কে পেতে পারেন নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ২০২৫?

প্রতি বছর অক্টোবর এলেই একটা কৌতূহল জেগে ওঠে পাঠকদের মনে—কাকে দেয়া হবে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার? কিন্তু এই পুরস্কারের আসল সৌন্দর্য হয়তো পুরস্কার জয় নয়, বরং সেই সুযোগে পৃথিবীর নানা ভাষার, নানা প্রান্তের লেখকদের নতুন করে আবিষ্কার করার মধ্যেই। নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর প্রায়ই আমরা মানুষকে বলতে শুনি, "কখনো নামও শুনিনি এমন একজন লেখক নোবেল পেয়ে গেলেন!" আমার কাছে এটাকেও নোবেলের একটা সৌন্দর্য বলে মনে হয়। পুরস্কার ঘোষণার আগে যেমন প্রচুর নতুন সাহিত্যিকদের নাম শোনা যায়, জয়ের পরেও গভীরভাবে জানার সুযোগ হয় আরও একজন সাহিত্যিককে। প্রতি বছর এই পুরস্কারের মাধ্যমে আমরা নতুন নতুন কণ্ঠে শুনি –মানুষের গল্প। এই কারণেই আমার কাছে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার গুরুত্বপূর্ণ; এটি কেবল স্বীকৃতি নয়, আমাদের জন্য আবিষ্কারের একটা উপলক্ষ। সেই উপলক্ষেই তাই বেশ কয়েকজন সাহিত্যিকদের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করবো যাঁরা এবছর পেতে পারেন নোবেল পুরস্কার। নোবেল কমিটি প্রায় সময়ই অনেক বেশি জনপ্রিয় লেখকদের তালিকায় রাখেন না। হয়তো তাঁরা ভাবেন যে, যে লেখকের নাম বিশ্বজুড়ে সবাই জানে, প্রতিবছরই নোবেলের জন্য মানুষ বিবেচনা করেন তাঁদের কথা সবাইকে জানানোর জন্য হয়তো আর নোবেল পুরস্কার দেয়ার দরকার নেই। তাঁরা তো এমনিতেই আছেন পৃথিবীবাসীর হৃদয়ে। আমার এই তালিকায়ও তাই হারুকি মুরাকামি বা সালমান রুশদির মতো নাম জায়গা পায়নি। আপনারাও নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে জানেন তাঁদের কাজের সম্পর্কে। এই লেখায় তাই কিছু অপ্রচলিত ধারণা আর কমচেনা লেখকদের কথাই বেশি থাকছে। দেখা যাক, আমার সম্ভাব্য দশজনের তালিকা থেকে কেউ পেয়ে যান কিনা এই বছরের সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার!
১. অরুন্ধতী রায় (ভারত, জন্ম ১৯৬১)
অরুন্ধতী রায়ের লেখার ভেতর রাজনীতি, সৌন্দর্য আর মানুষের জীবন একাকার হয়ে গেছে। তাঁর প্রথম উপন্যাস দ্য গড অব স্মল থিংস (The God of Small Things) তাঁকে বিশ্বসাহিত্যের কেন্দ্রে নিয়ে আসে। কেরালার প্রেক্ষাপটে লেখা এই উপন্যাসে যে মমতা, শ্রেণি-চেতনা আর পারিবারিক ভাঙনের গল্প উঠে এসেছে, তা একইসঙ্গে ব্যক্তিগত আর রাজনৈতিক। কিন্তু তাঁর প্রকৃত শক্তি প্রকাশ পায় প্রবন্ধে—দ্য অ্যালজেব্রা অব ইনফিনিট জাস্টিস (The Algebra of Infinite Justice), আজাদি (Azadi), ওয়াকিং উইথ দ্য কমরেডস (Walking with the Comrades), কিংবা সাম্প্রতিক মাদার মেরি কামস টু মি (Mother Mary Comes to Me, ২০২৪)-তে। এই লেখাগুলোয় তিনি সমাজ, রাষ্ট্র, প্রকৃতি ও ন্যায়—এই চারটি বিষয়কে একসঙ্গে দেখেন।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট (The Washington Post)-এর এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, নোবেল কমিটি অনেক সময় এমন লেখকদের খোঁজে, যারা "সুপারফিশিয়ালি সিমিলার"—অর্থাৎ কোনো প্রতিষ্ঠিত নামের কাছাকাছি ভাবধারায় কাজ করেন কিন্তু কম আলোচিত। সেই যুক্তিতে অনেকেই অমিতাভ ঘোষকে সম্ভাব্য প্রার্থী মনে করছেন। তবে অরুন্ধতী রায়ের কাজ অমিতাভ ঘোষের চেয়ে অনেক বেশি ধারালো, ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিকভাবে সাহসী। অমিতাভ ঘোষ যেখানে ইতিহাসের পাণ্ডিত্য দিয়ে কথা বলেন, অরুন্ধতী রায় সেখানে অন্তর্দৃষ্টি ও কবিত্বে ভর করে এগিয়ে যান। আমার কাছে রায়ের সবচেয়ে বড় শক্তি তাঁর কলমের সততা—তিনি যা বিশ্বাস করেন, তা-ই লেখেন। আর এই আন্তরিকতাই তাঁকে করে তুলেছে এই সময়ের অন্যতম জরুরি কণ্ঠ।
২. এলিফ শাফাক (তুরস্ক–যুক্তরাজ্য, জন্ম ১৯৭১)
এলিফ শাফাকের লেখায় এক অনন্য সেতুবন্ধন তৈরি হয়—পূর্ব ও পশ্চিম, ধর্ম ও আধুনিকতা, রাজনীতি ও অনুভূতি একসঙ্গে প্রবাহিত হয় তাঁর গদ্যে। তিনি নিজেই বলেন, "আমার ভেতর দুটি জগৎ বাস করে"—একটি ইস্তাম্বুলের, আরেকটি লন্ডনের। এই দুই জগতের সংঘাত ও সংলাপই তাঁর সাহিত্যকে গভীর করেছে। তাঁর উপন্যাস দ্য বাস্টার্ড অব ইস্তানবুল (The Bastard of Istanbul) একদিকে ইতিহাস ও পরিচয়ের পুনর্গঠন, অন্যদিকে ব্যক্তিগত জীবনের প্রশ্ন। দ্য ফর্টি রুলস অব লাভ (The Forty Rules of Love) তাঁকে এনে দেয় আন্তর্জাতিক পরিচিতি—এখানে তিনি রুমি ও শামস তাবরিজির গল্পের মাধ্যমে স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা ও আধ্যাত্মিকতার সার্বজনীন দর্শন তুলে ধরেন। পরে ১০ মিনিট ৩৮ সেকেন্ডস ইন দিস স্ট্রেঞ্জ ওয়ার্ল্ড (10 Minutes 38 Seconds in This Strange World) এবং দ্য আইল্যান্ড অব মিসিং ট্রিজ (The Island of Missing Trees)-এ উঠে আসে মৃত্যু, নির্বাসন ও পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীলতা।
তাঁর সাম্প্রতিক বই দেয়ার আর রিভার্স ইন দ্য স্কাই (There Are Rivers in the Sky, ২০২৪) তিনটি মহাদেশ, তিনটি সময়, আর তিনজন নারীর জীবনের ভেতর দিয়ে পানি, স্মৃতি ও শোকের সংযোগ অনুসন্ধান করে। এই উপন্যাসে শাফাক যেন আরও শান্ত, আরও গভীর—তাঁর আধ্যাত্মিকতার রূপ এখন পরিবেশবাদ ও বিশ্বমানবতার ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে।
আমার কাছে এলিফ শাফাক সেই লেখক, যিনি ভাষা ও সংস্কৃতির সীমানা মুছে দিতে পারেন। তাঁর লেখার ভেতর আছে সাহসের কোমলতা—যা একইসঙ্গে তুরস্কের রাজনৈতিক বাস্তবতা ও বিশ্বের মানসিক বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। নোবেল কমিটি যদি এমন একজন সাহিত্যিককে বেছে নিতে চায়, যিনি মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করতে পারেন, তাহলে শাফাকের নাম সেখানে অনিবার্য।
৩. আদানিয়া শিবলি (প্যালেস্টাইন, জন্ম ১৯৭৪)
আদানিয়া শিবলি এমন একজন লেখক, যাঁর লেখায় নীরবতা শব্দের চেয়েও জোরালো। তাঁর উপন্যাস মাইনর ডিটেইল (Minor Detail) দেখতে ছোট একটি বই, কিন্তু তাতে গাঢ়ভাবে মিশে আছে যুদ্ধ, স্মৃতি, এবং ন্যায়বিচারের অভাবের দীর্ঘ ইতিহাস। ১৯৪৯ সালের এক সহিংস ঘটনার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই বইটি দুইটি ভিন্ন সময়ের নারীর গল্পে ভাগ করা—একজন ভুক্তভোগী, অন্যজন অনুসন্ধানী। দুই গল্প মিলে তৈরি হয়েছে এক অস্বস্তিকর মনস্তাত্ত্বিক আয়না, যেখানে পাঠক নিজেকে দেখেন ইতিহাসের অপরাধের অংশীদার হিসেবে। শিবলির ভাষা নিয়ন্ত্রিত, প্রায় শুষ্ক—কিন্তু এই সংযমই তাঁর সাহিত্যের শক্তি। তিনি লেখেন নীরবতার ভাষায়; শোনান মানুষের কষ্টের গভীর শব্দ। আদানিয়া শিবলির কণ্ঠস্বর এই সময়ের অন্যায় ও মানবিকতার জটিলতার এক অনন্য প্রতিফলন।
৪. লাসলো ক্রাজনাহোরকাই (হাঙ্গেরি, জন্ম ১৯৫৪)
লাসলো ক্রাজনাহোরকাইকে বলা হয় "ধৈর্যের লেখক"—তাঁর বাক্য দীর্ঘ, তাঁর বর্ণনা ধীর, কিন্তু সেই ধীরতার ভেতরই তৈরি হয় এক অদ্ভুত ঘূর্ণন। সাটানতাঙ্গো (Satantango) ও দ্য মেলানকোলি অব রেসিস্ট্যান্স (The Melancholy of Resistance) ইউরোপীয় সমাজের পতন ও মানসিক বিশৃঙ্খলাকে এক প্রলয়ের মতো ফুটিয়ে তুলেছে। তাঁর লেখা পড়লে মনে হয়, সভ্যতার শেষ মুহূর্তগুলো কোনো তীব্র সংঘর্ষ নয়, বরং দীর্ঘ নিঃশ্বাসের মতো নিস্তব্ধ। ক্রাজনাহোরকাই সাহিত্যের মধ্যে একটি "মেটাফিজিক্যাল" গতি আনেন—যেখানে প্রতিটি চরিত্র যেন একেকটি প্রশ্ন, প্রতিটি ঘটনা এক ধরণের ধ্যান। তিনি এক দার্শনিক গল্পকার, যিনি মানুষের ব্যর্থতার সৌন্দর্যেটুকু ফুটিয়ে তুলতে চান সাহিত্যে। মানবসভ্যতার আত্মপর্যালোচনার ধারায় ফিরে যেতে চাইলে, তাঁর মতো একজন লেখক দিকচিহ্ন হয়ে উঠতে পারেন আমাদের জন্য।
৫. সিজার আইরা (আর্জেন্টিনা, জন্ম ১৯৪৯)
সিজার আইরাকে বলা যায় লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে অদ্ভুতধর্মী লেখক। শতাধিক ছোট উপন্যাস লিখে তিনি প্রমাণ করেছেন, সাহিত্য পরিশ্রমের পাশাপাশি কৌতুক, তাৎক্ষণিকতা, আর স্বাধীন কল্পনারও জায়গা আছে। ভারামো (Varamo), ঘোস্টস (Ghosts), অ্যান এপিসোড ইন দ্য লাইফ অব আ ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টার (An Episode in the Life of a Landscape Painter)—সবখানেই তিনি বাস্তবতার সীমানা ভেঙে এক হালকা বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছেন তাঁর লেখায়। আইরার লেখার ভেতর হাসি আছে, কিন্তু সেই হাসির পেছনে থাকে এক ধরণের অস্তিত্বের সংকট। তিনি বোরহেস বা কোর্তাসারের যেমন উত্তরসূরি, তেমনি সম্পূর্ণ নিজের মতো স্বকীয়। তাঁর প্রতিটি বই যেন নতুন এক খেলা—যেখানে লেখক ও পাঠক দুজনেই নিয়ম ভেঙে ফেলেন। সাহিত্যের আনন্দ আর স্বতঃস্ফূর্ততাকে গভীরভাবে ধারন করে সিজার আইরার সাহিত্য।
৬. মিরচা কার্তারেস্কু (রোমানিয়া, জন্ম ১৯৫৬)
মিরচা কার্তারেস্কুর লেখায় স্বপ্ন, দার্শনিকতা আর আত্মঅনুসন্ধান একসঙ্গে মিশে যায়। ব্লাইন্ডিং (Blinding) ও সোলেনয়েড (Solenoid) তাঁর সবচেয়ে আলোচিত কাজ—দুটি বইতেই বাস্তবতা ও অবচেতনের মাঝের সীমা ক্রমে বিলীন হয়ে যায়। তাঁর ভাষা বুনোট—যেন একটি বাক্যের মধ্যেই বহু জীবন বাস করছে। কার্তারেস্কু এমনভাবে লেখেন যেন নিজের মনের ভেতর দিয়ে কেউ হাঁটছেন। তাঁর প্রতিটি শব্দ এক একটি নতুন জানালা খুলে দেয় পাঠকের সামনে। তাঁর সাহিত্য পাঠকের মনস্তত্ত্বে পরিবর্তন আনে, কারণ তিনি মানুষকে দেখেন আলো-অন্ধকারের মিশ্রনে। আত্মানুসন্ধানী সাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে মিরচা কার্তারেস্কু আমাদের জন্য জ্বালিয়ে রাখেন কৌতুহলের আলো।
৭. ক্রিস্টিনা রিভেরা গারজা (মেক্সিকো, জন্ম ১৯৬৪)
ক্রিস্টিনা রিভেরা গারজা একইসঙ্গে গল্পকার, ইতিহাসকার ও সাক্ষ্যদাতা। তাঁর নো ওয়ান উইল সি মি ক্রাই (No One Will See Me Cry) বা লিলিয়ানাস ইনভিন্সিবল সামার (Liliana's Invincible Summer) পড়লে বোঝা যায়, তিনি কীভাবে ব্যক্তিগত শোককে সামাজিক ন্যায়বোধে রূপ দিতে জানেন। তাঁর লেখায় মৃত্যু কেবল এক সমাপ্তি নয়, বরং একটি রাজনৈতিক বিবৃতি। গারজা কল্পনা ও গবেষণাকে এমনভাবে মিশিয়ে দেন যে, তাঁর প্রতিটি কাজ হয়ে ওঠে স্মৃতির নথি। তিনি সাহিত্যের ভেতর দিয়ে প্রতিবাদের নতুন ভাষা তৈরি করেছেন—নিঃশব্দ, কিন্তু দৃঢ়। সমাজ ও মানবতার মধ্যকার সেই সূক্ষ্ম সম্পর্ককে বোঝার জন্য, তাঁর মতো লেখকদের প্রয়োজন আজও অপরিবর্তনীয়।
৮. আদোনিস (সিরিয়া–লেবানন, জন্ম ১৯৩০)
আরবি আধুনিক কবিতার সবচেয়ে প্রভাবশালী নামগুলোর একটি আদোনিস। তাঁর প্রকৃত নাম আলি আহমেদ সাঈদ, কিন্তু 'আদোনিস' নামেই তিনি সাহিত্য ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন। দ্য সংস অব মিহইয়ার দ্য দামাস্কিন (The Songs of Mihyar the Damascene) ও আ টাইম বিটুইন অ্যাশেস অ্যান্ড রোজেস (A Time Between Ashes and Roses)-এ তিনি পুরাণ, রাজনীতি, ধর্ম ও প্রেম—সবকিছুকে মিশিয়ে তৈরি করেছেন আধুনিক আরবি কাব্যের নতুন ভাষা। আদোনিস প্রমাণ করেছেন, কবিতা শুধু অনুভূতির নয়—চিন্তারও ক্ষেত্র। তিনি আরব বিশ্বে স্বাধীনতার ভাষা গড়েছেন, যেখানে প্রশ্নই সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য।
৯. কান শুয়ে (চীন, জন্ম ১৯৫৩)
কান শুয়ে আধুনিক চীনা সাহিত্যের এক রহস্য। তাঁর দ্য লাস্ট লাভার (The Last Lover) এবং ফ্রন্টিয়ার (Frontier) উপন্যাস দুটিতেই তিনি তৈরি করেন এমন এক বাস্তবতা, যা একইসঙ্গে কল্পনাপ্রসূত ও সত্য। তাঁর লেখা যেন স্বপ্নের ভেতর আরেক স্বপ্ন—যেখানে প্রতিটি দৃশ্য ব্যাখ্যার বাইরে চলে যায়। তিনি গল্প বলেন অপ্রচলিত ঢঙ্গে; পাঠককে টেনে নেন এক মানসিক গোলকধাঁধায়। তাঁর লেখায় যুক্তি ও কল্পনার সীমানা এক হয়ে যায়, আর সেখানেই জন্ম নেয় এক নতুন ভাষা। পরীক্ষামূলক সাহিত্যের এই সময়ে, কান শুয়ে সেই বিরল কণ্ঠ, যিনি সাহসের সঙ্গে অচেনাকে অনুসন্ধান করে চলেছেন।
১০. অ্যান কারসন (কানাডা, জন্ম ১৯৫০)
অ্যান কারসন একইসঙ্গে কবি, অনুবাদক ও দার্শনিক। অটোবায়োগ্রাফি অব রেড (Autobiography of Red), নক্স (Nox) এবং দ্য বিউটি অব দ্য হাজব্যান্ড (The Beauty of the Husband) তাঁকে বিশ্বসাহিত্যে এক অনন্য অবস্থানে নিয়ে গেছে। তাঁর কাজের ভেতর প্রাচীন গ্রিক মিথ, ভালোবাসা, মৃত্যু আর ভাষার অনুসন্ধান একসঙ্গে মিশে যায়।
কারসনের সাহিত্য ভাবনা ও অনুভূতির সংলাপ। তিনি লিখেন যেন শব্দের নীরবতা শুনছেন। তাঁর কবিতা ও গদ্য আমাদের শেখায়—আপন মনে ভাবতে থাকাটা নিজেও এক ধরণের সৌন্দর্য।
আমার ধারণা, এ বছরের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার এই দশজনের মধ্যেই কেউ একজন পেতে পারেন। এই তালিকায় আমার ব্যক্তিগত পছন্দেরও একটা ছাপ আছে—কিন্তু সাহিত্য নিয়ে ভাবতে গেলে নিরপেক্ষতা আর ভালোলাগা দুটোই হয়তো প্রয়োজনীয়। নোবেল তো পাবেন কেবল একজন সাহিত্যিক। সেই সুবাদে আমরা আরও কিছু কালজয়ী সাহিত্যের সাক্ষী হয়ে গেলে তা মোটেই মন্দ হয় না। দশজনের তালিকা করার পরেও আরও কয়েকজন সাহিত্যিকের কথা না বললেই নয়। তাঁদের কাজও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ, হয়তো আরও বিস্তৃত পরিসরে। তাই আমার সম্ভাব্য তালিকার বাইরেও আরও ছয়জন লেখকের নাম যোগ করছি—যাঁরা প্রত্যেকে নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন পৃথিবীকে। মার্গারেট অ্যাটউড (Margaret Atwood) তাঁর দ্য হ্যান্ডমেইডস টেল (The Handmaid's Tale) ও ওরিক্স অ্যান্ড ক্রেক (Oryx and Crake)-এ ভবিষ্যতের কল্পনা দিয়ে বর্তমানের ভয় দেখিয়েছেন; তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি শীতল অথচ সত্যনিষ্ঠ। অমিতাভ ঘোষ (Amitav Ghosh) ইতিহাস, সমুদ্রযাত্রা আর জলবায়ুর প্রশ্ন একসঙ্গে মিলিয়ে লিখেছেন দ্য আইবিস ট্রিলজি (The Ibis Trilogy) ও দ্য নাটমেগ'স কার্স (The Nutmeg's Curse)-এর মতো গ্রন্থে, যা ইতিহাসের ভেতর দিয়ে পরিবেশ ও সভ্যতার গভীর সংযোগকে দেখায়। জামাইকা কিনকেইড (Jamaica Kincaid) উপনিবেশ-উত্তর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে ছোট দেশ ও সাধারণ মানুষের কণ্ঠকে সাহিত্যে এনেছেন লুসি (Lucy) ও আ স্মল প্লেস (A Small Place)-এর মতো লেখায়। অপেক্ষাকৃত তরুণ ভালেরিয়া লুইসেলি (Valeria Luiselli) বিশেষভাবে উজ্জ্বল—লস্ট চিলড্রেন আর্কাইভ (Lost Children Archive)-এ তিনি অভিবাসনের বেদনা আর শিশুর নিরুপায়তার গল্প বলেছেন এমন ভাষায়, যা একইসঙ্গে সাহসী ও সংবেদনশীল। মারজান সাত্রাপি (Marjane Satrapi) তাঁর গ্রাফিক নভেল পার্সেপোলিস (Persepolis)-এ প্রমাণ করেছেন, ছবিও সাহিত্য হতে পারে—একটি আত্মজীবনী, আবার এক জাতির ইতিহাসও। গ্রাফিক নভেলের জন্য সাধারণত কখনো নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়নি। তবে ২০১৬ সালে গীতিকার হিসেবে বব ডিলানের সাহিত্যে নোবেলপ্রাপ্তির মতো ২০২৫ সালেও যে আমরা কোন নতুন চমক দেখবো না, তা হলফ করে বলা যাচ্ছেনা। সবশেষে আছেন জেরাল্ড মারনেন (Gerald Murnane), গত কয়েকবছর ধরেই তিনি আছেন নোবেল এর আলোচনায়। দ্য প্লেইন্স (The Plains) ও বারলি প্যাচ (Barley Patch)-এ তাঁর পর্যবেক্ষণ ও ধ্যান এক শান্ত অথচ গভীর জগতের সৃষ্টি করে। এঁদের সকলের কাজই মনে করিয়ে দেয়—সাহিত্যের শক্তি কেবল শব্দে নয়, দৃষ্টিভঙ্গিতে। তাঁরা প্রত্যেকে নিজেদের মতো করে পৃথিবীকে ব্যাখ্যা করেছেন, আর সেই ব্যাখ্যার ভেতর দিয়েই আমাদের সামনে খুলে দিয়েছেন নতুন এক পাঠের দিগন্ত।
শেষমেশ, আজই আমরা জেনে যাব, কার হাতে উঠছে এ বছরের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার। কিন্তু বিজয়ীর নামের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এই অপেক্ষার সময়টুকু—যখন আমরা নতুন লেখকদের নাম শুনি, পুরোনোদের কাজ নিয়ে আবার ভাবছি, আর সাহিত্যের শক্তিকে নতুন করে অনুভব করছি। নোবেলের আসল তাৎপর্যও বোধহয় এখানেই—একটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে আমরা কেবল একজন লেখককে নয়, পুরো মানবতার কল্পনা, ভাষা ও অনুভূতির বৈচিত্র্যকেই উদযাপন করি। এই উদযাপন হোক সকল পাঠকের। আমাদের জন্য সাহিত্যকে নিজের মতো করে ধারন করার উপলক্ষ হিসেবে আসুক সাহিত্যের নোবেল।