ডাক্তারদের জন্য 'চ্যাটজিপিটি' বানিয়ে বিলিয়ন ডলারের মালিক হলেন এআই উদ্যোক্তা

চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন নতুন অগ্রগতির সঙ্গে তাল মেলাতে চিকিৎসকদের যেন নাজেহাল অবস্থা। প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একটি করে নতুন গবেষণাপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। এই বিশাল তথ্যস্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রোগী দেখা, চিকিৎসা নির্ধারণ ও গবেষণার হালনাগাদ তথ্যের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
এই বাস্তবতা সামনে এনে চ্যাটজিপিটির মতো 'ওপেনএভিডেন্স' নামের একটি নতুন এআই প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছেন হার্ভার্ড পিএইচডিধারী প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ড্যানিয়েল ন্যাডলার। ৪২ বছর বয়সী এই উদ্যোক্তা ২০১৮ সালে নিজের আগের কোম্পানি ৫৫ কোটি ডলারে বিক্রি করেছিলেন।
এবার তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির সাহায্যে চিকিৎসকদের জন্য তথ্য বিশ্লেষণের এই বোঝা সহজ করতে উদ্যোগ নিয়েছেন।
ফোর্বস-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ন্যাডলার বলেন,'আমরা আজ একটি জৈবপ্রযুক্তিনির্ভর স্বর্ণযুগে বাস করছি, যেখানে নতুন ও উন্নতমানের ওষুধ, নির্ভুল চিকিৎসা পদ্ধতি অবিরত আবিষ্কৃত হচ্ছে। কিন্তু চিকিৎসকদের জন্য এটি যেন এক প্রকার অন্ধকার যুগে পরিণত হয়েছে। কারণ, এই পেশায় এখন এক ধরণের চরম অবসাদ বা বার্নআউট ছড়িয়ে পড়ছে।'
ন্যাডলারের ভাষায়, 'তথ্যের যে বিশাল স্রোত চিকিৎসকদের প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করতে হচ্ছে, তা আসলে এক প্রকার "জলকামানের মতো"—এত দ্রুত ও এত পরিমাণে তথ্য আসছে যে একজন মানুষের পক্ষে তা সব পড়ে বিশ্লেষণ করা প্রায় অসম্ভব। কোটি কোটি গবেষণাপত্রে চোখ রাখা তো দূরের কথা, প্রাসঙ্গিক তথ্য খুঁজে পাওয়াটাই এক বড় চ্যালেঞ্জ।'
প্রতিষ্ঠিত নতুন স্টার্টআপ 'ওপেনএভিডেন্স'-এর নিজস্ব অ্যালগরিদম বিশ্বের কোটি কোটি রিভিউ-প্রাপ্ত গবেষণা প্রবন্ধ স্ক্যান করে, যার মধ্যে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন, জার্নাল অব দ্য আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (জামা)-এর মতো শীর্ষস্থানীয় সাময়িকীও রয়েছে। লক্ষ্য একটাই—চিকিৎসকদের দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহ করা, যেন তারা নিজেরাই প্রয়োজনে বিস্তারিত পড়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। প্রতিটি উত্তরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গবেষণার পূর্ণসূত্রও প্রদান করে এই সফটওয়্যার।
ভেরিফায়েড চিকিৎসকেরা এই সফটওয়্যার বিনামূল্যে ব্যবহার করতে পারেন। ইতোমধ্যেই প্ল্যাটফর্মটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪০ শতাংশ চিকিৎসককে নিজেদের ব্যবহারকারী হিসেবে যুক্ত করেছে—যার সংখ্যা ৪ লাখ ৩০ হাজারের বেশি। প্রতি মাসে নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন আরও ৬৫ হাজার চিকিৎসক।
প্ল্যাটফর্মটি থেকে বাৎসরিক আয় এখন প্রায় ৫ কোটি ডলার, যা পুরোপুরি বিজ্ঞাপননির্ভর—গুগলের আদলে গড়ে উঠেছে এই মডেল।
তবে সবচেয়ে নজরকাড়া দিক হলো এর বাজারমূল্য। চলতি বছরের শুরুতে যেখানে কোম্পানিটির মূল্য ছিল ১০০ কোটি ডলার, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫০ কোটি ডলারে।
নতুন এই মূল্যমানের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি ২১ কোটি ডলারের তহবিল সংগ্রহ করেছে, যার নেতৃত্বে ছিল গুগলের ভেঞ্চার আর্ম জিভি এবং ক্লেইনার পারকিন্স। বিনিয়োগ করেছে কোচু, কনভিকশন এবং থ্রাইভ ক্যাপিটালের মতো প্রভাবশালী ভিসি ফার্মগুলোও।
এই সাফল্যে প্রতিষ্ঠানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ড্যানিয়েল ন্যাডলার এখন বিলিয়নিয়ার। প্রায় ৬০ শতাংশ মালিকানা ধরে রাখা এই উদ্যোক্তা র সম্পদের পরিমাণ এখন ফোর্বস-এর হিসাবে ২৩৮ কোটি ডলার। তারই সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ৩০ বছর বয়সী প্রযুক্তি প্রধান জ্যাক জিগলারের মালিকানায় রয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ শেয়ার, যার বর্তমান মূল্য প্রায় ৩৫ কোটি ডলার।
ওপেনএভিডেন্সের লক্ষ্য, চিকিৎসকদের জন্য লাখো গবেষণাপত্র থেকে প্রয়োজনীয় ও নির্ভরযোগ্য তথ্য দ্রুত তুলে আনা—যা তারা নিজেরাই যাচাই করতে পারবেন। তবে শুধু তথ্য সংগ্রহ নয়, তথ্যের গুণমান যাচাই করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, প্রতিনিয়ত যে হারে চিকিৎসাবিষয়ক গবেষণা হচ্ছে—তার মধ্যে অনেক গবেষণা উৎকৃষ্ট, কিছু ভুল, এবং অনেকগুলো আবার অপ্রাসঙ্গিক বা পুরনো।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসক সংকট ও সময়ের ঘাটতি ক্রমেই বাড়ছে। ফলে চিকিৎসকদের জন্য এই বিশ্লেষণমূলক ভার কমানো এবং চিকিৎসাসেবার মান উন্নয়নে এআইভিত্তিক এই প্রযুক্তির গুরুত্ব আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারীরা।
ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের নিউরোলজি বিভাগের ভাইস চেয়ারম্যান ড. আনীশ সিংহাল এক বছর আগে হাসপাতালের ইমেইল দেখে ওপেনএভিডেন্স ডাউনলোড করেন। এরপর তিনি দেখেন, তার সহকর্মী ও শিক্ষার্থীরাও এটি ব্যবহার করছেন।
তার মতে, স্ট্রোক সংক্রান্ত নতুন গবেষণা খুঁজে পাওয়া আগে ছিল কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। ওপেনএভিডেন্স সেটি অনেক সহজ করেছে। চ্যাটজিপিটি যেখানে সরাসরি উত্তর দিয়ে থেমে যায়, সেখানে ওপেনএভিডেন্স বিষয়টির আরও গভীরে নিয়ে যায়।
সম্প্রতি কোম্পানিটি নতুন 'ডিপকনসাল্ট' ফিচার চালু করেছে, যা বিভিন্ন গবেষণার তথ্য জুড়ে দিয়ে আরও গভীর বিশ্লেষণ করে। সহপ্রতিষ্ঠাতা জ্যাক জিগলার বলেন, 'এটি একদল বিশেষজ্ঞ গবেষকের মতো কাজ করে, যারা চিকিৎসকের কাজের সঙ্গেই তথ্য বিশ্লেষণ করে।'
যদিও ওপেনএভিডেন্সের প্রযুক্তি অন্য ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যায়, তবে প্রতিষ্ঠাতা ন্যাডলার এখন শুধু স্বাস্থ্যসেবায় মনোযোগী। বিনিয়োগকারী থমাস লাফ মনে করেন, ভবিষ্যতে ওপেনএভিডেন্স হতে পারে এমন একটি কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্ম যেখানে সব চিকিৎসা তথ্য একসঙ্গে পাওয়া যাবে।