মাইক্রোসফটের গবেষণা: এআই ঝড়ে বিপন্ন যেসব পেশা, আপনার চাকুরি সুরক্ষিত তো?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের হচ্ছে অবিশ্বাস্য উন্নতি। আর তা-ও যেন হচ্ছে চোখের পলকে। নিত্যনতুন আরো শক্তিশালী এআই বাজারে আনার এক প্রতিযোগিতায় মত্ত বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলো। উন্নত এসব এআই মানুষের কর্মক্ষেত্রেও ভাগ বসাচ্ছে, বিশেষত ঝুঁকি বাড়ছে বুদ্ধিবৃত্তিক পেশাগুলোতে।
এই বাস্তবতায়, বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট তাদের গবেষণা বিভাগ থেকে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক গবেষণাপত্রে জানিয়েছে—কোন ৪০টি পেশা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই- এর কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।
প্রকাশিত তালিকায় রয়েছে সাংবাদিকতা, অনুবাদকর্ম, গ্রাহকসেবা, বিক্রয় প্রতিনিধি, লেখক, সম্পাদক, গণযোগাযোগ—এমন অনেক পেশা, যা মূলত ভাষা, বিশ্লেষণ, গবেষণা ও যোগাযোগ নির্ভর। এই তালিকাটি আপাতদৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজারকে ঘিরে তৈরি হলেও, গবেষকরা মনে করছেন—বিশ্বের উন্নত এবং উন্নয়নশীল প্রতিটি দেশেই একই ধরনের প্রভাব পড়বে, যদি না কঠোর আন্তর্জাতিক নীতিমালা তৈরি করা হয়।
কী বলছে মাইক্রোসফটের গবেষণা?
মাইক্রোসফটের সিনিয়র রিসার্চার কিরান টমলিনসন বলেন, "আমাদের গবেষণায় আমরা দেখেছি, কোন কোন পেশা এআই চ্যাটবটের সাহায্যে আরও কার্যকরভাবে পরিচালনা করা যায়। এতে এআইয়ের প্রাসঙ্গিকতার স্কোর নির্ধারণ করা হয়েছে—এআই কতোটা দক্ষভাবে সেই পেশার কাজ করে দিতে পারে, তা বিবেচনায় নিয়ে।"
তবে টমলিনসনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী—এই গবেষণার উদ্দেশ্য কোনও পেশা "সম্পূর্ণ বিলুপ্ত" হয়ে যাবে তা বলা নয়, বরং কীভাবে এআই সেই পেশাগুলোকে পাল্টে দিতে পারে, তা বোঝা।
বাস্তবতা আরও নির্মম: কর্মী ছাঁটাই চলছে পুরোদমে
এ কথা সত্য যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) যেভাবে নির্দিষ্ট পেশায় দক্ষতা দেখাচ্ছে, তাতে সেই কাজগুলোয় মানুষের প্রয়োজনীয়তা কমে যাচ্ছে। মাইক্রোসফট নিজেই ২০২৫ সালের মধ্যেই ১৫ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে, যাদের অনেকের কাজ এআই দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে এআইয়ের বিস্তার নিয়ে সাবেক মাইক্রোসফট সিইও বিল গেটস নিজেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, এআই যদি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে প্রসারিত হতেই থাকে, তাহলে সমাজে বিপুল কর্মহীনতা ও বৈষম্য তৈরি হতে পারে।
যে ৪০টি পেশা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে
মাইক্রোসফটের গবেষণায় এআই-এর 'প্রয়োগযোগ্যতা' স্কোরের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে শীর্ষ ৪০টি পেশার র্যাংকিং যেখানে মানবকর্মীকে ব্যাপকভাবে প্রতিস্থাপন করতে পারে এই প্রযুক্তিটি:
পেশা যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিস্থাপিত চাকুরির সংখ্যা
অনুবাদক ৫১,৫৬০
ইতিহাসবিদ ৩,০৪০
উড়োজাহাজের কেবিন ক্রু ২০,১৯০
বিক্রয় প্রতিনিধি ১১,৪২,০২০
লেখক ও কলামিস্ট ৪৯,৪৫০
কাস্টমার সার্ভিস ২৮,৫৮,৭১০
এছাড়া অন্যান্য পেশার মধ্যে সিএনসি টুল প্রোগ্রামার, টেলিফোন অপারেটর, টিকিট ও ট্রাভেল ক্লার্ক, রেডিও বা টেলিভিশনের উপস্থাপক, সাংবাদিক/প্রতিবেদক, টেকনিক্যাল রাইটার, প্রুফরিডার, সম্পাদক, গণসংযোগ কর্মকর্তা, পরিসংখ্যান সহকারী, ওয়েব ডেভেলপার, মার্কেট রিসার্চ, পরিসংখ্যানবিদ, আর্থিক উপদেষ্টার মতো চাকুরি রয়েছে। মূলত এসব পেশাতেই শুরুর ধাক্কাটা দিয়েছে এআই।
এই পেশাগুলো মূলত ডিজিটাল ও ভাষাভিত্তিক। আর এসব পেশাজীবীদের যেসব কাজ, তা এলএলএম বা লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল-ভিত্তিক চ্যাটবট যেমন চ্যাটজিপিটি খুব সহজেই করে ফেলতে পারে।
যেসব পেশা এখনো তুলনামূলক নিরাপদ
মাইক্রোসফট বলছে, যেসব পেশা এখনও এআইয়ের প্রয়োগযোগ্যতা কম, সেগুলো সাধারণত শারীরিক উপস্থিতি ও কায়িক শ্রম নির্ভর। যেমন: ফ্লোর স্যান্ডার ও ফিনিশার, ম্যাসেজ থেরাপিস্ট, নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট, সার্জন, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট অপারেটর, গ্লাস মেরামতকারী, সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ কর্মী, হাসপাতালের অডারলি ইত্যাদি।
এগুলোর বেশিরভাগই এখনও রোবট বা এআই সিস্টেম দ্বারা পুরোপুরি প্রতিস্থাপনযোগ্য নয়।
বাংলাদেশে প্রভাব কেমন হতে পারে?
বাংলাদেশে ইতোমধ্যে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে এআই চ্যাটবট, অটোমেশন সফটওয়্যার এবং কনটেন্ট জেনারেটর ব্যবহার শুরু হয়েছে। বিশেষ করে বিপিও, কাস্টমার সার্ভিস, সাংবাদিকতা, অনুবাদকর্ম, মার্কেটিং—এই খাতে এআই দ্রুত মানবশক্তিকে প্রতিস্থাপন করতে শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই যদি সরকার এআই ব্যবহার ও শ্রমনীতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট আইন না করে, তাহলে মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত যুবসমাজের বড় অংশ চাকুরির সংকটে পড়বে।
তবে শুধু ধ্বংস নয়, এআই সম্ভাবনার দ্বারও খুলছে
এআই যেমন বিপুল কর্মসংস্থান ধ্বংস করতে পারে, তেমনি নতুন পেশাও তৈরি করছে—এআই প্রম্পট ইঞ্জিনিয়ার, ডেটা অ্যানালিস্ট, রোবোটিক অপারেটর, এথিকস রিসার্চার ইত্যাদি পেশার এখন দারুণ চাহিদা। আর তা আগামীতে আরও বাড়তে পারে। একই সঙ্গে এটি মেডিকেল গবেষণা, কৃষি প্রযুক্তি, শিক্ষা, ও দুর্যোগ পূর্বাভাস খাতেও বিপ্লব আনতে পারে।
@চাকুরির ভবিষ্যৎ কোনপথে
স্বভাবতই কৌতূহল জাগে, একটা সময়ে এআই কি মানুষের চাকুরি ধ্বংস করে ফেলবে, নাকি নতুন রূপে কর্মসংস্থান তৈরি করবে? হয়তো তার ওপরই নির্ভর করবে আমরা কি একটি "সর্বজনীন ন্যূনতম আয়" ভিত্তিক সমাজের দিকে যাব, নাকি সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্র 'টার্মিনেটর' বা 'ম্যাট্রিক্স'-এর মতো ভবিষ্যৎ পৃথিবী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে?
বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এআইয়ের প্রভাব মোকাবিলা ও এটি রপ্ত করতে কৌশলগত প্রস্তুতি নেওয়ার এখনই সময়, যাতে এআই মানুষের জন্য প্রযুক্তি হয়ে ওঠে—মানুষকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য নয়।