কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি মানুষকে বোকা বানিয়ে ফেলছে?

স্ট্যান্ডার্ড পরীক্ষায় অংশ নেওয়া যে কেউ জানেন—২০ মিনিটের মধ্যে একটি বড় রচনা প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বেশ কঠিন কাজ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহারে এই মানসিক চাপ অনেকটাই কমে যায়। তবে, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি-এর (এমআইটি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই সুবিধার পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে বড় এক ক্ষতির আশঙ্কা।
গবেষণায় শিক্ষার্থীদের দুই ভাগে ভাগ করা হয়—এক দল চ্যাটজিপিটি-র সহায়তায় রচনা লেখে, অন্য দল লেখে নিজের চেষ্টায়। লেখার সময় সবার মস্তিষ্কে ইইজি যন্ত্র বসানো হয়, যাতে তাদের স্নায়বিক কার্যক্রম পরিমাপ করা যায়। দেখা যায়, যারা এআই ব্যবহার করেছে তাদের মস্তিষ্কের সৃজনশীলতা ও মনোযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অংশগুলো তুলনামূলকভাবে কম সক্রিয় ছিল। এমনকি, তারা যে রচনাটি লিখেছে, তা থেকেই সঠিকভাবে উদ্ধৃতি দিতে তাদের সমস্যা হচ্ছিল।
এই গবেষণার ফলাফল আরও অনেক গবেষণার সঙ্গে মিলছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে—সৃজনশীলতা ও শেখার ক্ষেত্রে এআই ব্যবহার ক্ষতির কারণ হতে পারে। গবেষকরা বলছেন, জেনারেটিভ এআই আমাদের তাৎক্ষণিক সুবিধা দিলেও, দীর্ঘমেয়াদে সৃজনশীলতা ও শেখার ক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এমআইটি-র এই গবেষণা আরও দু'টি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার ফলাফলকে শক্তিশালী করেছে, যেগুলোতে দেখা হয়েছে—এআই ব্যবহারের ফলে মানুষের চিন্তাশক্তি বা ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। প্রথমটি ছিল মাইক্রোসফট রিসার্চের একটি সমীক্ষা। সেখানে ৩১৯ জন জ্ঞানভিত্তিক পেশাজীবী অংশ নেন, যারা সপ্তাহে অন্তত একবার জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করেন। তারা জানান, তারা প্রায় ৯০০টির বেশি কাজ করেছেন এআই-এর সাহায্যে—যেমন বড় লেখা সংক্ষেপ করা বা একটি মার্কেটিং ক্যাম্পেইনের পরিকল্পনা তৈরি করা।
এই কাজগুলোর মধ্যে মাত্র ৫৫৫টি কাজে অংশগ্রহণকারীরা বলছেন যে সেখানে সত্যিকারের চিন্তা বা মূল্যায়নের প্রয়োজন ছিল। যেমন: এআই যা তৈরি করেছে, তা ক্লায়েন্টকে দেওয়ার আগে ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখা বা এআই প্রথমবার সঠিক ফল না দিলে নতুন করে নির্দেশনা দেওয়া। বাকি কাজগুলো ছিল একেবারে সহজ ও ভাবনাহীন।
মোটের ওপর বেশিরভাগ কর্মীই জানিয়েছেন, চ্যাটজিপিটি, গুগল জেমিনি বা মাইক্রোসফট কোপাইলটের মতো জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করে কাজ করতে তাদের অনেক কম মাথার খাটুনি লেগেছে।
মাইকেল গারলিখ নামে এক গবেষক, যিনি এসবিএস সুইস বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক, তিনি ব্রিটেনে ৬৬৬ জন মানুষের ওপর একটি গবেষণা চালান। গবেষণায় তিনি জানতে চান, তারা কতটা নিয়মিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করেন এবং এআই-এর ওপর তাদের বিশ্বাস কতটা। এরপর তাদের কিছু সাধারণ বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন করা হয়। ফলাফলে দেখা যায়, যারা বেশি এআই ব্যবহার করেন, তারা চিন্তাভাবনার প্রশ্নে কম নম্বর পেয়েছেন।
ড. গারলিখ বলেন, গবেষণাটি প্রকাশের পর বহু স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের অনেকেই বলেন, 'এ গবেষণার ফলাফল একেবারে আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে যায়।' কারণ, শিক্ষার্থীদের মধ্যে এআই ব্যবহারের প্রবণতা খুব দ্রুত বাড়ছে।
এআই দীর্ঘমেয়াদে মানুষের মস্তিষ্ক দুর্বল করে দেবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তিনটি গবেষণার বিজ্ঞানীরাই বলেছেন, বেশি এআই ব্যবহারের সঙ্গে মস্তিষ্ক দুর্বল হওয়ার যে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, তার পেছনে সত্যিই কোনো কারণ আছে কি না, তা জানতে আরও গবেষণা দরকার।
ড. গারলিখের গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের বিশ্লেষণক্ষমতা বেশি, তারা হয়তো এমনিতেই এআই-এর ওপর কম নির্ভর করেন। আর এমআইটি-র গবেষণায় অংশ নিয়েছিলেন মাত্র ৫৪ জন, তাও কেবল একটি ছোট্ট বিষয়ের ওপর কাজ হয়েছিল।
মূল কথা হলো, জেনারেটিভ এআই (যেমন: চ্যাটজিপিটি) তৈরি করা হয়েছে মানুষের মানসিক চাপ কমাতে—যেমনটা অন্য প্রযুক্তিও করে থাকে। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন, লেখা 'মনে রাখার জন্য কোনো ওষুধ নয়, বরং মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য।' যেমন, ক্যালকুলেটর ব্যবহার করায় দোকানিদের আর হিসাব করতে হয় না। গুগল ম্যাপের মতো অ্যাপে দিকনির্দেশনা থাকায় আর কেউ মানচিত্র দেখেন না।
তবুও কেউ বলেন না, এতে মানুষ বোকা হয়ে যাচ্ছে।
মানুষের কঠিন বা বিরক্তিকর মানসিক কাজ কমানোর জন্য এআই ব্যবহার করাকে বিজ্ঞানীরা বলেন 'কগনিটিভ অফলোডিং'। এই ধারণাটি তৈরি করেছেন ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক ইভান রিসকো ও তার সহকর্মী স্যাম গিলবার্ট।
রিসকো বলেন, এখনো খুব কম প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, যন্ত্র দিয়ে চিন্তার কাজ করালে মানুষের নিজস্ব চিন্তাশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে তার আশঙ্কা, জেনারেটিভ এআই (যেমন: চ্যাটবট) ব্যবহার করে মানুষ এখন অনেক বেশি জটিল মানসিক কাজ সরিয়ে ফেলছে।
সহজ কিছু হিসাব এআই-এর ওপর ছেড়ে দেওয়া তেমন ক্ষতির নয়, কারণ এগুলোর ব্যবহার খুবই সীমিত। কিন্তু লেখা বা সমস্যা সমাধানের মতো চিন্তার কাজ যদি বারবার এআই দিয়ে করানো হয়, তাহলে বিষয়টা ভিন্ন। আর একবার যদি মস্তিষ্ক 'কাজটা অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে' দেওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলে, তাহলে সেটা ছাড়াও খুব কঠিন হয়ে পড়ে। যা এক ধরনের 'ফিডব্যাক লুপ' তৈরি করতে পারে।
ড. গারলিখের গবেষণায় দেখা গেছে, একজন অংশগ্রহণকারী যিনি নিয়মিত জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করেন, তিনি আক্ষেপ করে বলেন, 'আমি এআই-এর ওপর এতটা নির্ভরশীল হয়ে গেছি যে, এখন অনেক সমস্যার সমাধান নিজের মতো করে করতে পারি না।'
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আশা করছে, এআই ব্যবহারে কাজের গতি বাড়বে। কিন্তু এতে একটা বিপদের দিকও আছে।
নর্থইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিষয়ের অধ্যাপক বারবারা লারসন বলেন, 'দীর্ঘ সময় এআই ব্যবহারে মানুষের বিশ্লেষণ ক্ষমতা কমে গেলে, তা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার কারণ হতে পারে।' তিনি আরও বলেন, বেশি এআই ব্যবহারে কর্মীদের সৃজনশীলতাও কমে যেতে পারে।
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, ৪৬০ জন অংশগ্রহণকারীকে বলা হয়েছিল, সাধারণ কিছু জিনিস—যেমন গাড়ির টায়ার বা একটি প্যান্ট ভিন্নভাবে ব্যবহার করার নতুন উপায় ভাবতে। যারা এআই-এর দেওয়া ধারণা আগে দেখে নিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই কম সৃজনশীল ও একঘেয়ে উত্তর দেন।
উদাহরণ হিসেবে, চ্যাটবট প্যান্ট দিয়ে কী করা যায় জানতে চাইলে বলেছিল, 'খড় ভরে প্যান্টকে ভয়ংকর পাখির মতো বানিয়ে মাঠে রাখা', যা মূলত প্যান্টকেই প্যান্ট হিসেবে ব্যবহার করারই আরেক রূপ। অন্যদিকে একজন মানুষ নিজে ভেবে বলেছিলেন, প্যান্টের পকেটে বাদাম রেখে তা দিয়ে 'নতুন ধরনের পাখির খাবারের পাত্র' বানানো যায়।
অধ্যাপক লারসন বলেন, এআই-এর সবচেয়ে ভালো ব্যবহার হলো, 'একে একটি উৎসাহী কিন্তু কিছুটা বোকা সহকারী' হিসেবে রাখা।
অন্যদিকে ড. গারলিখ বলেন, সমস্যার সমাধানের পুরো কাজ না দিয়ে এআই-কে ধাপে ধাপে সাহায্যের জন্য ব্যবহার করাই ভালো। যেমন, 'এরকম রৌদ্রোজ্জ্বল দিলে আরামদায়ক কোথায় বেড়াতে যাওয়া যায়?' এই প্রশ্ন না করে বরং ধাপে ধাপে জিজ্ঞেস করা যায়, 'কোন কোন জায়গায় সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয়?'
মাইক্রোসফটের একটি গবেষণা দলের সদস্যরা এমন এআই সহকারী তৈরি করছেন, যারা মাঝে মাঝে ব্যবহারকারীদের থামিয়ে চিন্তা করার জন্য উসকানি দেবে।
এমোরি ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি দল চায়, ভবিষ্যতের চ্যাটবট যেন সরাসরি উত্তর না দিয়ে ব্যবহারকারীদের প্রশ্ন করে চিন্তাভাবনা করতে সাহায্য করে—যেমনটা দার্শনিক সক্রেটিস করতেন।
এআই ব্যবহারে মানুষ যেন কম চিন্তা করে—এমনটা ঠেকাতে কিছু কৌশল থাকলেও, সেগুলো বাস্তবে খুব কাজের হবে কি না, তা পরিষ্কার নয়। যদি কেউ চ্যাটবটকে ইচ্ছেমতো ধীরগতির বা জটিল করে তোলে, তবু সেটি ফলপ্রসূ নাও হতে পারে। বরং উল্টো ক্ষতি হতে পারে।
আমেরিকার অ্যাবিলিন ক্রিশ্চিয়ান ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, এআই সহকারী বারবার হস্তক্ষেপ করলে দুর্বল প্রোগ্রামারদের কাজে ব্যাঘাত ঘটে।
মানুষের মস্তিষ্ক সচল রাখতে কিছু সরল (তবে কিছুটা জোরজবরদস্তিমূলক) পন্থাও আছে। যেমন, যারা এআই খুব বেশি ব্যবহার করে, তাদের বলা হতে পারে—প্রথমে নিজের উত্তরটি দিয়ে রাখো, তারপর কিছুক্ষণ পর এআই-এর সাহায্য নাও।
এই পদ্ধতিকে 'কগনিটিভ ফোর্সিং' বলা হয়। মাইক্রোসফটের গবেষক জানা বুচিঙ্কা বলছেন, এতে মানুষ ভালো কাজ করতে পারে ঠিকই, তবে বেশিরভাগ মানুষ এভাবে চাপ পছন্দ করে না। তাই অনেকেই হয়তো এই বাধা এড়িয়ে যাওয়ার পথ খুঁজবে।
অলিভার ওয়াইম্যান নামের এক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ১৬টি দেশে একটি জরিপ চালায়। তাতে ৪৭ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তাদের অফিস নিষেধ করলেও তারা জেনারেটিভ এআই ব্যবহার করতেন।
এআই এখনো এতটাই নতুন প্রযুক্তি যে, অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের মস্তিষ্কই এখনো সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র।তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারকারী ও নীতিনির্ধারকদের বিচার করতে হবে—এই প্রযুক্তির উপকারিতা কি মানুষের চিন্তাশক্তি কমে যাওয়ার ঝুঁকির চেয়ে বেশি?
আর যদি একদিন প্রমাণ মেলে—এআই মানুষকে সত্যিই বোকা বানাচ্ছে, তখন কি মানুষ গুরুত্ব দেবে?