ইউক্রেন যুদ্ধাবসানে সম্ভাব্য শান্তি চুক্তির রূপরেখা ও ঝুঁকিগুলো কী?

রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়ই শান্তি আলোচনা করতে চায় বলে জানিয়েছে।
কিন্তু সম্ভাব্য কোনো শান্তি চুক্তির রূপরেখা কী হতে পারে? আর সেই চুক্তির ঝুঁকিগুলোই বা কী?
নিরাপত্তা গ্যারান্টি নিয়ে জটিলতা
২০২২ সালে রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রার আগ্রাসনের শিকার ইউক্রেন বলছে, তাদের অবশ্যই শক্তিশালী আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা গ্যারান্টি প্রয়োজন, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে।
১৯৯৪ সালের বুদাপেস্ট স্মারক অনুযায়ী, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য— ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং বলপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে সম্মত হয়েছিল। তবে ইউক্রেন আক্রান্ত হলে, এই পক্ষগুলো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের শরণাপন্ন হবে – চুক্তিটি শুধু এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল – এতে প্রতিরক্ষার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা ছিল না।
আলোচনায় সম্পৃক্ত সূত্রগুলো বলছে, কার্যকর নিরাপত্তা গ্যারান্টি দেওয়া হলে— তা পশ্চিমা দেশগুলোকে ভবিষ্যতে রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর ঝুঁকিতে ফেলবে। আর দুর্বল নিরাপত্তা গ্যারান্টি হলে ইউক্রেন থাকবে উন্মুক্ত ঝুঁকিতে।
রয়টার্সের হাতে আসা একটি খসড়া চুক্তিতে 'শক্তিশালী নিরাপত্তা গ্যারান্টি'র কথা বলা হয়েছে, যা ন্যাটোর অনুচ্ছেদ ৫-এর মতো হতে পারে। উল্লেখ্য, ন্যাটোর ওই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো সদস্য রাষ্ট্র আক্রান্ত হলে— বাকি সদস্যদের তা প্রতিরোধে এগিয়ে আসার বাধ্যবাধকতা থাকে। যদিও ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয়।
২০২২ সালে প্রস্তাবিত এক চুক্তির অংশ হিসেবে ইউক্রেন স্থায়ী নিরপেক্ষতার প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি হয়েছিল, বিনিময়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য—যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র—এবং বেলারুশ, কানাডা, জার্মানি, ইসরায়েল, পোল্যান্ড ও তুরস্কের মতো দেশগুলো থেকে নিরাপত্তা গ্যারান্টি চেয়েছিল।
তবে কিয়েভের কর্মকর্তারা বলছেন, ইউক্রেনের নিরপেক্ষতার প্রশ্নে তারা কোনো আপস করবে না—এটা তাদের জন্য 'রেড লাইন'।
ন্যাটো ও নিরপেক্ষতার দ্বন্দ্ব
২০০৮ সালের বুখারেস্ট সম্মেলনে ন্যাটো নেতারা বলেছিলেন, একদিন ইউক্রেন ও জর্জিয়া এই জোটে যোগ দেবে। এরপর ২০১৯ সালে ইউক্রেন সংবিধানে সংশোধনী এনে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে পূর্ণ সদস্যপদের পথে অগ্রসর হওয়ার অঙ্গীকার করে।
এদিকে রাশিয়া বারবার বলেছে, ইউক্রেনের সম্ভাব্য ন্যাটো সদস্যপদই যুদ্ধের মূল কারণ, এবং এটি তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। মস্কোর দাবি, ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে—বিদেশি শক্তির কোনো সামরিক ঘাঁটি হলে চলবে না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি স্পষ্ট জানিয়েছেন, ইউক্রেন কার সঙ্গে জোট গড়বে, তা মস্কো ঠিক করবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল কিথ কেলগ বলেছেন, ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ এখন "অজর্নাতীত"। দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেন, অতীতে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদকে সমর্থন দিয়েছিল—সেটাই এ যুদ্ধের কারণ।
২০২২ সালে ইউক্রেন ও রাশিয়া স্থায়ী নিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনা করেছিল। সেই আলোচনায় রাশিয়া ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর আকার ও সক্ষমতা সীমিত করার দাবি তোলে। কিন্তু ইউক্রেন এ ধরনের সীমাবদ্ধতার ঘোরতর বিরোধিতা করে।
রাশিয়া বলেছে, ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ চাইলে তাদের আপত্তি নেই—যদিও ইইউ-এর কিছু সদস্য রাষ্ট্র এ বিষয়ে বিরোধিতা করতে পারে।
ভূখণ্ডগত প্রশ্নে অচলাবস্থা
রাশিয়া বর্তমানে ইউক্রেনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে এবং বলছে, ওই অঞ্চলগুলো এখন আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার অংশ। তবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই তা মানে না।
২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে। রুশ বাহিনী বর্তমানে লুহানস্কের প্রায় পুরোটা এবং দোনেৎস্ক, জাপোরিঝিয়া ও খেরসনের ৭০ শতাংশেরও বেশি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে। মস্কোর বাহিনী খারকিভ অঞ্চলের একটি অংশও নিয়ন্ত্রণ করে।
২০২৪ সালের জুনে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার সবচেয়ে বিস্তারিত শান্তি প্রস্তাবে বলেন, ইউক্রেনকে এসব অঞ্চলের পুরোটা থেকে সরে আসতে হবে—যেসব এলাকা এখনো রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে নেই, সেগুলো থেকেও।
ট্রাম্প প্রশাসন প্রণীত একটি খসড়া শান্তি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র 'আইনগতভাবে' রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলকে স্বীকৃতি দেবে এবং 'বাস্তবভিত্তিক'ভাবে লুহানস্ক ও জাপোরিঝিয়া, দোনেৎস্ক ও খেরসনের অংশবিশেষে রুশ নিয়ন্ত্রণ মেনে নেবে।
তাই সম্ভাব্য ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানে— সম্ভাব্য শান্তি চুক্তির রূপরেখা যতটাই জটিল, ততটাই অনিশ্চিত এর পরিণতি। ইউক্রেনের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন যেমন আপসহীন, তেমনি রাশিয়াও তার দখলকৃত অঞ্চল ছাড়তে নারাজ। ফলে ভবিষ্যৎ শান্তি আলোচনার সাফল্য নির্ভর করছে দুই দেশের কূটনৈতিক নমনীয়তা ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর-ও।