যেসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান 'শাটডাউন' পরিস্থিতি আগের চেয়ে আলাদা

ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান পার্টির আইনপ্রণেতারা গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ব্যয়সংক্রান্ত বিল নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যক্রম বন্ধ বা 'শাটডাউন' শুরু হয়েছে। ১ অক্টোবর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই অচলাবস্থা কার্যকর হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে সরকার বন্ধ বা শাটডাউন এখন আর নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবারের সংকটটি আগের তুলনায় আরও তিক্ত হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও দুই দলের পারস্পরিক বিরোধের কারণে।
বাজেট নিয়ে সমঝোতায় না পৌঁছানোয় যুক্তরাষ্ট্রের কিছু সরকারি সেবা সাময়িকভাবে স্থগিত হয়েছে। প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার সরকারি কর্মচারীকে বিনা বেতনে ছুটিতে পাঠানো হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অর্থবরাদ্দ বিল নিয়ে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে বারবার ভোট হলেও কোনো পক্ষই সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি। এবারের অচলাবস্থা কাটানোর পথও এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়, কারণ দুই দলই—এমনকি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকার মধ্যেই রাজনৈতিক ফায়দা দেখতে পাচ্ছেন।
২০২৫ সালের এই সরকারি 'শাটডাউনের' সংকটকে অন্যবারের চেয়ে ভিন্ন করে তুলেছে বেশ কয়েকটি কারণ।
১. ডেমোক্র্যাটদের জন্য বিষয়টি ট্রাম্প; শুধুই স্বাস্থ্যসেবা নয়
দলটির সমর্থকরা কয়েক মাস ধরেই দাবি করে আসছিলেন, ডেমোক্র্যাটদের আরও দৃঢ়ভাবে ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে। এখন দলীয় নেতৃত্বের সামনে প্রমাণ করার সুযোগ এসেছে, তারা সমর্থকদের কথা শুনেছে।
মার্চ মাসে সিনেটের নেতা চাক শুমারকে কঠোরভাবে সমালোচনা করা হয়েছিল, কারণ তিনি সরকার বন্ধ হয়ে যাওয়া রোধে রিপাবলিকানদের প্রস্তাবিত ব্যয় বিল পাসে সহায়তা করেছিলেন। তবে এবার তিনি দৃঢ় অবস্থানে আছেন।
এটি ডেমোক্র্যাটদের জন্য এমন এক সুযোগ, যেখানে তারা দেখাতে পারেন— আগ্রাসীভাবে এগিয়ে চলা প্রশাসনের ওপর আবার কিছুটা নিয়ন্ত্রণ তারা ফিরে পাচ্ছেন
রিপাবলিকানদের ব্যয় পরিকল্পনায় এবার সমর্থন না দেওয়া ডেমোক্র্যাটদের জন্য রাজনৈতিক ঝুঁকি আনতে পারে। বিরোধ দীর্ঘায়িত হলে সাধারণ মানুষের বিরক্তি বাড়তে পারে, আর তার ফলও দেখা দিতে পারে।
ডেমোক্র্যাটদের মূল দাবি হলো— মেয়াদ শেষ হতে যাওয়া স্বাস্থ্যবিমা ভর্তুকি নবায়ন করা, যা না হলে আমেরিকান পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে তারা মনে করেন। রিপাবলিকানদের বক্তব্য, সরকার পুনরায় চালু হওয়ার পরই এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে।
তবে ডেমোক্র্যাটদের দ্বিতীয় দাবি সরাসরি ট্রাম্পকে কেন্দ্র করে। তাদের অভিযোগ, ট্রাম্প কংগ্রেস অনুমোদিত অর্থ আটকে রাখছেন বা বাতিল করছেন, যা তিনি বিদেশি সহায়তা ও অন্যান্য কর্মসূচিতেও করেছেন।

২. রিপাবলিকানদের জন্য এটি এক সুযোগ
ট্রাম্প ও তার অন্যতম শীর্ষ কর্মকর্তা রাসেল ভট প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন, তারা এ পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে ফেডারেল কর্মীসংখ্যা আরও কমানোর সুযোগ দেখছেন; যা তার দ্বিতীয় মেয়াদের অন্যতম লক্ষ্য।
গত সপ্তাহে ট্রাম্প বলেন, সরকার বন্ধ থাকার ঘটনা তাকে দিয়েছে 'অভূতপূর্ব সুযোগ'। তিনি জানান, তিনি কিছু 'ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত সংস্থা'তে কাটছাঁট করার কথা ভাবছেন।
হোয়াইট হাউস জানায়, অচলাবস্থা চলতে থাকলে প্রয়োজনীয় সরকারি সেবা চালু রাখতে তাদের বড় পরিসরে ছাঁটাই করতে হবে—যা হবে একটি 'অপ্রীতিকর দায়িত্ব'। প্রশাসনের দাবি, তারা অপচয় ও জালিয়াতি থেকে করদাতাদের অর্থ বাঁচাতে চান। প্রেস সচিব ক্যারোলিন লেভিট বলেন, এটি কেবল 'আর্থিক সুস্থতার' জন্য পদক্ষেপ।
সম্ভাব্য ছাঁটাইয়ের পরিসর এখনও স্পষ্ট নয়। তবে হোয়াইট হাউস বাজেট ও ব্যবস্থাপনা দপ্তর (ওএমবি)-এর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা চালাচ্ছে, যার নেতৃত্বে আছেন রাসেল ভট।
ভট ইতোমধ্যে নিউইয়র্ক সিটি ও শিকাগোসহ ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে কেন্দ্রীয় তহবিল স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন।

৩. একে অন্যের প্রতি আস্থার ঘাটতি
আগের সরকারি 'শাটডাউন'-এর সময় দুই দল রাতভর আলোচনায় বসে সমস্যার সমাধান খুঁজত। কিন্তু এবার সেই সহযোগিতার মনোভাব প্রায় অনুপস্থিত, বরং চলছে তিক্ততা।
সপ্তাহজুড়ে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটরা একে অপরকে অচলাবস্থার জন্য দায়ী করে যাচ্ছেন।
রিপাবলিকান স্পিকার মাইক জনসন অভিযোগ করেছেন, ডেমোক্র্যাটরা আলোচনায় আন্তরিক নন এবং শুধু 'রাজনৈতিক নিরাপত্তা' পাওয়ার জন্য সমঝোতা ঠেকিয়ে রাখছেন।
এদিকে শুমারও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুলেছেন। তিনি বলেছেন, সরকার পুনরায় চালু হলে স্বাস্থ্যবিমা ভর্তুকি নিয়ে রিপাবলিকানদের আলোচনা করার প্রতিশ্রুতিকে গুরুত্ব দেওয়া যায় না।
ট্রাম্প নিজেও পরিস্থিতি উত্তপ্ত করেছেন। তিনি শুমার এবং হাউসের শীর্ষ ডেমোক্র্যাট হাকিম জেফ্রিসের একটি বিতর্কিত এআই-জেনারেটেড ছবি পোস্ট করেছেন, যেখানে জেফ্রিসকে বড় মেক্সিকান স্টাইলের সোমব্রেরো (এক ধরণের টুপি) এবং গোফসহ দেখানো হয়েছে।
জেফ্রিস ও অন্যান্য ডেমোক্র্যাটরা এটিকে বর্ণবাদী বলে আখ্যায়িত করেছেন। ভাইস-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
৪. অস্থিতিশীল মার্কিন অর্থনীতি
বিশ্লেষকরা অনুমান করছেন, অচলাবস্থার কারণে মার্কিন ফেডারেল কর্মীর প্রায় ৪ শতাংশ অর্থাৎ ৮ লাখের বেশি মানুষ বেতন ছাড়া ছুটিতে যেতে পারেন।
এতে খরচ কমবে এবং এর প্রভাব আরও বিস্তৃত হবে। পরিবেশ অনুমোদন, পেটেন্ট অনুমোদন, ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ এবং ব্যবসার সঙ্গে সংযুক্ত অন্যান্য সরকারি কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যাবে।
সরকারি অচলাবস্থা ইতোমধ্যেই অস্থিতিশীল অর্থনীতিতে নতুন অনিশ্চয়তা যোগ করছে। এর আগে আর্থিক শুল্ক, সরকারি ব্যয় কমানো, অভিবাসন অভিযান এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ বিভিন্ন পরিবর্তন অর্থনীতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।
বিশ্লেষকরা অনুমান করছেন, অচলাবস্থা প্রতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মাত্রা ০.২ শতাংশ পয়েন্ট কমাতে পারে।
তবে সাধারণত অচলাবস্থা শেষ হলে অর্থনীতি হারানো বেশিরভাগ কার্যক্রম পুনরুদ্ধার করে, যেমনটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিরতির পরেও ঘটে। এই কারণেই স্টক মার্কেট বর্তমান সংঘাতের সময় প্রধানত স্থিতিশীল দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, ট্রাম্প বড় পরিসরে কর্মী ছাঁটাই করলে তার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।