জালিয়াতির মামলায় দীর্ঘসূত্রতা: বাংলাদেশে বিনিয়োগ স্থগিতের চিন্তা জাপানি প্রতিষ্ঠানের

বাংলাদেশে ২০১৫ সালে নিবন্ধন নেওয়ার সময় বড় বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছিল জাপানের বহুজাতিক কোম্পানি নিপ্পন এয়ারকন্ডিশনিং সার্ভিস লিমিটেড। তবে প্রতারণার কারণে প্রতিষ্ঠানটি এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগই বাতিলের কথা ভাবছে।
প্রতিষ্ঠানটি বলছে, তার বাংলাদেশি অংশীদারের বিরুদ্ধে ৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকা জালিয়াতির মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি না হলে তারা শিগগিরই বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগের পরিকল্পনা পুরোপুরি বাতিল করবে।
সুপরিসর অফিস, গাড়ি ক্রয় ও কারাখানা নির্মাণের জন্য প্রথমিক বিনিয়োগের পরিকল্পনা ১৫০ কোটি টাকা হলেও পরে তা ১০ বছরে হাজার কোটি টাকায় নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। সেইসঙ্গে বাংলাদেশ থেকে এশিয়ার আরো কয়েকটি দেশে তাদের পণ্য রপ্তানির পরিকল্পনা ছিল।
তবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোরশেদ আলম মাইকেলের বিরুদ্ধে ওঠা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের কারণে এসব পরিকল্পনা এখন ভেস্তে গেছে।
অর্থ আত্মসাৎ এবং আইনি জটিলতা
নিপ্পন এয়ারকন্ডিশনিং সার্ভিস লিমিটেডের (এনএসিএস) অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এনএসিএস বিডি কোম্পানি লিমিটেডের অভিযোগ- স্থানীয় অংশীদার খোরশেদ আলম মাইকেলকে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব এবং প্রতিষ্ঠানের ১ শতাংশ 'ডোনেশন শেয়ার' দেওয়া হয়েছিল। তবে তিনি প্রতিষ্ঠানের ৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকার অর্থসম্পদ আত্মসাৎ করেছেন।
এনএসিএস বিডি লিমিটেড ও মামলার নথি অনুযায়ী খোরশেদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ-
- ২০১৫ সালে শুরুর দিকে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির সব কার্যক্রম ভালোভাবে চললেও দুই বছর পর ২০১৭ সালে অফিস স্পেস, গাড়ি ও কারখানার জন্য জমি কেনার ক্ষেত্রে খোরশেদের প্রতারণার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
- রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অফিসের জন্য ফ্ল্যাট কেনার কথা বলে খোরশেদ কোম্পানির ব্যাংক হিসাব থেকে ৬০ লাখ টাকা উত্তোলন করেন। কিন্তু ফ্ল্যাটের বুকিং দেন নিজের মেয়ের নামে।
- খোরশেদ কোম্পানির ২৩ মাসের অফিসের ভাড়া বাবদ ১১ লাখ টাকা তুলে ব্যক্তিগত কাজে ব্যয় করেছে।
- নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকায় জাপানিজ ইকোনোমিক জোনের পাশে ৩ কোটি মূল্যের প্রতিষ্ঠানের নামে জমি কেনার কথা বলে ১ কোটি টাকা তুলে নিয়ে কর্তৃপক্ষকে একটি জাল দলিল দিয়েছেন।
- কোম্পানির অনুমোদন ছাড়াই ১৪টি গাড়ি কেনার নামে 'কার কালেকশন' নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন। কিন্তু কোম্পানি কোনো গাড়ি পায়নি। পরিশোধ করা টাকাও ফেরত আসেনি।
এসব ঘটনায় প্রতিকার চেয়ে কাওরি ফুনাহাশি ২০২২ সালে রাজধানীর ভাটারা থানায় মামলা করেন। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্তে জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে খোরশেদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানটির ৫ কোটি ৩৮ লাখ টাকার অর্থসম্পদ আত্মসাতের প্রমাণ পায় সংস্থাটি।
তবে ২০২৩ সালের এপ্রিলে কোম্পানির সঙ্গে মীমাংসা করে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আদালত থেকে জামিন পান খোরশেদ। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জামিন পাওয়ার পর থেকে তিনি আর কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগই করেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত খোরশেদ বলেন, 'আমি তো নিজেই এ কোম্পানির মালিক ছিলাম। আমি কারও সঙ্গে প্রতারণা করিনি। আমি ব্যস্ত আছি, পরে কথা বলব।' এই বলে কলটি কেটে দেন তিনি। এরপর থেকে তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
খোরশেদ নিজেকে কোম্পানির মালিক দাবি করলেও পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে তাকে বেতনভুক্ত কর্মকর্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, খোরশেদের নামে ১ শতাংশ (১০ হাজার) শেয়ার বরাদ্দ থাকলেও ২০২১ সালের নভেম্বরে তার চাকরিচ্যুতির সঙ্গে সঙ্গে তা ফেরত নেওয়া হয়।
বিদেশি বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা
এনএসসিএস কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক ও এনএসিএস বিডি কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান কাওরি ফুনাহাশি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এ মুহূর্তে আমাদের মনে হচ্ছে, অতিরিক্ত বিনিয়োগ করা কঠিন হবে। আমরা আমাদের বর্তমান সম্পদ দিয়েই ব্যবসা চালিয়ে যেতে চাই। আর সেটা করতে হলে আমাদের মামলায় জিততেই হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি জানি বাংলাদেশে ন্যায় বিচারব্যবস্থা আছে। কিন্তু সেটা সঠিকভাবে কাজ করছে না। আমি বাংলাদেশ সরকারের কাছে অনুরোধ করব যেন তারা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য একটি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা তৈরি করে।'
এনএসিএস বিডি লিমিটেডের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ হোসেন জানান, কাওরি ফুনাহাশি এতদিন জাপান থেকে বারবার এসে আদালতে হাজিরা দিয়ে গেছেন। আপাতত তিনি জাপানে ফিরে গেছেন।
তিনি বলেন, 'জাপানি নাগরিকেরা এ দেশের বিচারিকপ্রক্রিয়ার সঙ্গে মোটেই অভ্যস্ত নন। এতদিন ধরে লড়েও তেমন কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় কাওরি ভেঙে পড়েছেন।'
ব্যবসায়ী নেতা ও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ ধরনের ঘটনায় দ্রুত আইনি প্রতিকার না পেলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে উৎসাহ হারাবে। সরকারের উচিত এ সমস্যা দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) নির্বাহী পরিচালক নূরুল কবির বলেন, 'বাংলাদেশের কোনো অসাধু ব্যক্তির এমন আচরণ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থায় চিড় ধরাবে। আদালতের পাশাপাশি বিডা (বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) ও জাপানি দূতাবাসেও বিষয়টি জানানো উচিত। আমরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।'
বাংলাদেশে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) তুলনামূলক কম। এর অন্যতম একটি কারণ হলো— বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে ধীর গতি।
বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালের 'ইজ অব ডুয়িং বিজনেস' রিপোর্টে এ সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়েছিল। তথ্য অনুযায়ী, বিদেশি প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট প্রায় সাড়ে ৯০০ মামলা দেশের বিভিন্ন আদালতে ঝুলে আছে। এগুলোর মধ্যে প্রায় ২৫০টি মামলা সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন।
এসব মামলার মধ্যে একটি সুইস কোম্পানির করা জালিয়াতির মামলাও রয়েছে। যেটা ১৯৮৭ সাল থেকে ঝুলে আছে। মামলাটি এখনো সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে রায়ের অপেক্ষায় আছে।
বিডার মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা
প্রতারণার ঘটনায় ন্যায়বিচার পেতে প্রতিষ্ঠানটি বিডা ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) বিষয়টি জানিয়েছে।
বিডার ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশনের মহাপরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. আরিফুল হক জানান, কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে বিনিয়োগের আইন জটিলতায় পড়লে বিডার তেমন কিছু করার থাকে না। তবে ওই সমস্যা সমাধানে বিডা মিডিয়েট (মধ্যস্থতা) করার কাজ করে।
তিনি বলেন, 'নিপ্পন এয়ারকন্ডিশনিং সার্ভিস লিমিটেডের সমস্যা প্রতিকার দ্রুত পাওয়ার জন্য বিডা মিডিয়েট করার চেষ্টা করছে, যাতে করে দ্রুত আইনগত প্রতিকার পাওয়া যায়। এজন্য একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।'