব জব্দ থাকায় ওইসব শেয়ারও বিক্রি করতে পারেনি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বেক্সিমকোর শেয়ার কারসাজি
বেক্সিমকো গ্রুপ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার কারসাজি বা কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানোর প্রমাণও পাওয়ায় গ্রুপসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্টান ব্যক্তিদের বড় অংকের জরিমানাও করেছে বিএসইসি।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)–এর তদন্তে দেখা যায়, বেক্সিমকো গ্রুপ সংশ্লিষ্ট ৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মিলে বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ারমূল্য কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে কারসাজি করেছে। যার ফলে তাদেরকে মোট ৪২৮ কোটি টাকার জরিমানা করা হয়।
এর মধ্যে শেয়ার কারসাজিতে জড়িত থাকায় অ্যাপোলো ট্রেডিং, জুপিটার বিজনেস, ক্রিসেন্ট, এবং ট্রেডনেক্সট ইন্টারন্যাশনালকে মোট ১১৪ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়।
বিএসইসি'র প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুপিটার বিজনেসকে ২২.৫ কোটি, অ্যাপোলো ট্রেডিংকে ১৫.০১ কোটি, ট্রেডনেক্সট ইন্টারন্যাশনালকে ৪.০১ কোটি, এবং ক্রিসেন্টকে ৭৩ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
বিএসইসি'র এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "কমিশন জরিমানা আরোপের পর বেক্সিমকো সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো রিভিউয়ের (পুনর্বিবেচনার) আবেদন করে। পরবর্তীতে কমিশন তা খারিজ করলে আদালতে রিট দায়ের করে প্রতিষ্ঠানগুলো। আদালতের স্থিতাবস্থা থাকায় জরিমানা আদায় বিলম্বিত হচ্ছে।"