ট্রাম্প ইরানে হামলা করলে যুক্তরাষ্ট্র যে ধরনের বোমা ব্যবহার করতে পারে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ইরানের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য লড়াইয়ের জন্য মধ্যপ্রাচ্য এবং বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত সামরিক সম্পদ ব্যবহার করতে পারেন।
ট্রাম্পের হাতে রয়েছে ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাসম্পন্ন জিবিইউ-৫৭ বোমা, দীর্ঘপাল্লার স্টেলথ বোমারু বিমান, একটি বিমানবাহী রণতরী স্ট্রাইক গ্রুপ, নৌবাহিনীর ডেস্ট্রয়ার ও মার্কিন সেনাবাহিনী। ইসরায়েলের সমর্থনে যদি ট্রাম্প সরাসরি হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেন, তবে এগুলো তাকে একাধিক বিকল্প দেবে। এর মধ্যে কিছু অস্ত্র যেমন, বি-২ বোমারু বিমান যুক্তরাষ্ট্রেই রয়েছে, তবে অন্যগুলো ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে পৌঁছেছে বা পথে রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ইরানবিরোধী সংঘাতে আরও জড়িয়ে পড়বে কিনা, ইসরায়েলকে কেবল বিমান হামলা প্রতিহত করতে সহায়তার বাইরেও যাবে কিনা—তা এখনও অনিশ্চিত। মঙ্গলবার (১৭ জুন) বিকেলে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের সিচুয়েশন রুমে তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন।
তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ড অঞ্চলে সামরিক শক্তি জড়ো করা হচ্ছে। সেখানে এরই মধ্যে যে নৌ ও বিমান বাহিনী রয়েছে, তা ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
ইতোমধ্যে ইরান কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় হামলার শিকার হয়েছে। ইসরায়েলের হামলায় দেশটির পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এবং শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নিহত হয়েছেন। তবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে, এক বিশেষ ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র।
এই অস্ত্রের নাম ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনেট্রেটর (এমওপি), যা 'বাংকার বাষ্টার' নামে পরিচিত। ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের এই জিপিএস-নির্দেশিত বোমা বিশ্বের সবচেয়ে বড় নিখুঁত-লক্ষ্যভেদী অস্ত্র। বোয়িং কোম্পানির তৈরি এই বোমাটিকে বহুবার তেহরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে কার্যকর একমাত্র অস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। বিশেষ করে ফোরদোর গভীর ভূগর্ভস্থ সমৃদ্ধকরণ স্থাপনাকে ধ্বংস করার ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে উপযুক্ত বলে মনে করা হয়।
ফোরদো স্থাপনাটি একটি পাহাড়ের নিচে, আনুমানিক ৬০ থেকে ৯০ মিটার গভীরে অবস্থিত। অনেক বিশ্লেষকের মতে, কেবল এমওপি দিয়েই এই স্থাপনাকে কার্যকরভাবে ধ্বংস করা সম্ভব, এবং এই অস্ত্র শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছেই রয়েছে।
লেক্সিংটন ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক রেবেকা গ্রান্ট বলেন, প্রতিটি বাংকার বাষ্টার আলাদাভাবে লক্ষ্য করে ফেলা যায় এবং একটির ওপর আরেকটি ফেলাও সম্ভব। তার মতে, ড্রোন নজরদারি ব্যবহার করে শেষ মুহূর্তে আঘাতের স্থান আরও নিখুঁতভাবে নির্ধারণ করা যেতে পারে। তিনি আরও জানান, ফোরদোসহ ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে আসছে।
এই বোমা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত ট্রাম্পের জন্য অন্যতম কঠিন সিদ্ধান্ত হতে পারে। কারণ, এতে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি সামরিক অভিযানে জড়িয়ে পড়বে, যা ইরানের পারমাণবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণেও প্রভাব ফেলতে পারে।
সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও উপপ্রতিরক্ষা সচিব ড্যানিয়েল শাপিরো বলেন, 'ইসরায়েল যদি নিজের অপারেশনের মাধ্যমে এটি করতে পারে, সেটিই হবে সবচেয়ে ভালো। তবে যদি ফোরদোতে আঘাত হানতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ প্রয়োজন হয়, তবে ট্রাম্পের টেবিলে সেই বিকল্পও থাকতে হবে।'
স্টেলথ বোমারু বিমান
এমওপি ব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হলো বি-২ স্টেলথ বোমারু বিমান, যা দুটি করে এই বোমা বহনে সক্ষম। এই বিমান মিসৌরির হোয়াইটম্যান এয়ার ফোর্স বেস থেকে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ইরানের অভ্যন্তরে এই অস্ত্র নিয়ে আঘাত হানতে পারবে।
গত অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র এই বি-২ বিমান ব্যবহার করে ইরান-সমর্থিত হুথি গোষ্ঠীর ভূগর্ভস্থ অস্ত্রাগারে বোমাবর্ষণ করেছিল। এ বছরের শুরুর দিকে ভারত মহাসাগরের দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপে ছয়টি বি-২ বিমানকে রানওয়েতে দেখা যায়। এটিকে অনেকেই ইরান ও হুথিদের উদ্দেশে একটি বার্তা বলে মনে করেছিলেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী জানিয়েছে, মে মাসে ওই সব বিমান তাদের ঘাঁটিতে ফিরে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইরান হামলার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখবে সেন্ট্রাল কমান্ড ও নৌবাহিনী
মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি দেখভালের দায়িত্বে থাকা সেন্ট্রাল কমান্ড ইরানের বিরুদ্ধে যেকোনো অভিযানে মূল ভূমিকা পালন করবে। এই কমান্ডের আওতায় রয়েছে মিশর, জর্ডান, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বহু দেশে ছড়িয়ে থাকা বাহিনী এবং সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা।
প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ সেন্ট্রাল কমান্ডে অতিরিক্ত সামরিক শক্তি মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছেন। এক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তার বরাতে জানা গেছে, প্রশাসন কেসি-১৩৫ এবং আধুনিক কেসি-৪৬ এয়ার রিফুয়েলিং ট্যাংকারের ২০টি ইউনিট গোপন স্থানে পাঠাচ্ছে। এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বহরকে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে সহায়তা করবে।
সেন্ট্রাল কমান্ডের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, মেরিন কোর ও নৌবাহিনীর ৪০-৪৫ হাজার সদস্য মোতায়েন রয়েছে। নৌবাহিনীর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এই বাহিনী ইরানে সম্ভাব্য মার্কিন হামলায় যুক্ত হতে পারে। ইতোমধ্যে ইসরায়েলকে ইরানের পাল্টা হামলা থেকে রক্ষা করতেও মার্কিন নৌবাহিনী ভূমিকা রাখছে।
ইউএসএস কার্ল ভিনসন বিমানবাহী রণতরী গত সাত মাস ধরে আরব সাগর এলাকায় অবস্থান করছে। নৌবাহিনীর তথ্যমতে, এতে রয়েছে প্রায় ৩ হাজার নাবিক এবং ২ হাজার জনের একটি এয়ার উইং।
এই এয়ার উইং-এ রয়েছে ব্যাপক সামরিক সরঞ্জাম। এর মধ্যে রয়েছে এফ-৩৫ ও এফ-১৮ ফাইটার জেট, শত্রুপক্ষের রাডার ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে হামলা চালাতে সক্ষম ইএ-১৮ বিমান, দ্রুত হুমকি শনাক্তে সক্ষম ই-২ডি রাডার বিমান, সেই সঙ্গে রয়েছে অসপ্রে টিল্ট্রটর বিমান ও সি হক হেলিকপ্টার।
এই রণতরী গ্রুপে আরও রয়েছে একটি গাইডেড-মিসাইল ক্রুজার ইউএসএস প্রিন্সটন এবং কয়েকটি গাইডেড-মিসাইল ডেস্ট্রয়ার। বর্তমানে ইউএসএস নিমিটজ এর নেতৃত্বাধীন আরেকটি স্ট্রাইক গ্রুপ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অবস্থান করছে এবং এটি কার্ল ভিনসনকে প্রতিস্থাপন করতে প্রস্তুত।
পূর্ব ভূমধ্যসাগরে নৌবাহিনীর তিনটি এইজিস ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস আর্লেই বার্ক, ইউএসএস দ্য সুলিভানস ও ইউএসএস থমাস হাডনার মোতায়েন রয়েছে। আরও দুটি জাহাজ শিগগিরই এতে যুক্ত হবে বলে জানিয়েছেন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা। এ ছাড়া, রেড সি-তেও যুক্তরাষ্ট্রের দুটি ডেস্ট্রয়ার মোতায়েন রয়েছে।
একজন মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গত সপ্তাহের শেষে আর্লেই বার্ক ও দ্য সুলিভানস থেকে ইসরায়েল রক্ষায় বহু এসএম-৩ অ্যান্টি-ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। অন্য এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইরানীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট থাড প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করে থাকে।