নোবেলজয়ী লাসলো ক্রাসনাহোরকাই-এর গল্প | ঐ যায় ভালজার

আমার নাম রবার্ট ভালজার এবং আমি হাঁটতে পছন্দ করি, তবে আমার সঙ্গে সেই বিখ্যাত রবার্ট ভালসারের কোনো সম্পর্ক নেই, সেইসঙ্গে হাঁটা যে আমার প্রিয় শখ, সেটাকেও আমি অদ্ভুত কিছু বলে মনে করি না। আমি এটাকে শখই বলি, অন্তত সেভাবে ভাবতে চেষ্টা করি, তবে এই মধ্য ইউরোপীয় দেশটির যেখানে আমার বাস, সেখানে আমাকে এমনই ভারসাম্যহীন বলে মনে করা হয় যে, আমার এই শখটিকে তারা অন্যান্যদের শখের সঙ্গে তুলনা করতে রাজি নয়। এটা শখ নয়, বরং আমার ভারসাম্যহীনতার লক্ষণ, তারা দাবি করে। তারা এই শব্দটাই ব্যবহার করে: ভারসাম্যহীনতা। তবে তারা এটা আমার মুখের ওপর বলে না। পেছনে ফিসফাস করে সারাক্ষণ: আমি পরিষ্কারভাবে শুনতে পাই তারা বলছে, ঐ যায় ভালজার, আবার হাঁটতে শুরু করেছে সে।
কিন্তু তারা এই পর্যায়েও ভুল বলছে, কেননা এটা কোনোভাবেই আবার হাঁটা শুরু করা নয়। আমি সবসময়ই হাঁটছি, আর এটা এমন কোনো বস্তু নয় যে ইচ্ছে হল শুরু করলাম, আবার বন্ধ করে দিলাম, আবার শুরু করলাম, একেবারেই তা নয়, কেননা যতদূর অব্দি আমি মনে করতে পারি, আমি কেবল হাঁটছি, কোনো এক সূদূর অতীতকালে সেই যে হাঁটতে শুরু করেছিলাম আমি এবং তার পর থেকে হেঁটেই চলেছি, তার মানে আমি হাঁটতেই থাকব, কেননা আমি থামতে পারি না, কেননা আমার পক্ষে থামা অসম্ভব, হাঁটাটা আমার কাছে এক তীব্র ভালোলাগার বিষয়, এবং বিশেষ করে আমার ক্ষেত্রে এক গভীর কৌতূহলের বস্তু, কোনো পাগলামি নয়, গভীর কৌতূহল, যদিও লোকেরা আমার পেছনে ফিসফিস করে, তারা কখনো এসে জিজ্ঞেস করে না, এই রবার্ট ভালজার ছেলেটা আসলে কী করতে চাইছে, ঈশ্বরের দোহাই, সে কী করছে বলে মনে করে, সারাক্ষণ এখানে ওখানে হেঁটে বেড়িয়ে; না তারা কখনো আমাকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে না, এবং করবেও না কোনোদিন, যদিও মূল জিজ্ঞাসাটাই হচ্ছে একজন লোক এরকমভাবে হাঁটছে কেন, যার উত্তরটা হচ্ছে, যদি আমি নিজেকে পুনরাবৃত্তি করি, আমি যা করছি সেটা আসলে একধরনের কৌতূহলী হাঁটা, উদাহরণস্বরূপ, এই মুহূর্তে, এই মৃতদের দিনেও আমি হাঁটছি, কেননা মৃতদের দিনটা আমাকে খুব আকর্ষণ করে। প্রত্যেক মৃতদের দিনই আগের বছরেরটার চাইতে আলাদা এবং আমি ভবিষ্যতের কোনো মৃতদের দিন থেকেও বঞ্চিত হতে চাই না--- কেন চাইব, যখন এই দিনটা আমার কাছে এতটা আগ্রহের বস্তু?

হাঙ্গেরি, ২০১৩
মৌসুম উপযোগী হালকা পোশাক, আর ছোট্ট হালকা একটা টুপি: দুর্দান্ত আবহাওয়া। রাস্তায় সুশ্রী জনতা, প্রচুর ফুলের দোকান, সেগুলো থেকে উপচে পড়া মিখায়েলমাস ডেইজি ফুলের মধ্যে রাস্তাগুলো যেন সাঁতার কাটছে, মিখায়েলমাস ডেইজি ফুলের দারুণ এক স্রোত যেনবা, সাদা, গোলাপি ও হলুদ, মানুষেরও প্রবল স্রোত, সবাই কবরখানার দিকে ধাবমান, সবধরনের কবরখানাই রয়েছে আমাদের, প্রথমত ক্যাথলিক, তবে প্রোটেস্টান্ট, ইভাঞ্জেলিকাল এমনকি অর্থডক্সও রয়েছে, এবং স্বাভাবিকভাবেই ইহুদিদের সমাধিক্ষেত্রও রয়েছে, যেগুলোর কোনোটিতে বহুদিন কেউ সমাহিত হয়নি, কেননা সেগুলো পূর্ণ হয়ে গেছে, এবং সেসব বন্ধও করে দেওয়া হয়েছে, যেন নব্য-নাৎসিরা সেখানে হামলা করতে না পারে। এই শহরে মোট পাঁচশত পাঁচজন ইহুদি ছিল এবং এই পাঁচশত পাঁচজনকেই বের করে দেওয়া হয়েছিল। তাদের একজনও আর ফেরত আসেনি।
আমি মিখায়েলমাস ডেইজি ফুলকে ঘৃণা করি, এবং আমাকে স্বীকার করতে হবে যে, আমি মানুষের ব্যাপারেও খুব একটা আগ্রহী নই, বস্তুত, আপনারা বলতেই পারেন, আমি মানুষকেও ঘৃণা করি, বরং আরও ভালো হয় যদি বলি, আমি মিখায়েলমাস ডেইজিদের যতখানি ঘৃণা করি ঠিক ততটাই ঘৃণা করি মানুষকে, এবং সেটার সহজ কারণ, আমি যখনই কোনো মিখায়েলমাস ডেইজি ফুলকে দেখি ততবারই সেটা আমাকে মানুষের কথা মনে করিয়ে দেয়, এবং যতবারই আমি মানুষ দেখি ততবারই মানুষ নয় আমি মিখায়েলমাস ডেইজি ফুলের কথা ভাবি।
কবরখানায় জীবনের কী প্রবল সমারোহ।
আমার এই চলা আমাকে প্রথমে নিয়ে যায় ক্যাথলিক কবরস্থানের ভেতর দিয়ে, তারপর প্রোটেস্টান্ট, ইভাঞ্জেলিকাল এবং সবশেষে অর্থডক্স সমাধিক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে, সেখানে আমি দারুণসব মানুষের জটলা দেখি, যেটা খুবই অদ্ভুত, এবং আমি নিজেকেই জিজ্ঞেস করি মানুষের কাছে এই কবরস্থান ভ্রমণ কবে থেকে এতটা জনপ্রিয় হল? কাদার এর আমলে এটা নিঃসন্দেহে এমন ছিল না: তখন মোটেও কবরস্থানগুলো এখনকার মতন এতটা জনাকীর্ণ থাকত না। এখন পারিবারিক কবরগুলোর ওপরে মিখায়েলমাস ডেইজি ফুলের মালা ঝুলে রয়েছে, কারণ আপনার না দেখে উপায় নেই পুরো পরিবার মিলে কীরকমভাবে কবরগুলোকে মিখায়েলমাস ডেইজি ফুলে সাজিয়ে দিচ্ছে; ছোট বাচ্চা, বড় বাচ্চা, আরও বড় বাচ্চা, মা, বাবা, বিধবা ও বিপত্নীক, নাতিনাতনি, মামা, খালা, যাদেরই সামর্থ্য রয়েছে, কবরের অনিবার্য নিয়তিকে মানুষ কতটা হৃদয়ে ধারণ করে তারই প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্ত হবার। আমি অতি চমৎকার ও মূল্যবান পাথরে তৈরি নবীনতম সমাধিফলকগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি এবং ভাবি, পুনরুত্থানের দিনটিতে আসলে কী হবে। এখানে এত এত সন্তের উপস্থিতি যে, সেদিন মনে হয় একটি সমাধিফলকও আর দণ্ডায়মান থাকবে না।

আমার এখানে যোগ করা উচিত যে, আমি কখনো তাড়াহুড়ো যেমন করি না তেমনি ঢিলেমিও না। সেটা কোনো হাঁটা নয়। আমি পেছনে হাত জোড় করে হাঁটি। এবং আমি যা দেখি তার সব মনে রাখি। আমি ক্যাথলিক, প্রোটেস্টান্ট, ইভাঞ্জেলিকাল ও অর্থডক্স কবরস্থানগুলোর ভেতর দিয়ে পেছনের বিশাল ও বেশিদামি পার্কিং লটের দিকে যেতে যেতে দূর থেকে লক্ষ করি, সেখানে সবচেয়ে জনপ্রিয় গাড়ি হচ্ছে অতিকায় কালো জিপগুলো। এর পরই আসবে বিএমডব্লিউ, আউডি, লেক্সাস, শেভ্রোলে; তবে আমি লক্ষ করি গেল বছরের চাইতে এবছর মার্সিডিজের সংখ্যা কম, এবং আমি ভাবি, হাঙ্গেরীয়দের পছন্দের তালিকা থেকে মার্সিডিজ বাদ পড়ে গেল কেন? আমি ভেবে পাই না, তাই আবারও হাঁটতে থাকি। এরপর আসে ফোক্সওয়াগন, স্কোডা, ওপেল ও সুজুকিরা, এবং দ্রুতই আমি নিজেকে আবিষ্কার করি গরিবগুর্বোদের ব্যবহৃত সরু রাস্তার একটিতে, কেননা সেখানে দেখা যায় বিশাল, বেশিদামি পার্কিং লট ছাপিয়ে রাস্তার দুই পাশে দীর্ঘ, প্রায় অনিঃশেষ, সারি সারি পার্ক করে রাখা গাড়ির করুণ দৃশ্য; কারণ অংশত তাদেরকে সেই বিশাল, বেশিদামি পার্কিং লট থেকে বার করে দেওয়া হয়েছে, এবং তা আইনসিদ্ধভাবেই, যেন তারা সেখানকার শোভা বিনষ্ট করতে না পারে, আর অংশত তারা নিজেরাও, এই শোচনীয়, জংধরা, ক্ষতবিক্ষত প্যুজো, রেনো, ফোর্ড, টয়োটা, দাসিয়া, কিয়া, এমনকি মার্সিডিজও, অবশ্য কুড়ি বছরের চেয়েও বেশি পুরনো, তাদের গাড়িসমূহকে সেই বিশাল পার্কিং লটে পয়সার বিনিময়ে হলেও রাখার একটি ভদ্রস্থ জায়গা চায়, তার মানে তারাও নতুন ও চকচকে প্যুজো, রেনো, টয়োটা হয়ে উঠতে চায়, তবে কোনো অবস্থাতেই কুড়ি বছরের বেশি পুরনো মার্সিডিজ নয়; কিন্তু তারা তা হতে পারে না, কেননা তারা তো আসলে ভাঙারির দোকানের লোহা মাত্র, যা কেবল স্বপ্ন-দেখা গরিবদের ভাগ্যেই জোটে, এবং এই স্বপ্ন-দেখা গরিব মানুষগুলোর জীবনের সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল, তাদের আকাঙ্ক্ষারা বিএমডব্লিউ, আউডি, লেক্সাস-চড়া মানুষগুলোর স্বপ্নেরই মতো, অর্থাৎ সেসব সেই অন্য মানুষদের স্বপ্নগুলোর মতো একই উপাদানে তৈরি, কিন্তু তাদের জীবনের এমনই অভিশাপ যে, তারা কোনোদিন এই বড় পার্কিং লটগুলোতে ঢুকতে পারবে না, যার জন্য পয়সা গুনতে হয়, ফলত তাদের গাড়িসমূহ চিরকালের মতো বাইরে পড়ে থাকতে বাধ্য, ঐখানে ঐ রাস্তার দুই পাশে, ধুলার মধ্যে, এক চাকা ফুটপাথে তুলে দেওয়া, কিঞ্চিৎ কাত হয়ে থাকা, অনেকটা এই পুরো দেশটারই মতো, এতদ্বারা যার আশু ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করছি আমি, এই রবার্ট ভালজার।
আমার পা দুটো হাঁটার জন্য উপযুক্ত, কেননা আমি বহুদিন ধরে জুতো নয়, স্পোর্টিভা বুট ব্যবহার করছি, দেলাদিওর স্পোর্টিভা বুট হচ্ছে এতকাল যাবৎ নকশা করা সকল বুটের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, আমার মতো অনন্তকাল ধরে হাঁটার জন্য মজবুত, কেননা আমার পায়ের জুতোদের হতে হবে শক্তপোক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী; আর এখন আমি ক্যাথলিক, প্রোটেস্টান্ট, ইভাঞ্জেলিকাল ও অর্থডক্স কবরস্থান পেরিয়ে এসে হাঁটছি দীর্ঘদিনের অব্যবহৃত ইহুদি কবরখানার ভেতর দিয়ে, কেননা কোনো এক অজানা কারণে বছরের এই দিনটিতে তারা কবরখানার তালা খুলে দেয়, এবং আমি এর ভেতর দিয়ে হাঁটার আনন্দটুকু উপভোগ করি, কারণ আমি এই অননুকরণীয় স্পোর্টিভা বুটজোড়া পায়ে হাঁটতে ভালোবাসি, আমার পায়ের নিচে তারা এমন হালকা ও ভাসমান, এবং যেহেতু এখানে কোনো মিখায়েলমাস ডেইজি কিংবা মানুষ কিছুই নেই, কিছু নেই ঘৃণা করবার, তাছাড়া জায়গাটা খুব শান্তও, কেননা এই পাথরের নিচে নড়ে ওঠার মতো এমন কেউ নেই এখন, এবং স্পষ্টতই এখানে কোনো পুনরুত্থানেরও সুযোগ নেই, কেননা কবরগুলো সব আগাছায় ছেয়ে গেছে, কেবল এখানে ওখানে দুয়েকটা সমাধিফলক ছাড়া, যাদের গায়ে সপ্তাহান্তে ক্রমবর্ধমান নব্য-নাৎসিদের আঁকা স্বস্তিকাচিহ্ন, তারা এটা করছে কেবল একধরনের বিনোদনের উপায় হিসেবে, কেননা তারা কবরগুলোর গায়ে লাথি মারতে পারছে না, যেহেতু তারা ডন মার্টেনসের জুতো পরে ; আর আমি স্প্রিংয়ের সুখতলা আঁটা লা স্পোর্টিভা বুট পায়ে এগিয়ে চলি সমাধিফলকগুলো পেরিয়ে, তার নিচে সমাহিত মানুষগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে, যাদেরকে কেউ দেখতে আসে না, কেননা সেরকম কেউ আর অবশিষ্ট নেই, যদিও দ্রুতই এই মৃতদের দিনখানি ফুরিয়ে যাবে এবং নতুন দিনটিকে বরাদ্দ করে দেওয়া হবে ইয়ারসাইটদের জন্য, তার মানে আপনারা বুঝতেই পারছেন আমরা শীতের কাছাকাছি চলে এসেছি, আমি তাই হেঁটে চলি এবং ধীরে ধীরে তুষারপতন শুরু হয়, তুষারের বড় বড় ফালি, এবং আমি বরফের ওপর হেঁটে চলা আমার লা স্পোর্টিভা বুটজোড়াকে অনুভব করতে শুরু করি--- যদিও ঈশ্বর জানেন বিশ্ববিখ্যাত রবার্ট ভালসারের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই--- আর ঠিক তখনই আমার বুকে ব্যথা অনুভূত হতে থাকে, সত্যি বলতে কি আমার পুরো বুক জুড়েই ব্যথা শুরু হয়, এবং আমার পদক্ষেপ শ্লথ হয় না, বরং আরও দ্রুত হয় আচমকা এই ব্যথার কারণে, কদমসমূহ ক্রমেই ছোট হয়ে আসতে থাকে আমার তাড়াহুড়ার দরুণ, কিন্তু সবই বৃথা, আমি হাত নাড়াতে থাকি, দুলতে শুরু করি, মুখ থুবড়ে পড়ি এবং লম্বা হয়ে পড়ে থাকি--- আমার শরীর স্থির, আমার টুপি গড়িয়ে যায়, এই টুপি এবং আমার শরীরখানাই কেবল কিছুক্ষণ ধরে পড়ে থাকে তুষারের ওপর, এবং তার সঙ্গে অবশ্যই আমার পায়ের ছাপ, যতক্ষণ না তারা আমাকে খুঁজে পায় এবং অন্যত্র নিয়ে যায়, এবং দ্রুতই এমনকি সেই চমৎকার লা স্পোর্টিভা বুটের স্মরণীয় ছাপসমূহও গলে যেতে শুরু করে, কেননা বসন্ত এসে গেছে, এবং কেউই আমার হয়ে আর হাঁটবে না কোনোদিন।
__________________________________________________________________
তারা কেন বই পোড়াতে চায়; ইজেল সংখ্যা ১৪৭
৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫