তীব্র হচ্ছে রাশিয়ার ড্রোন হামলা: ইউক্রেনীয়দের মধ্যে আতঙ্ক, মনোবল ভেঙে পড়ছে

একটি বিষয়ে সবাই একমত: পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
ইউক্রেনের অন্যান্য শহরের বাসিন্দাদের মতোই কিয়েভের অধিবাসীরাও অনেক ঝড়-ঝাপ্টা সামলেছেন। সাড়ে তিন বছরের যুদ্ধ পরিস্থিতির নানা উত্থান-পতনে পোড় খেয়ে তারা এখন সহনশীল হয়ে উঠেছেন।
কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে তারা এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন। শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে আকাশপথে ব্যাপক ও সমন্বিত হামলা চালানো হচ্ছে, যা সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট শহরকে কেন্দ্র করে ঘটছে।
গত রাতে লক্ষ্যবস্তু ছিল কিয়েভ। এর আগের সপ্তাহেও তা-ই। এ দুই হামলার ফাঁকে আক্রমণ হয়েছিল দেশের একেবারে পশ্চিমের শহর লুৎস্ক-এ।
তিন বছর আগে ইরানের সরবরাহ করা শাহেদ ড্রোন ছিল নতুন জিনিস। কিন্তু এখন এই ড্রোনের উড়ে যাওয়ার শব্দের সাথে সবাই পরিচিত। এর সবচেয়ে ভয়ংকর আধুনিক রূপটি হলো ডাইভ-বম্বিংয়ের (খাড়াভাবে নিচে নেমে এসে বোমা হামলা) মতো তীব্র আর্তনাদ। একে কেউ কেউ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জার্মান স্তুকা বিমানের শব্দের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসা ড্রোনের আওয়াজ শুনে যুদ্ধের ভয়াবহতায় অভ্যস্ত সাধারণ মানুষও যুদ্ধের প্রথমদিকের মতো ফের বোমা আশ্রয়কেন্দ্র, মেট্রো স্টেশন ও ভূগর্ভস্থ কার পার্কিংয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে।
গত রাতের ভয়াবহ বোমাবর্ষণের পর কিয়েভের বাসিন্দা কাতিয়া বিবিসিকে বলেন, 'বাড়িটা এমভাবে থরথর করে কাঁপছিল, মনে হচ্ছিল যেন কাগজের তৈরি। পুরো রাত আমরা বাথরুমে বসে কাটিয়েছি।'

আরেক বাসিন্দা সভিতলানা বলেন, 'এই প্রথম আমি পার্কিংয়ে আশ্রয় নিতে গিয়েছিলাম। গোটা ভবন কাঁপছিল, আর আমি নদীর ওপারে আগুন জ্বলতে দেখছিলাম।'
এসব হামলায় সবসময় প্রাণহানি না ঘটলেও এগুলো মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, ভেঙে দিচ্ছে তাদের মনোবল।
গত সপ্তাহে কিয়েভের একটি আবাসিক ভবনে হামলার পর হতভম্ব হয়ে পড়েন মারিয়া। প্রবীণ এই নারী বলেন, তার ১১ বছর বয়সি নাতি আশ্রয়কেন্দ্রে তাকে বলেছিল, প্রথমবারের মতো সে মৃত্যুর অর্থ বুঝতে পেরেছে।
তার ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে। ইউক্রেনে জাতিসংঘের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ মিশন (এইচআরএমএমইউ) বলেছে, গত তিন বছরের মধ্যে জুনে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ। এ মাসে ২৩২ জন নিহত এবং ১ হাজার ৩০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।
নিহত ও আহতদের অনেকেই রণাঙ্গনের কাছাকাছি এলাকার বাসিন্দা হলেও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরের শহরের মানুষও প্রাণ হারিয়েছেন।
এইচআরএমএমইউ-এর প্রধান ড্যানিয়েল বেল বলেন, 'দেশজুড়ে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা বেড়ে যাওয়ায় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহু দূরে থাকা বেসামরিক নাগরিকদের জীবনে আরও বেশি মৃত্যু ও ধ্বংস নেমে এসেছে।'
নকশায় কিছু পরিবর্তন আনার ফলে শাহেদ ড্রোন এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি উচ্চতায় উড়তে পারে। পাশাপাশি আরও বেশি উচ্চতা থেকে লক্ষ্যবস্তুর দিকে নেমে আসতে পারে।

এ ড্রোনের পাল্লাও বেড়ে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার হয়েছে। এটি এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি পরিমাণে বিস্ফোরক বহনে সক্ষম (আগের প্রায় ৫০ কেজি থেকে বেড়ে এখন ৯০ কেজি হয়েছে)।
স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের তৈরি করা ট্র্যাকিং ম্যাপে দেখা যায়, শাহেদ ড্রোনের ঘূর্ণায়মান ঝাঁকগুলো অনেক সময় ইউক্রেনের আকাশে এঁকেবেঁকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে তাদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানছে।
এই ড্রোনগুলোর একটি বড় অংশ—প্রায়ই অর্ধেকের মতো—স্রেফ ধোঁকা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করে তার সক্ষমতাকে ছাপিয়ে যাওয়া।
অন্যদিকে ম্যাপের সোজা রেখাগুলো ব্যালিস্টিক বা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের গতিপথ নির্দেশ করে। এগুলোর সংখ্যা অনেক কম হলেও রাশিয়া সবচেয়ে বেশি ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য মূলত এসব অস্ত্রের ওপরেই নির্ভর করে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অভ ওয়ার-এর বিশ্লেষণ অনুসারে, জানুয়ারিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পরের দুই মাসে রুশ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বেড়ে যায়।
মার্চে হামলা কিছুটা কমলেও মাঝে মাঝে হঠাৎ করে বাড়ত। কিন্তু মে মাসে এসে এই সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়।
উদ্বেগজনকভাবে নিয়মিত নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে।

জুনে ৫ হাজার ৪২৯টি ড্রোন হামলার নতুন মাসিক রেকর্ড হয়। জুলাইয়ের প্রথম নয় দিনেই এই সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
রাশিয়ায় উৎপাদন দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকায় কিছু প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, মস্কো হয়তো শিগগিরই এক রাতেই ১ হাজারের বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালানোর সক্ষমতা অর্জন করবে।
কিয়েভের বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, এই ব্যাপক আক্রমণে দেশটি দিশেহারা হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ইভান স্তুপাক বলেন, 'ইউক্রেন যদি এসব ড্রোন মোকাবিলার কোনো উপায় খুঁজে না পায়, তবে ২০২৫ সালে আমাদের বড় সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'কিছু ড্রোন সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে, বাকিগুলো সাধারণ মানুষের অ্যাপার্টমেন্ট ধ্বংস করছে, অফিস ভবনে আছড়ে পড়ছে এবং নাগরিকদের ব্যাপক ক্ষতি করছে।'
ক্ষমতা বাড়লেও এই ড্রোনগুলো প্রযুক্তিগতভাবে খুব উন্নত অস্ত্র নয়। কিন্তু ড্রোনগুলো রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার সম্পদের বিশাল ব্যবধানের আরেকটি নজির।

এই পরিস্থিতি সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন নেতা জোসেফ স্তালিনের সেই বিখ্যাত উক্তিটিকে স্মরণ করিয়ে দেয়: 'পরিমাণ নিজেই একটি স্বতন্ত্র গুণ'।
কিয়েভভিত্তিক ইউক্রেনিয়ান সিকিউরিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন সেন্টার-এর সেরহি কুজান বলেন, 'এটা সম্পদের যুদ্ধ।'
'যখন নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা খুব জটিল হয়ে পড়ছিল—মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়, অসংখ্য যন্ত্রাংশ, সরবরাহের পথও জটিল—তখন তারা এই বিশেষ ধরনের ড্রোনের দিকে মনোযোগ দেয় এবং এতে বিভিন্ন পরিবর্তন ও উন্নতি আনে।'
কুজান বলেন, একটি হামলায় ড্রোনের সংখ্যা যত বেশি থাকে, ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ইউনিটগুলোর জন্য সেগুলো ভূপাতিত করা ততটাই কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে কিয়েভ তাদের মূল্যবান যুদ্ধবিমান ও এয়ার-টু-আর ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে বাধ্য হয়।
'ড্রোনগুলো যখন ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসে, তখন তারা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সব ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে ফেলে,' বলেন তিনি।
এ কারণেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি দেশের আকাশসীমা রক্ষার জন্য মিত্রদের কাছে ক্রমাগত আরও সহায়তা চেয়ে যাচ্ছেন। এই সহায়তা কেবল রাশিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবিলায় অপরিহার্য প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়—বরং আরও বিভিন্ন ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও রয়েছে এর মধ্যে।
বৃহস্পতিবার ব্রিটিশ সরকার জানিয়েছে, তারা ইউক্রেনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করবে। সেই চুক্তির আওতায় কিয়েভকে ৫ হাজারের বেশি আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করা হবে।
আগামী মাসগুলোতে কিয়েভ এরকম আরও অনেক চুক্তির অপেক্ষায় থাকবে।