জেলেনস্কিকে সঙ্গে নিয়ে অথবা তাকে ছাড়াই এগোচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র–রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা
ইউক্রেন যুদ্ধবন্ধের আলোচনা আবারও ভূখণ্ডগত প্রশ্নে আটকে পড়েছে—এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। সমস্যার উৎস খুঁজতে খুব দূর তাকানোর প্রয়োজনও পড়ে না। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স সম্প্রতি বলেছেন, "সবচেয়ে কণ্টকাকীর্ণ বিষয়গুলো কখনোই মীমাংসা হয়নি, যার মধ্যে রয়েছে ডনবাস অঞ্চল কে নিয়ন্ত্রণ করবে—এই প্রশ্ন।"
যুক্তরাষ্ট্র বলছে, সতর্ক আশাবাদের কিছু কারণ রয়েছে। তবে ইউরোপের কয়েকটি কণ্ঠ আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে দাবি করছে, আলোচনায় বাস্তব ফল দেখা যাচ্ছে। ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার স্টাবের ভাষায়, "আমরা যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন একটি চুক্তির কাছাকাছি।"
এই আশাবাদের বাস্তব পরীক্ষা শিগগিরই আসছে, যখন মিয়ামিতে হওয়া সংলাপগুলোর বিষয়ে রাশিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবহিত করা হবে। এর মধ্যেই হোয়াইট হাউসের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ ইউক্রেনের নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান রুস্তেম উমেরভের সঙ্গে যৌথ বিবৃতিতে রবিবারের (২১ ডিসেম্বর) বৈঠককে "ফলপ্রসূ ও গঠনমূলক" বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, আলোচনাগুলো "ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে একটি অভিন্ন কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর কেন্দ্রীভূত ছিল।"
রাশিয়ার কাছে আলোচনা প্রক্রিয়া ধরে রাখার জোরালো কারণ রয়েছে। মস্কোর দৃষ্টিতে সাফল্যের সংজ্ঞা ইউক্রেন যুদ্ধের নিষ্পত্তি নয়—যুদ্ধে তারা 'জয়ী হচ্ছে' বলেই নিজ ভাষ্যে দাবি করছে। বরং রাশিয়া এধরনের আলোচনার কাঙ্ক্ষিত ফল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়।
তবে রাশিয়া–যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত সম্পর্কের সম্ভাব্য সব উপাদান এখনো আলোচনার টেবিলে এসেছে—এমন নয়। যা জানা যাচ্ছে, তা হলো রাশিয়ার প্রধান আলোচক কিরিল দিমিত্রিয়েভ যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ আলোচক উইটকফের সঙ্গে বিভিন্ন বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা করছেন।
এই ধরনের ব্যবসায়িক ব্যবস্থার মধ্যে থাকতে পারে আর্কটিক অঞ্চলে যৌথ প্রকল্প—যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগ্রহের অন্যতম লক্ষ্য এবং যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় রাশিয়া এগিয়ে রয়েছে। পাশাপাশি প্রযুক্তি ও খনিজ খাতে সম্ভাব্য সহযোগিতার কথাও উঠেছে, যার মধ্যে বিরল খনিজ ও ইউরেনিয়াম অন্তর্ভুক্ত। এসব অর্থনৈতিক আলোচনার সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়টি।
দিমিত্রিয়েভ যেহেতু একজন বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ এবং কৌশলগত সামরিক ইস্যুতে আলোচনার ম্যান্ডেট তাঁর নেই, তাই এসব আলোচনা ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখা হয়েছে। রাশিয়া বহুবার জানিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চায় এবং এমন কৌশলগত চুক্তি করতে আগ্রহী, যা যুক্তরাষ্ট্র–রাশিয়া এবং রাশিয়া–ইউরোপ সম্পর্ককে স্থিতিশীল করবে।
একই কথা প্রযোজ্য উইটকফ ও তাঁর সহযোগী, ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারের ক্ষেত্রেও। বাস্তবে, রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত সংলাপে অংশ নেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ছাড়পত্র তাঁদের কারও আছে কি না—তা নিয়েও স্পষ্টতা নেই।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর সাম্প্রতিক এক মন্তব্য—যেখানে তিনি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সরাসরি বৈঠকের ইঙ্গিত দিয়েছেন—ইঙ্গিত দেয় যে ফ্রান্স হয়তো এই অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে।
পুতিনের জন্য এখন চ্যালেঞ্জ হলো, মাখোঁর এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন শান্তি প্রচেষ্টার ভারসাম্য রক্ষা করা, যাতে কোনো বিভ্রান্তি তৈরি না হয়। এ পর্যন্ত রাশিয়া ইউরোপের সঙ্গে সংলাপকে স্বাগত জানালেও, মাখোঁকে এককভাবে এগোতে না দিয়ে বিষয়টি কৌশলে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সঙ্গে কৌশলগত সামরিক, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক চুক্তি করার ক্ষেত্রে রাশিয়ার বাস্তব প্রয়োজন রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হলে রাশিয়ার অর্থনীতিকে নতুনভাবে বিন্যাস করতে হবে—এ বিষয়টি পুতিন ভালোভাবেই বোঝেন।
ইতোমধ্যে ইলেকট্রনিকস, উন্নত মেশিন টুলস, জটিল ধাতুবিদ্যা, রোবটিক্স ও কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো খাতে রাশিয়া ক্রমেই চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে—যে খাতগুলো রাশিয়ার ভেতরে হয় অনুপস্থিত, নয়তো খুবই দুর্বলভাবে বিকশিত।
শক্তিশালী বাণিজ্যিক খাতের অভাব এবং দীর্ঘদিনের সীমিত বিনিয়োগ রাশিয়াকে কার্যত পারমাণবিক অস্ত্রধারী কিন্তু একইসঙ্গে একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশের চেহারা দিয়েছে—যে বাস্তবতা পুতিনের দুই ধাপ আগের পূর্বসূরি মিখাইল গর্বাচেভ প্রায় ৪০ বছর আগেই উপলব্ধি করেছিলেন। তবে রাশিয়া তার মহাকাশ ও বিমান শিল্পে সক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেছে এবং এখন পশ্চিমা আমদানি ছাড়াই নিজস্বভাবে বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ তৈরি করতে পারছে—যা নিঃসন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন।
কিন্তু এই অগ্রগতি যে বাণিজ্যিকভাবে টেকসই—তা এখনো প্রমাণ করতে পারেনি রাশিয়া, যদিও মস্কোর কাছে বিষয়টি খুব একটা গুরুত্ব বহন নাও করতে পারে। পশ্চিমা বিশ্ব যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে এবং চীন দ্রুত সেই পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন রাশিয়া অনেকটাই স্থবির। ড্রোন ও কিছু অস্ত্রব্যবস্থায় সীমিত এআই সক্ষমতা প্রদর্শনের বাইরে বড় কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। আধুনিক সেনাবাহিনীর জন্য উচ্চমাত্রার সমন্বয় এবং এআই-নির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণ অপরিহার্য—যা রাশিয়ার ক্ষেত্রে এখনো ব্যাপকভাবে অনুপস্থিত।
রাশিয়ার সামনে মূল প্রশ্ন হলো—ইউক্রেন ইস্যুতে কোনো সমঝোতায় না গিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে, এমনকি ন্যাটোর কিছু বড় দেশের সঙ্গে, বিশেষ করে ফ্রান্সের সঙ্গে, ভবিষ্যৎ চুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব কি না। সোভিয়েত আমলে ফ্রান্সের সঙ্গে রাশিয়ার উল্লেখযোগ্য ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ভূখণ্ডগত প্রশ্নে (শান্তি প্রতিষ্ঠার) আলোচনা আটকে রাখার মাধ্যমে এমন এক পরিণতিকেই সহায়তা করছেন; যা ইউক্রেনকে পাশ কাটিয়েই রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রকে অন্য পথে শান্তির সন্ধানে সহায়তা করতে পারে।
লেখক: স্টিফেন ব্রায়েন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপ-প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী এবং এশিয়া টাইমস-এর বিশেষ প্রতিবেদক। লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নিউজলেটার ওয়েপনস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি-তে। টিবিএসের পাঠকের জন্য নিবন্ধটির পরিমার্জিত ভাবানুবাদ এখানে তুলে ধরা হলো।
