যেভাবে মাত্র ৩২ সেকেন্ডে বিধ্বস্ত হলো এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ১৭১

গত ১২ জুন আহমেদাবাদ বিমানবন্দরের কাছে হাসপাতালের ভবনে বিধ্বস্ত হয় এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৮৭ সিরিজের ড্রিমলাইনার বিমান। এতে বিমানের ২৪১ জন যাত্রী ও ক্রু এবং নিচে থাকা আরও ১৯ জনের মৃত্যু হয়। কেবল একজন যাত্রী প্রাণে বেঁচে যান।
এ দুর্ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারত—বলা হয়েছে মাত্র ৩২ সেকেন্ডের ভেতরেই সব শেষ হয়ে গিয়েছিল।
প্রতিবেদন অনুসারে, বিমানটি উড্ডয়নের পরপরই এর দুটি ফুয়েল কন্ট্রোল সুইচ দ্রুত 'কাটঅফ' অবস্থানে চলে যায়। এর ফলে ইঞ্জিনে জ্বালানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং তাৎক্ষণিকভাবে বিমানটি সব 'থ্রাস্ট' বা উড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলে।
এই সুইচ দুটি ককপিটের মাঝামাঝি অংশে থ্রাস্ট লিভারের ঠিক নিচে অবস্থিত। এগুলো সাধারণত মাটিতে থাকা অবস্থায় ইঞ্জিন চালু বা বন্ধ করতে ব্যবহৃত হয়, কিংবা আকাশে উড্ডয়নের সময় ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দিলে তা বন্ধ করতে ব্যবহার হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে জানানো হয়, এই ফুয়েল কন্ট্রোল সুইচে বসানো আছে স্প্রিং-লোডেড লকিং সিস্টেম, যা তাদের নিজ অবস্থানে আটকে রাখে এবং দুর্ঘটনাবশত সরানো থেকে রক্ষা করে। 'রান' থেকে 'কাটঅফ' অবস্থায় নিয়ে যেতে হলে সুইচটি আগে টেনে তুলতে হয়—অর্থাৎ একাধিক ধাপ ছাড়া এ সুইচ সরানো সম্ভব নয়।

বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের সুইচ দুর্ঘটনাবশত চালু বা বন্ধ হওয়ার সুযোগ নেই। আর একবার সুইচ 'কাটঅফ'-এ চলে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ইঞ্জিন শক্তি হারিয়ে ফেলে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিমানটির উড্ডয়নের আগপর্যন্ত সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চলছিল। কিন্তু আকাশে ওঠার ৩২ সেকেন্ডের মধ্যেই একের পর এক বিপর্যয় ঘটে—ফুয়েল সুইচ বন্ধ হয়ে যাওয়া, ইমার্জেন্সি পাওয়ার ইউনিট চালু হওয়া এবং ইঞ্জিন আবার চালু করার চেষ্টা—সবই এই অল্প সময়ের মধ্যেই ঘটে।



বিমান বিধ্বস্তের ২৯ সেকেন্ড আগে
(উড্ডয়নের ৩ সেকেন্ড পর)
বিমানটি সর্বোচ্চ রেকর্ডকৃত গতি
১৮০ নটস (প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৩৩৩ কিমি) অর্জন করে।
এর পরপরই বাম ইঞ্জিনের ফুয়েল কন্ট্রোল সুইচ 'রান' থেকে 'কাটঅফ' অবস্থায় চলে যায়। এবং ১ সেকেন্ড পর ডান ইঞ্জিনের ফুয়েল কন্ট্রোল সুইচও 'রান' থেকে 'কাটঅফ' অবস্থায় চলে যায়।

তদন্ত প্রতিবেদনে সুইচ দুটি কীভাবে সরানো হয়েছিল, তা উল্লেখ করা হয়নি। জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় ইঞ্জিনের শক্তি কমতে থাকে।
ককপিটে বিভ্রান্তি
এক পাইলটকে অপর পাইলটকে জিজ্ঞাসা করতে শোনা যায়—'তুমি কেন কাটঅফ করলে?'
অপর পাইলট বলেন, তিনি এটি করেননি।
এই কথোপকথনে কোনো পাইলটের পরিচয় প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।
বিমান বিধ্বস্তের ২৪ সেকেন্ড আগে
(উড্ডয়নের ৮ সেকেন্ড পর)
র্যাম এয়ার টারবাইন (র্যাট) বিমানকে হাইড্রলিক শক্তি সরবরাহ করতে শুরু করে। উড্ডয়ন ও ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার পরপরই এটি সক্রিয় হয়ে যায়।

র্যাম এয়ার টারবাইন (আরএটি) হলো বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনারের নিচের অংশ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বের হওয়া ছোট একটি প্রপেলার। এটি মূলত জরুরি পরিস্থিতিতে ব্যাকআপ জেনারেটরের কাজ করে। ফ্লাইট চলাকালে যদি উভয় ইঞ্জিন শক্তি হারায়, কিংবা তিনটি হাইড্রোলিক সিস্টেমই যদি সংকটজনকভাবে চাপ হারায়, তখন এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় হয়ে সীমিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করে—যার মাধ্যমে ফ্লাইট সিস্টেম সচল রাখা যায়।
বিমান বিধ্বস্তের ১৯ সেকেন্ড আগে
(উড্ডয়নের ১৩ সেকেন্ড পর)
বাম ইঞ্জিনের ফুয়েল কাটঅফ সুইচ 'কাটঅফ' থেকে 'রান' অবস্থায় ফিরে আসে।

বিমান বিধ্বস্তের ১৭ সেকেন্ড আগে
(উড্ডয়নের ১৫ সেকেন্ড পর)
স্বয়ংক্রিয়ভাবে অক্সিলিয়ারি পাওয়ার ইউনিট (এপিইউ)-এর এয়ার ইনলেট ডোর খোলা শুরু হয়

এপিইউ হলো বিমানের লেজে অবস্থিত একটি ছোট গ্যাস টারবাইন ইঞ্জিন। জরুরি মুহূর্তে বা মূল ইঞ্জিন বন্ধ থাকলে এপিইউ বিমানের বিভিন্ন সিস্টেম সচল রাখতে প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে।
বিমান বিধ্বস্তের ১৫ সেকেন্ড আগে
(উড্ডয়নের ১৭ সেকেন্ড পর)
ডান ইঞ্জিনের ফুয়েল কাটঅফ সুইচ 'কাটঅফ' থেকে 'রান' অবস্থায় ফিরে আসে

ফুয়েল কন্ট্রোল সুইচ 'কাটঅফ' থেকে 'রান'-এ ফেরালে ইঞ্জিনগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনরায় চালু হওয়া শুরু করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পর ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ইঞ্জিনের এক্সহস্ট গ্যাসের তাপমাত্রা বাড়তে দেখা যায়—যা ইঞ্জিন পুনরায় চালু হওয়ার লক্ষণ। বাম ইঞ্জিনের গতি কমে যাওয়া থেমে যায় এবং তা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার চেষ্টা করে।
ডান ইঞ্জিনটিও জ্বলে উঠলেও তা নিজের গতি ধরে রাখতে পারেনি। একাধিকবার জ্বালানি সরবরাহ করে ইঞ্জিনটিকে সচল রাখার চেষ্টা করা হলেও তাতে কার্যকর ফল মেলেনি।
বিমান বিধ্বস্তের ৬ সেকেন্ড আগে
(উড্ডয়নের ২৬ সেকেন্ড পর)
একজন পাইলট "মেডে মেডে মেডে" সংকেত পাঠান, যা একটি প্রাণঘাতী পরিস্থিতিতে ব্যবহৃত হয়।
এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার জিজ্ঞাসা করলেও কোনো পাইলটের কাছ থেকে উত্তর পাননি, এরপর তিনি বিমানটিকে বিমানবন্দরের সীমানার বাইরে বিধ্বস্ত হতে দেখেন।
স্থানীয় সময় দুপুর ১টা ৩৯ মিনিট ১১ সেকেন্ড
বিমানের ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
দুর্ঘটনাস্থল
বিমানটি রানওয়ের প্রান্ত থেকে প্রায় ১ দশমিক ৬ কিলোমিটার দূরে বিজে মেডিকেল কলেজের হোস্টেল ভবনে আঘাত হানে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ধ্বংসাবশেষ প্রায় ৩৭,০০০ বর্গমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
নিচের চিত্র অনুযায়ী পাঁচটি ভবনে আঘাত লাগে এবং সেগুলো বড় ধরনের কাঠামোগত ও অগ্নিসংযোগজনিত ক্ষতির শিকার হয়।
বিধ্বস্তের স্থান থেকে উভয় ফুয়েল সুইচ 'রান' অবস্থায় পাওয়া যায়।

ভারতের এয়ারক্রাফট অ্যাকসিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো এই দুর্ঘটনার তদন্ত পরিচালনা করছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন এক বছরের মধ্যে প্রকাশিত হওয়ার কথা রয়েছে।
ইলাস্ট্রেশন: রয়টার্স