১ লাখ ডলারের এইচ-১বি ভিসা: যে কারণে ভারতের চেয়েও বেশি ক্ষতি হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের

শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর) মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দক্ষ কর্মীদের ভিসার (এইচ-১বি) ফি এক লাফে ৫০ গুণ বাড়িয়ে এক লাখ ডলার করার ঘোষণা দিলে প্রযুক্তি জগতে তীব্র আলোড়ন তৈরি হয়। এতে আতঙ্কে সিলিকন ভ্যালির অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের দেশ ছাড়তে বারণ করে, বিদেশি কর্মীরা তড়িঘড়ি করে বিমানের টিকিট কাটেন, আর হিমশিম খেতে থাকেন অভিবাসন আইনজীবীরা।
পরদিন হোয়াইট হাউস পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যাখ্যা দেয় যে এই ফি কেবল নতুন আবেদনকারীদের জন্য এবং এককালীন দিতে হবে। তবে সমালোচিত হলেও বৈশ্বিক প্রতিভা টানার জন্য খ্যাত এইচ-১বি ভিসা কর্মসূচির ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত।
১৯৯০ দশক থেকে শুরু হওয়া এই ভিসা কার্যত যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয়দের স্বপ্নপূরণের সোপান হয়ে ওঠে। এর মাধ্যমে কোটি ভারতীয় পরিবার মধ্যবিত্তের কাতারে উঠে আসে, নতুন জীবনযাত্রার সুযোগ তৈরি হয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রও বিপুল মেধা ও দক্ষ কর্মী পেয়েছে, যারা গবেষণাগার, শ্রেণিকক্ষ, হাসপাতাল থেকে শুরু করে স্টার্টআপ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাতে অবদান রেখেছে। বর্তমানে ভারতীয় বংশোদ্ভূত নির্বাহীরাই গুগল, মাইক্রোসফট ও আইবিএম পরিচালনা করছেন। মার্কিন চিকিৎসক সমাজে প্রায় ৬ শতাংশ ভারতীয় ডাক্তার।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এইচ-১বি ভিসা পাওয়া কর্মীদের মধ্যে ৭০ শতাংশেরও বেশি ভারতীয়। চীনের অবস্থান দ্বিতীয়, প্রায় ১২ শতাংশ। ২০১৫ সালে তথ্য অধিকার আইনে পাওয়া নথি অনুযায়ী, 'কম্পিউটার' সংক্রান্ত চাকরির ৮০ শতাংশই পেয়েছেন ভারতীয়রা। চিকিৎসা খাতেও এর গুরুত্ব স্পষ্ট।
২০২৩ সালে সাধারণ চিকিৎসা ও সার্জিক্যাল হাসপাতালে কাজের জন্য ৮ হাজার ২০০'রও বেশি এইচ-১বি ভিসা অনুমোদন পেয়েছে। আন্তর্জাতিক ডাক্তারদের মধ্যে ভারতীয়দের অংশ প্রায় ২২ শতাংশ। হিসাব অনুযায়ী মার্কিন চিকিৎসকদের ৫ থেকে ৬ শতাংশই ভারতীয় এইচ-১বি ভিসাধারী।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের নতুন ফি নীতিমালা বাস্তবসম্মত নয়। ২০২৩ সালে নতুন এইচ-১বি কর্মীদের গড় বেতন ছিল ৯৪ হাজার ডলার, যেখানে পুরোনোদের গড় আয় ১ লাখ ২৯ হাজার ডলার। অর্থাৎ নতুন যারা যুক্ত হবেন, তারা ফি দেওয়ার মতো আয়ই করবেন না।
নিক্সকেন সেন্টারের অভিবাসন নীতি বিশ্লেষক গিল গুয়েরা বিবিসিকে বলেন, 'হোয়াইট হাউসের সর্বশেষ নির্দেশনায় ফি কেবল নতুন ভিসাধারীদের জন্য প্রযোজ্য বলা হয়েছে। এতে তাৎক্ষণিক প্রভাব না পড়লেও মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে শ্রমঘাটতি তৈরি হবে।'
ভারত প্রথম ধাক্কা খেলেও যুক্তরাষ্ট্রে এর অভিঘাত আরও গভীর হতে পারে। কারণ টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস (টিসিএস), ইনফোসিসের মতো ভারতীয় আউটসোর্সিং কোম্পানিগুলো আগে থেকেই স্থানীয় কর্মী তৈরি ও কাজ স্থানান্তরের প্রস্তুতি নিয়েছিল।
এখনও এইচ-১বি প্রাপ্তদের ৭০ শতাংশ ভারতীয়। পিউ রিসার্চের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে শীর্ষ ১০ নিয়োগদাতার মধ্যে ৩টির সঙ্গে ভারতের যোগসূত্র ছিল—যেখানে ২০১৬ সালে সংখ্যা ছিল ৬।
তবে এটিও সত্য, ভারতের ২৮৩ বিলিয়ন ডলারের আইটি খাতও বড় ধরনের ধাক্কা খেতে যাচ্ছে। কারণ তাদের অর্ধেকেরও বেশি আয়ের যোগান যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকেই আসে।
ভিসা ফি বাড়ালে প্রকল্পে ভাঙন, বিপাকে পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্রও
ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প সংস্থা ন্যাসকম-এর মতে, এই ভিসা ফি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত 'কিছু অনশোর (যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক) প্রকল্পের ব্যবসায়িক ধারাবাহিকতা ব্যাহত' করতে পারে। আইনি অনিশ্চয়তা কেটে না যাওয়া পর্যন্ত ক্লায়েন্টরা নতুন করে দরকষাকষি বা প্রকল্প বিলম্বিত করতে পারে। একই সঙ্গে কোম্পানিগুলো কর্মী ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে পারে যেমন, কাজ সরিয়ে নেওয়া হতে পারে অফশোরে, যুক্তরাষ্ট্রে সরাসরি নিয়োগ কমানো হতে পারে, আর স্পন্সরশিপ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো আরও কঠোর হয়ে উঠতে পারে।
ভারতীয় কোম্পানিগুলো বর্ধিত ভিসা ব্যয় সরাসরি মার্কিন ক্লায়েন্টদের ঘাড়েই চাপাবে বলে মনে করেন ভারতের শীর্ষ জনবল নিয়োগ প্রতিষ্ঠান সিআইইএল এইচআর-এর প্রধান আদিত্য নারায়ণ মিশ্র।
তিনি বলেন, 'কোম্পানিগুলো এত বড় স্পন্সরশিপ খরচ বহনে অনীহা দেখালে আমরা হয়তো আরও বেশি রিমোট কন্ট্রাক্টিং, অফশোর ডেলিভারি আর গিগ কর্মীর ওপর নির্ভরশীলতা দেখব।'
যুক্তরাষ্ট্রেও বড় আঘাত
এই সিদ্ধান্তের বিস্তৃত প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে একদিকে হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট দেখা দিতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত শিক্ষার্থী টানতে হিমশিম খেতে পারে, আর গুগল বা অ্যামাজনের মতো শক্তিশালী লবিং ক্ষমতা না থাকা ছোট স্টার্টআপগুলো পড়তে পারে সবচেয়ে বড় বিপাকে।
কেটো ইনস্টিটিউটের অভিবাসন বিষয়ক পরিচালক ডেভিড বিয়ার বিবিসিকে বলেন, 'ভিসা ফি বাড়ানো যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোকে নিয়োগনীতিতে আমূল পরিবর্তনে বাধ্য করবে এবং বিপুল পরিমাণ কাজ অফশোরে চলে যাবে। এমনকি এতে প্রতিষ্ঠাতা ও সিইওদের জন্যও আমেরিকায় ব্যবসা পরিচালনার পথ রুদ্ধ হবে। এটি মার্কিন উদ্ভাবন ও প্রতিযোগিতায় ধ্বংসাত্মক আঘাত হানবে।'
নিক্সকেন সেন্টারের অভিবাসন বিশ্লেষক গিল গুয়েরার ভাষায়, 'যুক্তরাষ্ট্রে প্রযুক্তি ও চিকিৎসার মতো খাতে নতুন কর্মী চাহিদা আরও বাড়বে। কিন্তু এত বিশেষায়িত ও গুরুত্বপূর্ণ খাতে যদি কয়েক বছরের জন্যও সংকট তৈরি হয়, তবে তা মার্কিন অর্থনীতিতে গুরুতর প্রভাব ফেলবে।'
তিনি আরও বলেন, 'এতে দক্ষ ভারতীয় কর্মীরা হয়তো পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারের জন্য অন্য দেশকে বেছে নেবে। এর ধাক্কা লাগবে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাতেও।'
সবচেয়ে বড় ধাক্কা ভারতীয় শিক্ষার্থীদের
যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর চার ভাগের এক ভাগই ভারতীয়। ফলে এ সিদ্ধান্তের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের ওপর।
নর্থ আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টস-এর প্রতিষ্ঠাতা সুধাংশু কৌশিক বলেন, 'সেপ্টেম্বরে ভর্তি শেষ হওয়ার পরপরই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নতুন আসা শিক্ষার্থীদের হতাশ করেছে।'
তিনি বিবিসিকে বলেন, 'এটি সরাসরি আক্রমণের মতো মনে হয়েছে, কারণ ফি ইতোমধ্যে পরিশোধ করা হয়ে গেছে। ফলে প্রতিটি শিক্ষার্থীর গড় ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ডলারের মধ্যে। আর এখন মার্কিন কর্মজগতে প্রবেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পথটাই কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।'
কৌশিক আশঙ্কা করছেন, এর ফলে আগামী বছর মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় শিক্ষার্থীর ভর্তি কমে যাবে। কারণ অনেকে এমন দেশে পড়াশোনা করতে চাইবেন, যেখানে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ার সুযোগ রয়েছে।
অনিশ্চয়তার ছায়া
তবে ফি বাড়ানোর পূর্ণ প্রভাব এখনো স্পষ্ট নয়। অভিবাসন আইনজীবীরা মনে করছেন, ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত দ্রুতই আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
গিল গুয়েরা সতর্ক করে বলেন, 'আমি আশা করছি নতুন এইচ-১বি নীতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একাধিক নেতিবাচক প্রভাব ডেকে আনবে, যদিও তা প্রকাশিত হতে কিছুটা সময় লাগবে।'
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, 'যেহেতু নির্বাহী আদেশ অনুযায়ী কিছু কোম্পানিকে ছাড় দেওয়া যেতে পারে, তাই অ্যামাজন, অ্যাপল, গুগল বা মেটার মতো বড় প্রতিষ্ঠান হয়তো এই নীতির বাইরে থাকতে পারে। কিন্তু তারা যদি সবাই ছাড় পায়, তবে ফি বাড়ানোর মূল উদ্দেশ্যই নষ্ট হয়ে যাবে।'
এক 'স্ট্রেস টেস্ট'
সবশেষে মনে হচ্ছে, এইচ-১বি ফি বাড়ানো বিদেশি কর্মীদের ওপর কর চাপানোর চেয়ে বেশি কিছু। এটি যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ও অর্থনীতির জন্য এক ধরনের 'স্ট্রেস টেস্ট'।
হিসাব বলছে, এইচ-১বি ভিসাধারী ও তাদের পরিবার মার্কিন অর্থনীতিতে বছরে প্রায় ৮৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অবদান রাখে। এর মধ্যে ২৪ বিলিয়ন ডলার যায় ফেডারেল পেরোল ট্যাক্সে, আর ১১ বিলিয়ন খরচ হয় ডলার রাজ্য ও স্থানীয় কর হিসেবে।
এখন কোম্পানিগুলো কিভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে সেটাই প্রশ্ন। তাদের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে—যুক্তরাষ্ট্র কি বিশ্বে প্রতিভা ও উদ্ভাবনের নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারবে কিনা।