‘পৃথিবীর সবচেয়ে নির্জন স্থান’: সেই বরফসাগর, যা অনুপ্রেরণা দিয়েছিল ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’- এর স্রষ্টাকে
ফ্রান্সের এই হিমবাহ গত দুই শতাব্দীতে অসংখ্য শিল্পকর্মের জন্ম দিয়েছে — যার মধ্যে রয়েছে মেরি শেলির কালজয়ী বিখ্যাত উপন্যাস- 'ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন'। চিত্রকলা, আলোকচিত্র এবং আধুনিক স্যাটেলাইট প্রযুক্তি দেখাচ্ছে, শেলি প্রথম যেদিন এই দৃশ্যে বিমোহিত হয়েছিলেন, তার পর থেকে স্থানটি কতটা নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। বিবিসি অবলম্বনে।
১৮০০ সালের দিকে ফ্রান্সের শ্যামনি শহরের ওপর আল্পস পর্বতমালার বুকে ছিল এক অনুপম দৃশ্য— "সি অব আইস" বা "বরফের সমুদ্র"। সেই দৃশ্য এর দর্শকদের একইসঙ্গে মুগ্ধ ও আতঙ্কিত করত। যারা পাথুরে পাহাড়ি পথে উঠে আসতেন, তারা দেখতে পেতেন সাদা, নীল ও সবুজাভ বরফে ঢাকা এক নির্জন প্রান্তর— যেন সময়ের মধ্যে জমে থাকা ঢেউ আর ঘূর্ণাবর্ত। চারপাশে শুধুই জমাট বরফ, যা দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। নির্জনতার সাথে হিমের এমন রাজত্ব যেন এক ভিন্ন জগতের চিত্র। সুন্দর অথচ হিম নরকের হাতছানি যেন।
সেই সময় বহু শিল্পী এই বরফসাগরের ছবি আঁকেন। তবে সবচেয়ে বিখ্যাত একটি ছবি হলো ১৮৫০-এর দশকে লেখক জন রাসকিনের এক সহকারীর তোলা এক বিষণ্ণ ড্যাগুয়েরোটাইপ আলোকচিত্র, যেটি উপরে দেখা যাচ্ছে।
'মার দে গ্ল্যাসি' নামের এই হিমবাহ, মূলত মঁ ব্লা পর্বতশ্রেণি থেকে নেমে আসা ঘন বরফের স্তূপ। এটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় গ্লেসিয়ার হিসেবে পরিচিত, এবং বৈজ্ঞানিকভাবে অধ্যয়ন করা প্রথম দিকের বরফনদীগুলোর একটি। আর নেমে আসা বরফের চাপেই এমন ঢেউখেলানো এবড়োথেবড়ো রূপ নেয় এটি।
দুঃখজনকভাবে, সময়ের পরিক্রমায় এর আয়তন এখন ভয়ানকভাবে সংকুচিত হয়েছে — ১৮০০ সালের মাঝামাঝি থেকে এটি প্রায় ২.৫ কিলোমিটার (১.৬ মাইল) গলে গেছে। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, রাসকিনের ছবির সেই একই স্থান থেকে এখন হিমবাহটি প্রায় দৃশ্যমানই নয়। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে হিমবাহের গলনপ্রক্রিয়া দ্রুততর হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, ২০৫০ সালের মধ্যে এটি আরও অন্তত ২ কিলোমিটার (১.২ মাইল) সরে যেতে পারে — এমনকি কার্বন নির্গমন নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের সরকারগুলো কঠোর পদক্ষেপ নিলেও তা আর রোধ করা যাবে না।
বরফের সঙ্গে শিল্প ও সাহিত্যের সম্পর্ক
বিশ্বজুড়ে গ্লেসিয়ারগুলো সাধারণত উপগ্রহ ও পরিমাপক যন্ত্রের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হয়। কিন্তু মার দে গ্ল্যাসি-এর বিশেষত্ব হলো— এর পরিবর্তনের ইতিহাস চিত্রকলা, আলোকচিত্র ও সাহিত্য সবখানেই লিপিবদ্ধ হয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বহু শিল্পী ও লেখক এই বরফসাগরের বিশালতায় বিস্মিত হয়েছেন।
তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত নাম মেরি শেলি। ১৮১৬ সালে, যখন ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন প্রকাশিত হয়নি, তখন মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি এই গ্লেসিয়ার দেখতে আসেন শেলি। এই ভ্রমণই পরবর্তীতে উপন্যাসটির এক গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যের অনুপ্রেরণা দেয়— যেখানে ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন প্রথমবার তার সৃষ্ট দানবের মুখোমুখি হয়।
মেরি শেলি ও তাঁর সমসাময়িকদের বর্ণনার সঙ্গে যুগে যুগে আঁকা চিত্র ও আলোকচিত্রের তুলনা করলে বোঝা যায়, একসময়ের মহিমাময় বরফসাগরটি কীভাবে ক্রমে বদলে গেছে।
১৮০০ সালের দিকে মার দে গ্ল্যাসি- এত বিশাল ছিল যে এটি প্রায় শ্যামনি উপত্যকার বসতিগুলোর কাছে এসে পৌঁছাত — যেমন দেখা যায় ১৮২০-এর দশকের এই ছবিতে:
সেই সময় ইউরোপজুড়ে "গ্র্যান্ড ট্যুর" নামে এক ভ্রমণ প্রচলিত ছিল, ইংল্যান্ড বা উত্তর ইউরোপের শিল্পী ও লেখকেরা ইতালি যাওয়ার পথে আল্পস পাড়ি দিতেন।
চার্লস ডিকেন্স ১৮৪৭ সালে এখানে এসে লিখেছিলেন, "শ্যামনির হিমবাহ এবং অন্যান্য দৃশ্য মানব কল্পনার সীমাকে অতিক্রম করে। প্রকৃতিতে এর চেয়ে মহিমান্বিত বা অভিভূতকর কিছু আমি ভাবতেও পারি না। যদি এখন আমি এটি নিয়ে লিখি, আমি বোধহয় পাগলের মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ব — এমন বিপুল অনুভূতি আমার ভেতরে ফুঁসছে।"
চিত্রশিল্পী জে.এম.ডব্লিউ. টার্নার ১৮০২ সালে মার দে গ্ল্যাসির দৃশ্য এভাবেই এঁকেছিলেন:
আর ১৮২৬ সালে, এক সুইস শিল্পী প্রায় একই দৃষ্টিকোণ থেকে—রেফিউজ দ্য মঁতাঁভের হোটেল থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তাকিয়ে—এই দৃশ্য আঁকেন, যা পরবর্তীতে রাসকিনের সহকারীর আলোকচিত্রের সঙ্গে মিলে যায়:
"এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে নির্জন স্থান"
১৮১৬ সালে— যা ইতিহাসে "গ্রীষ্মবিহীন বছর" নামে পরিচিত— মেরি, তাঁর সৎবোন ক্লেয়ার ক্লেয়ারমন্ট এবং হবু স্বামী কবি পার্সি শেলি রওনা হন বরফসাগরের দিকে। ঘোড়ায় চড়ে তারা বিপজ্জনক পাহাড়ি পথে অগ্রসর হন। এক জায়গায় খচ্চর পা পিছলে উপত্যকার কিনারায় গিয়ে পড়ে— অল্পের জন্য রক্ষা পান তারা।
যত উপরে উঠছিলেন, দৃশ্যপট ততই হচ্ছিল নির্জন ও ভয়ংকর — অবশেষে তারা পৌঁছান মঁতাঁভের, যেখানে তারা তারা হিমবাহের ওপর হাঁটেন।
মেরি তাঁর ডায়েরিতে লেখেন, "এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে নির্জন স্থান— চারদিকে বরফে মোড়া পর্বত, গাছপালার লেশমাত্র নেই, কেবল দূরে কিছু সবুজাভ দাগ। "বরফের ভেতর অনিয়মিত ফাটল তৈরি হয়েছে, যেগুলোর পাশের বরফে নীলাভ আভা, আর উপরের অংশ ধূসর-সাদা।"
তাঁর সঙ্গী পার্সি শেলিও সমান মুগ্ধ হন। তিনি লেখেন, "একটি সত্যিকারের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো বিস্ময়কর দৃশ্য।" তাঁর বর্ণনায়ই 'বরফের সমুদ্র' নামটির যথার্থতা মেলে— "এটি এমন এক দৃশ্য যেন কোনো বিশাল স্রোতের ঢেউ ও ঘূর্ণি হঠাৎ জমে গেছে… ঢেউগুলো পৃষ্ঠ থেকে ১২ থেকে ১৫ ফুট উঁচু, আর ফাটলগুলো এত গভীর যে তল দেখা যায় না, তাদের পাশের বরফ আকাশের চেয়েও নীল।"
এই ভ্রমণ পরবর্তীতে দুজনের সাহিত্য কর্মে প্রভাব ফেলে। পার্সি শেলির ক্ষেত্রে আল্পসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনুপ্রেরণা দেয় তাঁর বিখ্যাত কবিতা মঁ ব্লা (১৮১৬)-এর জন্য। আর মেরি শেলি তাঁর 'ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন'- এর এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে চরিত্রগুলোকে এই বরফসাগরের বুকে দাঁড় করান।
১৮১৮ সালের সংস্করণের দশম অধ্যায়ে উপন্যাসের নায়ক ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন শান্তির খোঁজে শ্যামনি উপত্যকায় আসে। গভীর অপরাধবোধে ভারাক্রান্ত সে তখন। ভাইয়ের খুন এবং এক নিরপরাধ মেয়ের মৃত্যুদণ্ডের দায়ে অপরাধবোধে জর্জরিত হয়ে ভিক্টর মার দে গ্ল্যাসিতে উঠে আশা করে, প্রকৃতির "গম্ভীর ও মহিমান্বিত সৌন্দর্য" তাঁর মন শান্ত করবে। বরফের সাগরের সামনে দাঁড়িয়ে সে লেখে— "এটি যেন এক উত্তাল সমুদ্র, যার ঢেউগুলো জমে আছে, গভীর ফাটলগুলো মৃত্যুর মতো নীরব।" কিন্তু ঠিক তখনই বরফের ওপারে সে দেখে, তাঁরই সৃষ্ট দানবটি তার দিকে এগিয়ে আসছে।
একবিংশ শতকের মার দে গ্ল্যাসি
২০২৩ সালের গ্রীষ্মে, বিবিসিতে প্রকাশিত এই নিবন্ধটির লেখক যখন শেলিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে গ্লেসিয়ারটি দেখতে যান, তখন দৃশ্যটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ট্রেনের টিকিট শেষ হয়ে যাওয়ায় তিনি পায়ে হেঁটে চড়াই পথ পাড়ি দেন। পাথুরে উপত্যকায় বরফগলিত পানির ফোয়ারা বয়ে চলেছে— কিন্তু কোথাও বরফের সাগর নেই।
যে উপত্যকাটি একসময় ফাটলভরা বরফসাগরে পরিপূর্ণ ছিল, এখন তা প্রায় ফাঁকা — কেবল ধুলোমাখা পাথরগুঁড়ো আর বরফগলা পানির সরু স্রোত বয়ে চলেছে।
দুই ঘণ্টা পর তিনি পৌঁছান মঁতাঁভেরসে—যেখানে একসময় শেলি দম্পতি দুপুরের খাবার খেয়েছিলেন এবং রাসকিনের সহকারী আলোকচিত্র তুলেছিলেন। উপত্যকার দিকে তাকিয়ে লেখক আশা করেছিলেন, অন্তত কোনো বরফের রেখা দেখতে পাবেন। কিন্তু সামনে কেবল অনুপস্থিতি—শূন্যতা।
তিনি লিখেছেন, আমি জানতাম জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমবাহ সরে গেছে, কিন্তু বাস্তবে দেখে চমকে উঠলাম কতটা গলে গেছে। বিশাল উপত্যকাটি এখন প্রায় উন্মুক্ত, বরফের সমুদ্রের জায়গায় এখন ধূসর গুঁড়ো পাথর আর ক্ষীণ জলধারা। হিমবাহটি এখনও আছে, কিন্তু এতদূর সরে গেছে যে এখন তা পাহাড়ের বাঁক পেরিয়ে চোখে পড়ে না।
পরে পুরনো আলোকচিত্র ও চিত্রকর্মের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি দেখেন— মাত্র এক শতাব্দী আগেও, ১৯২৬ সালে, এটি এখনো বরফে পরিপূর্ণ ছিল।
কিন্তু ২০০০ সালের পর গলন দ্রুততর হয়। ২০১৪ সালের ছবিতে দেখা যায়, হিমবাহ অনেক নিচে নেমে এসেছে, ফাটলগুলো মসৃণ হয়ে গেছে। সেই সময়ের দৃশ্যটি এমন:
২০১৮ সালে শিল্পী এমা স্টিবন একই স্থান থেকে সায়ানোটাইপ কৌশলে নতুন ছবি আঁকেন— রাসকিনের ১৮৫০-এর আলোকচিত্রের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল দেখানো, কীভাবে দুই শতাব্দীতে বরফের এই রাজ্য বিলীন হয়ে গেছে।
আর সবশেষে ২০২৩ সালে লেখকের নিজের তোলা ছবিতে দেখা যায়— বরফের সাগর আর নেই। সেখানে এখন নেমে যেতে হয় কেবল তারে ঝুলন্ত ক্যাবল কারে, যা ২০২৪ সালে পর্যটকদের জন্য চালু করা হয়:
বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যদ্বাণী করছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে হিমবাহটি আরও ২ কিলোমিটার সংকুচিত হতে পারে— প্রায় একই দূরত্ব, যা শেলির সফর থেকে ২১ শতকের শুরু পর্যন্ত হারিয়েছে।
বিজ্ঞানীরা আগামী শতকের জন্য হিমবাহটির অবস্থানের মডেল তৈরি করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইউরোপে গ্রীষ্ম ক্রমেই উষ্ণ হচ্ছে, গলে যাচ্ছে হিমবাহগুলো। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে, ২০৯৯ সালের মধ্যে এটি সম্পূর্ণ বিলীনও হয়ে যেতে পারে।
'ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন' উপন্যাসে যখন ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন মার দে গ্ল্যাসি-তে আসে, নিজের সৃষ্ট দানবের জন্য অনুতপ্ত হয়ে, সে সেই দৃশ্যকে বর্ণনা করে এমনভাবে, যেমনটা মেরি শেলি নিজেই ১৮১৬ সালে দেখেছিলেন:
"বরফের সমুদ্র, বা বরং এক বিশাল বরফনদী, পাহাড়ের কোলে ঘুরে গেছে—তার ওপরে ঝুলে আছে আকাশছোঁয়া চূড়াগুলো, রোদে ঝলমল করছে তাদের বরফের মুকুট। আমার মন, যা এতক্ষণ ভারাক্রান্ত ছিল, এখন অজানা আনন্দে ভরে উঠল।"
কিন্তু আজ যদি মেরি শেলি জীবিত থাকতেন, তাহলে সেই দৃশ্য হয়তো তাকে শিহরিত করত অন্য কারণে— কারণ এখন আর নেই সেই বরফের সমুদ্র, আছে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম ছাপ। প্রকৃতির নয়, মানুষের তৈরি এক ভয়াবহ, দানবীয় ভূদৃশ্য। চাক্ষুষ এ পরিবর্তন বলে দেয়, সাহিত্যের দানবের চেয়েও কত ভয়াবহ হয় মানুষের সৃষ্টি সত্যিকারের ভয়ঙ্কর।
