যেসব কারণে যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেনের নতুন শান্তি পরিকল্পনা প্রত্যাখান করতে পারে রাশিয়া
ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলমান যুদ্ধ বন্ধে নতুন একটি উদ্যোগ নিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। গত মঙ্গলবার তিনি ২০ দফার একটি নতুন শান্তি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন। ইউক্রেনীয় ও মার্কিন কর্মকর্তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় এই প্রস্তাবটি প্রণয়ন করা হয়েছে।
জেলেনস্কি এই নতুন প্রস্তাবটিকে নভেম্বর মাসে প্রকাশিত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিশেষ দূত কিরিল দিমিত্রিয়েভ এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ প্রণীত পরিকল্পনার একটি যুক্তিসংগত সমঝোতা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। নতুন এই রূপরেখায় ভবিষ্যতে রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকাতে কিয়েভের প্রত্যাশিত নিরাপত্তা নিশ্চয়তা এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের পরিকল্পনাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
তবে রাশিয়ার পক্ষ থেকে এই প্রস্তাব ইতিবাচকভাবে গ্রহণের সম্ভাবনা খুবই কম। যুদ্ধের ময়দানে বর্তমানে রুশ বাহিনী সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় মস্কো এখনই কোনো সমঝোতায় যেতে আগ্রহী নয়। পাশাপাশি, রাশিয়ার সাধারণ মানুষের কাছে এই পরিকল্পনাকে 'বিজয়' হিসেবে তুলে ধরাও ক্রেমলিনের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।
মস্কোভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক আলেক্সেই নাউমভ টেলিগ্রাম মেসেজিং অ্যাপে দেওয়া এক পোস্টে ইউক্রেনের নতুন পরিকল্পনাকে 'সম্পূর্ণ তামাশা' বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, "উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট—এটিকে আমেরিকানদের কাছে 'সমঝোতা' হিসেবে উপস্থাপন করা, আর পরে এর ব্যর্থতার দায় রাশিয়ার ঘাড়ে চাপানো।"
রাশিয়ার আপত্তির প্রধান কারণগুলো কী?
গত দুই বছর ধরে ভ্লাদিমির পুতিন মূলত দুটি বিষয়ে অনড় অবস্থানে রয়েছেন। প্রথমত, ইউক্রেনকে অবশ্যই দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলের অবশিষ্ট অংশ থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ইউক্রেন কখনোই ন্যাটোর সদস্য হবে না—এমন নিশ্চয়তা দিতে হবে।
গত শুক্রবার নিজের বার্ষিক সংবাদ সম্মেলনে পুতিন আবারও এই অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি জানান, কিছু ক্ষেত্রে রাশিয়া 'ছাড়' দিতে প্রস্তুত। ধারণা করা হচ্ছে, এই ছাড়ের মধ্যে রাশিয়ার দখলে থাকা খারকিভ ও জাপোরিঝিয়া অঞ্চলের কিছু অংশ ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি থাকতে পারে। তবে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, পুরো দোনেৎস্ক অঞ্চল দখলের লক্ষ্যে মস্কো লড়াই চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর।
অন্যদিকে, ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনায় শর্ত দেওয়া হয়েছে যে, রাশিয়াকে অবশ্যই নিপ্রোপেত্রভস্ক, মিকোলাইভ, সুমি ও খারকিভ অঞ্চল থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, ইউক্রেন দোনেৎস্ক অঞ্চলের কিছু অংশ থেকে সেনা সরিয়ে নিয়ে ওই এলাকাকে 'সেনামুক্ত অঞ্চল' ঘোষণা করবে। তবে তা তখনই কার্যকর হবে, যখন রাশিয়াও সমপরিমাণ এলাকা থেকে তাদের সেনা প্রত্যাহার করবে।
রুশ বিশ্লেষক জর্জি বোত এই পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেন, "এই পরিকল্পনায় ভূখণ্ড বা জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে কোনো আপসের সুযোগ রাখা হয়নি।" উল্লেখ্য, বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বর্তমানে রাশিয়ার দখলে থাকলেও ইউক্রেন এটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালনা করতে চায়। বোত আরও বলেন, "আঞ্চলিক বা সীমানা–সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান না হওয়ায় এই প্রস্তাব শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়ার মতো।"
রাশিয়া কেন এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা রাখে?
ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আক্রমণ চালাতে গিয়ে রাশিয়ার অর্থনীতি ও সেনাবাহিনীর ওপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। তা সত্ত্বেও ক্রেমলিন এখনো মনে করে, লড়াই চালিয়ে যাওয়াই তাদের জন্য বেশি লাভজনক।
২০২২ সালের পর রাশিয়ার অর্থনীতি বর্তমানে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। সেখানে সুদের হার রেকর্ড উচ্চতায় এবং প্রবৃদ্ধির গতি মন্দার দিকে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধের কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর কঠোর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়া এখনো এমন কোনো বড় অর্থনৈতিক সংকটে পড়েনি, যা তাদের যুদ্ধের পথ পরিবর্তনে বাধ্য করবে।
বর্তমানে দোনেৎস্ক অঞ্চলের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ রাশিয়ার দখলে। অগ্রযাত্রার বর্তমান গতি বজায় থাকলে পুরো অঞ্চলটি দখল করতে রাশিয়ার আরও প্রায় ১৮ মাস সময় লাগতে পারে।
রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের কঠোর অবস্থানধারী কর্মকর্তা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ গত বুধবার জানান, ২০২৫ সালে প্রায় ৪ লাখ ১৭ হাজার নতুন সদস্য রুশ সেনাবাহিনীতে যোগদানের চুক্তি করেছে। স্বাধীন গবেষকদের হিসাবেও এই সংখ্যার সঙ্গে মিল পাওয়া গেছে।
নতুন সৈন্য যুক্ত হওয়ার এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকায়, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখেও রাশিয়ার সেনাবাহিনী যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা ধরে রাখতে পারছে।
রাশিয়া কেন এখনো আলোচনার টেবিলে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্ভাব্য শান্তি চুক্তির আলোচনা নিয়ে রাশিয়ার আগ্রহের পেছনে প্রধান কারণ হলো ওয়াশিংটনের সঙ্গে একটি কার্যকর সম্পর্ক বজায় রাখা এবং চলমান যুদ্ধের পুরো দায় যেন তাদের ওপর না পড়ে, তা নিশ্চিত করা।
মস্কো একই সঙ্গে চায়, ওয়াশিংটন যেন তাদের ওপর নতুন করে কোনো নিষেধাজ্ঞা বা অতিরিক্ত অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ আরোপ না করে। গত অক্টোবর মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রাশিয়ার দুটি বৃহৎ তেল কোম্পানি—'রোজনেফট' ও 'লুকঅয়েল'-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এর ফলে রাশিয়াকে এখন উৎপাদিত তেল বড় অর্থের ছাড় দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে।
শান্তি চুক্তির শর্তাবলি নিয়ে চলমান এই দড়ি টানাটানি বিভিন্ন দেশের রাজধানীতে দীর্ঘস্থায়ী আলোচনার জন্ম দিচ্ছে। এসব আলোচনার খুঁটিনাটি বিষয় ইউক্রেন ও তার পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যে বিদ্যমান ফাটলকে আরও স্পষ্ট ও গভীর করে তুলছে।
গত বুধবার ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানান, প্রেসিডেন্ট পুতিনকে নতুন প্রস্তাবগুলো সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে এবং এ বিষয়ে মস্কো এখন তাদের অবস্থান চূড়ান্ত করছে। তিনি বলেন, "আমেরিকায় আমাদের সহকর্মীরা রাশিয়ার অবস্থানের মূল বিষয়গুলো সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই অবগত আছেন।"
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, যুদ্ধ অব্যাহত থাকার পাশাপাশি শান্তি চুক্তির শর্ত নিয়ে এই কূটনৈতিক দেন-দরবারও সম্ভবত চলতেই থাকবে।
কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক ভলোদিমির ফেসেনকো ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, "ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শেষ করার কোনো ইচ্ছে পুতিনের নেই। এমনকি বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি সামান্যতম ছাড় দিতেও প্রস্তুত নন।"
তিনি আরও বলেন, "ক্রেমলিনের কাছে ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করাটা মূলত আমেরিকার সঙ্গে একটি কৌশলগত খেলা। এর মাধ্যমে তারা বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একটি গঠনমূলক সম্পর্ক বজায় রাখতে চায় এবং একই সঙ্গে আমেরিকা ও ইউক্রেনের মধ্যে বিভেদ ও মতবিরোধ উসকে দিতে চায়।"
