গুগলের নতুন ওপেন সোর্স এআই: এক্স-রে ও মেডিকেল রেকর্ড বিশ্লেষণ করবে বিনামূল্যেই

স্বাস্থ্যসেবা খাতে নিজেদের নতুন এআই মডেলগুলো ব্যয়বহুল এপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (এপিআই)-এর পেছনে আটকে না রেখে, গুগল এগুলো সরাসরি ডেভেলপারদের হাতে তুলে দিচ্ছে। একে বিশ্ব স্বাস্থ্য খাতের জন্য একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
নতুন এই এআই মডেলগুলোর নাম মেডজেম্মা ২৭বি মাল্টিমোডাল ও মেডসিগএলআইপি। এগুলো গুগলের ক্রমবর্ধমান ওপেন সোর্স হেলথকেয়ার এআই মডেলের অংশ।
শুধু প্রযুক্তিগত সক্ষমতাই নয়, বরং এসব মডেল উন্মুক্ত হওয়ায় হাসপাতাল, গবেষক ও ডেভেলপাররা এখন চাইলেই এগুলো ডাউনলোড করে নিজেদের মতো করে পরিবর্তন ও ব্যবহার করতে পারবেন।
মেডজেম্মা ২৭বি
গুগলের নতুন মেডজেম্মা ২৭বি কেবল পূর্বের মতো চিকিৎসাবিষয়ক লেখা পড়ে বোঝেই না, এটি চিকিৎসাবিষয়ক ছবি বা ইমেজও বিশ্লেষণ করতে পারে। এক্স-রে, প্যাথলজি স্লাইড বা রোগীর বহু বছরের তথ্য; সবকিছু একত্রে বিশ্লেষণ করে চিকিৎসকের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে এটি।
মেডকিউএ নামক এক পরীক্ষিত মেডিকেল জ্ঞানভিত্তিক বেঞ্চমার্কে মেডজেম্মা ২৭বি-এর টেক্সট মডেল ৮৭.৭ শতাংশ স্কোর অর্জন করেছে। এটি অনেক বড় ও ব্যয়বহুল মডেলের পারফরম্যান্সের প্রায় কাছাকাছি স্কোর। কিন্তু এটি চালাতে খরচ পড়ে তার এক-দশমাংশ মাত্র। বাজেট সংকটে থাকা স্বাস্থ্যব্যবস্থার জন্য এটি হতে পারে এক বড় পরিবর্তনের সূচনা।
এর ছোট সংস্করণ মেডজেম্মা ৪বি আকারে ছোট হলেও পারফরম্যান্সের দিক থেকে পিছিয়ে নেই। একই পরীক্ষায় এটি ৬৪.৪ শতাংশ স্কোর করেছে। ফলে এটি এই ক্যাটাগরিতে অন্যতম সেরা টুল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোর্ড সার্টিফায়েড রেডিওলজিস্টরা এর তৈরি এক্স-রে রিপোর্ট বিশ্লেষণ করেন, তখন ৮১ শতাংশ রিপোর্টকে বাস্তবে রোগীদের সেবার জন্য যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য বলে দাবি করেন।
মেডসিগএলআইপি: লাইট ভার্সনের এক শক্তিশালী মডেল
এছাড়াও গুগল মেডসিগএলআইপি নামের আরেকটি মডেল উন্মুক্ত করেছে। মাত্র ৪০০ মিলিয়ন প্যারামিটার বিশিষ্ট এই মডেলটি বর্তমানের তুলনায় 'লাইট ভার্সনের'। তবে চিকিৎসাবিষয়ক ইমেজ বিশ্লেষণের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত।
এটিকে এক্স-রে, টিস্যু স্যাম্পল, ত্বকের রোগের ছবি ও চোখের স্ক্যানের বিশাল ডেটাসেটে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ফলে এটি চিকিৎসাবিষয়ক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা বা প্যাটার্ন শনাক্ত করতে সক্ষম। একইসঙ্গে, এটি সাধারণ ছবি বিশ্লেষণেও সক্ষমতা রাখে।
এই মডেল চিত্র ও লেখার মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি করে। যেমন, আপনি যদি একটি এক্স-রে দেখিয়ে বলেন, 'এই ধরনের আরও কেস খুঁজে দাও', তাহলে এটি শুধু চিত্রগত মিল নয়, সেইসঙ্গে চিকিৎসাবিষয়ক অন্যান্য তাৎপর্যও বুঝতে পারে।
ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতা
কোনো প্রযুক্তি কতটা কার্যকর, তা বোঝা যায় বাস্তবে এর ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতা থেকে। প্রাথমিক রিপোর্টগুলো বলছে, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো গুগলের এই মডেলগুলো নিয়ে বেশ উৎসাহ দেখাচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসে অবস্থিত ডিপহেলথ সংস্থা ইতিমধ্যে মেডসিগএলআইপি মডেল ব্যবহার করে এক্স-রে বিশ্লেষণ শুরু করেছে। তারা জানিয়েছে, এই মডেল এমন কিছু সমস্যাও শনাক্ত করছে, যা ব্যস্ত রেডিওলজিস্টদের চোখ এড়িয়ে যেতে পারত। ফলে এতে একধরনের 'নিরাপত্তা বলয়' তৈরি হচ্ছে।
তাইওয়ানের চ্যাং গুং মেমোরিয়াল হাসপাতালের গবেষকরা জানিয়েছেন, মেডজেম্মা এমনকি চীনা ভাষায় রচিত প্রাচীন চিকিৎসা গ্রন্থও বিশ্লেষণ করে এবং কর্মীদের প্রশ্নের নির্ভুল উত্তর দিতে সক্ষম।
ভারতের ট্যাপ হেলথ প্রতিষ্ঠান এক গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছে। তাদের মতে, এই মডেল সাধারণ এআই-এর মতো 'হ্যালুসিনেট' করে ভুল তথ্য দেয় না। বরং 'চিকিৎসাবিষয়ক প্রেক্ষাপটকে' বোঝে এবং তথ্য অনুযায়ী যৌক্তিক উত্তর দেয়।
কেন স্বাস্থ্য খাতে ওপেন সোর্স এআই গুরুত্বপূর্ণ
গুগলের এ সিদ্ধান্ত উদারতার বাইরেও বরং কৌশলগতও। স্বাস্থ্যসেবায় এমন কিছু চাহিদা রয়েছে, যা সাধারণ এআই সার্ভিস দিয়ে পূরণ সম্ভব নয়। হাসপাতালগুলোর জন্য রোগীর তথ্য নিরাপদ রাখা জরুরি, গবেষকদের জন্য মডেলের আচরণ পূর্বানুমেয় হতে হয়, এবং ডেভেলপারদের জন্য মডেল কাস্টমাইজ করার স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন।
গুগল এই মডেলগুলো ওপেন সোর্স করায় হাসপাতালগুলো নিজেদের সার্ভারে এটি চালাতে পারবে, নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী পরিবর্তন করতে পারবে, এবং দীর্ঘমেয়াদে এর আচরণে স্থায়িত্ব বজায় থাকবে। এটি চিকিৎসায় নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তবে গুগল পরিষ্কার করে জানিয়েছে, এই মডেলগুলো চিকিৎসক প্রতিস্থাপন করার জন্য নয়। বাস্তব জীবনে ব্যবহারের আগে এগুলোকে পর্যাপ্ত মানব পর্যবেক্ষণ, ক্লিনিকাল ট্রায়াল এবং অনুমোদনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এর তৈরি রিপোর্ট পরীক্ষা করতে হবে, সুপারিশ যাচাই করতে হবে এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত থাকবে যোগ্য চিকিৎসকদের হাতে।
এই সতর্কতা স্বাভাবিক। কারণ এমনকি সর্বোচ্চ স্কোর করা এআই মডেলও জটিল ও ব্যতিক্রমী কেইসের ক্ষেত্রে ভুল করতে পারে। এরা তথ্য বিশ্লেষণ ও প্যাটার্ন শনাক্তে দক্ষ হলেও, মানুষের মতো বিচারবুদ্ধি, অভিজ্ঞতা ও নৈতিক দায়িত্ব এদের নেই।
সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত
এই মডেলগুলোর তাৎক্ষণিক সক্ষমতার চেয়েও বড় বিষয় হলো, এগুলো নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিচ্ছে। যারা ব্যয়বহুল এআই সেবা নিতে পারতেন না, বিশেষ করে ছোট হাসপাতাল, উন্নয়নশীল দেশের গবেষক ও চিকিৎসা শিক্ষার্থীরা; তাদের জন্য এই প্রযুক্তি এখন সহজলভ্য হচ্ছে।
এই মডেলগুলো এমনভাবে তৈরি যে, একক গ্রাফিক্স কার্ডেই চলে, এমনকি ছোট সংস্করণগুলো মোবাইল ডিভাইসেও ব্যবহারযোগ্য। ফলে এমন জায়গায় পয়েন্ট-অফ-কেয়ার এআই ব্যবহার সম্ভব হবে, যেখানে উচ্চ প্রযুক্তির অবকাঠামো অনুপস্থিত।
বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্যসেবা খাত যখন কর্মী সংকট, রোগীর চাপ ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনে হিমশিম খাচ্ছে, তখন গুগলের মেডজেম্মা ও মেডসিগএলআইপি-এর মতো টুলগুলো মানব দক্ষতা কমিয়ে নয়, বরং তা আরও বিস্তৃত ও সহজলভ্য করে স্বাস্থ্যসেবায় নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।