এআই-র দাপটে কমছে গুগল সার্চ ইঞ্জিনের ট্রাফিক

দীর্ঘদিন ধরে সার্চ ইঞ্জিন বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য ধরে রেখেছে গুগল সার্চ ইঞ্জিন। তবে সে জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়তে শুরু করেছে।
ওয়েব ট্রাফিক বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান স্ট্যটকাউন্টার এ বছরের শুরুতে জানিয়েছে—গুগল সার্চ ইঞ্জিনের বাজার দখল ২০২৪ সালের শেষ তিন মাসে টানা ৯০ শতাংশের নিচে ছিল। অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে গুগলের বৈশ্বিক সার্চ মার্কেট শেয়ার ছিল যথাক্রমে ৮৯.৩৪%, ৮৯.৯৯% ও ৮৯.৭৩%—যা ২০১৫ সালের পর প্রথম এমন পতনের রেকর্ড।
প্রথমবারের মতো অ্যাপলের নিজস্ব ব্রাউজার সাফারিতেও গুগল সার্চের ব্যবহার কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের একটি মামলায় সাক্ষ্য দিতে গিয়ে অ্যাপলের সেবাখাতের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী এডি কিউ এমন তথ্য দিয়েছেন বলে জানিয়েছে দ্য টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া।
এডি কিউ বলেন, অ্যাপল এখন তাদের স্যাফারি ওয়েব ব্রাউজারকে নতুনভাবে সাজানোর কথা 'সক্রিয়ভাবে ভাবছে', যাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-ভিত্তিক সার্চ ব্যবস্থাকে যুক্ত করা যায়।
টেলিগ্রাফের তথ্যমতে, গুগল প্রতি বছর অ্যাপলকে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে, যাতে অ্যাপলের স্যাফারি ব্রাউজারে গুগলই ডিফল্ট [প্রধান] সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে থাকে।
তবে এখন সেই নির্ভরতায় ভাঙন ধরেছে। কারণ, মানুষ এখন আগের মতো শুধু গুগলের ওপর নির্ভর করছে না, বরং চ্যাটজিপিটি, পারপ্লেক্সিটি বা কো-পাইলটের মতো এআই-সার্চ টুল ব্যবহার করে দ্রুত উত্তর খুঁজে নিচ্ছে।
এডি কিউ জানান, ভবিষ্যতে এআই সার্চ সেবাগুলো প্রচলিত সার্চ ইঞ্জিনগুলোর জায়গা নিতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। তার মতে, এই ধারা প্রযুক্তির একটা বড় পরিবর্তন। গুগলের মতো প্রতিষ্ঠিত সার্চ ইঞ্জিনগুলোকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে নতুন এআই প্ল্যাটফর্মগুলো। যদিও তিনি মনে করেন, এখনই এগুলোকে 'ডিফল্ট সার্চ' হিসেবে নেওয়া সম্ভব নয়, কারণ আরও উন্নতির সুযোগ রয়েছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রে এআই-চালিত সার্চ বিজ্ঞাপনে ব্যয় আগামী কয়েক বছরে বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে বলে জানিয়েছে মার্কেট রিসার্চ প্রতিষ্ঠান ইমার্কেটর। চলতি বছর যেখানে এই খাতে মাত্র এক বিলিয়নের বেশি খরচ হয়েছে, সেখানে ২০২৯ সালের মধ্যে তা প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এই প্রবৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছে প্রযুক্তির দ্রুত গ্রহণ এবং আরও উন্নত ও নিখুঁত ব্যবহারকারী লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, যারা প্রচলিত কীওয়ার্ড ভিত্তিক সার্চ বিজ্ঞাপনে নির্ভরশীল, তাদের জন্য এই পরিবর্তন অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করতে পারে। কারণ এআই ভিত্তিক বিজ্ঞাপনগুলো ব্যবহারকারীদের জন্য বেশি সুবিধাজনক ও আকর্ষণীয় হওয়ায় তারা দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
অন্যদিকে, অনলাইন সার্চ বাজারে গুগলের একচেটিয়া অবস্থান ভাঙতে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ যে পদক্ষেপগুলো বিবেচনা করছে, তার একটি হলো—ডিফল্ট সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে থাকতে অন্য কোম্পানিকে অর্থ দেওয়ার এই সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া।
এ প্রসঙ্গে আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে অ্যাপলের এডি কিউ বলেন, 'এআই আসার আগ পর্যন্ত আমার মনে হতো, গুগল ছাড়া অন্য কেউ কার্যকর বিকল্প নয়। কিন্তু এখন নতুন যেসব প্রতিষ্ঠান এসেছে, তারা একেবারে ভিন্নভাবে সমস্যার সমাধানে এগোচ্ছে—এবং এতে অনেক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।'
আইফোন এবং অ্যাপলের দুই বিলিয়নের বেশি সক্রিয় ডিভাইসের জন্য এই পরিবর্তন বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন তিনি। ২০০৭ সালে আইফোন চালুর পর থেকে গুগলের মাধ্যমেই ব্যবহারকারীরা ওয়েব ব্রাউজ করেছেন। কিন্তু এখন এআই-নির্ভর এক ভিন্ন দুনিয়ায় প্রবেশ করছে তারা, যেখানে গুগলের বাইরে নতুন প্রতিযোগীরা জায়গা করে নিচ্ছে।
ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে অ্যাপলের ডিজিটাল অ্যাসিস্ট্যান্ট সিরিতে ওপেনএআই'র চ্যাটজিপিটি যুক্ত করা হয়েছে। ভবিষ্যতে গুগলের জেমিনি সার্ভিসও যোগ হতে পারে। এডি কিউ জানান, ওপেনএআই-এর সঙ্গে যে চুক্তি করা হয়েছে, তাতে করে অন্য এআই সার্ভিস যেমন অ্যাপলের নিজস্ব এআইও ভবিষ্যতে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব।
তবে এসব পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে ওয়েবসাইট ট্রাফিকে। গুগল সার্চ থেকে যে ওয়েবসাইটগুলোতে ভিজিটর [দর্শনার্থী] যেত, এখন সেসবের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, যা অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এডি কিউর মতে, এআই-ভিত্তিক সার্চ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের সার্চ ইনডেক্স আরও উন্নত করতে হবে। যদিও এ উন্নয়ন দ্রুত নাও হতে পারে, তবুও এসব প্ল্যাটফর্মের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা এতটাই কার্যকর যে মানুষ ধীরে ধীরে সেদিকেই ঝুঁকবে।
তিনি বলেন, 'এখন এআই নিয়ে এত বড় বড় কোম্পানি কাজ করছে, আর এতে বিনিয়োগও প্রচুর—আমি সত্যিই বুঝতে পারি না, এই পরিবর্তন কীভাবে ঠেকানো যাবে।'
তিনি আরও বলেন, জেনারেটিভ এআইয়ের পেছনের মূল শক্তি হলো লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলগুলো, যেগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও পরিপক্ব হচ্ছে। ফলে ব্যবহারকারীরা তাদের তথ্য অনুসন্ধানের অভ্যাস বদলাতে আগ্রহী হচ্ছেন।
তার ভাষায়, 'প্রকৃত প্রতিযোগিতা তখনই গড়ে ওঠে, যখন প্রযুক্তিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। আর এআই এখন সেই প্রযুক্তিগত রূপান্তরের একটি নতুন অধ্যায়, যা নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য দারুণ সম্ভাবনা তৈরি করছে।'
এআই সার্চ টুলগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলো ব্যবহারকারীর প্রাকৃতিক ভাষায় করা প্রশ্নের জবাব দিতে পারে, গভীর বিশ্লেষণ ও সহায়ক তথ্য দিয়ে। তবে এখনো কিছু ক্ষেত্রে ভুল তথ্য দেওয়ার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
২০২২ সালে চ্যাটজিপিটির আত্মপ্রকাশের পর গুগল এআই গবেষণায় তার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ করে এবং নিজস্ব ডেটা ভান্ডার কাজে লাগিয়ে নতুন ফিচার আনে। সম্প্রতি তারা এআই ওভারভিউ [অনুসন্ধানের সারাংশিত ফলাফল] চালু করেছে। এই সেবা ইতিমধ্যেই ১০০টিরও বেশি দেশে চালু হয়েছে।