ইউক্রেন যুদ্ধে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে গ্রীষ্মকালীন আক্রমণে একাধিক ফ্রন্টে হামলা চালিয়ে অগ্রসর হচ্ছে রুশ বাহিনী। জুন মাসে সৈন্যসংখ্যা ও বিমান শক্তির সংখ্যাগত সুবিধা কাজে লাগিয়ে রাশিয়া বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি এলাকা দখলে নেয়।
তবে রাশিয়ার লক্ষ্য কেবল ভূখণ্ড দখল নয়। বিশ্লেষকদের মতে, মস্কোর উদ্দেশ্য হলো ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে ইউক্রেনের সামরিক শক্তিকে পদ্ধতিগতভাবে ধ্বংস করা।
তবে রাশিয়ার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি সম্ভবত যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে—কারণ ক্রমবর্ধমান সামরিক ব্যয়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না রুশ অর্থনীতি।
অন্যদিকে, ইউক্রেনের পক্ষেও যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া নির্ভর করছে ফ্রন্টলাইনের বাইরের অবস্থার ওপর। ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা দেওয়া নিয়ে মিশ্র সংকেত দিচ্ছে। গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ন্যাটো সদস্য দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কিনে তা ইউক্রেনকে দেবে।
স্থল যুদ্ধ
গত দুই মাসে ইউক্রেনের একাধিক অঞ্চলে হামলা জোরদার করেছে রুশ সেনারা। উত্তরের সুমি অঞ্চল থেকে শুরু করে দক্ষিণের জাপোরিঝিয়ার মরুভূমি পর্যন্ত বিভিন্ন ফ্রন্টে তারা আক্রমণ চালাচ্ছে।
বর্তমানে ইউক্রেনের দোনেৎস্ক অঞ্চলের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি অংশ রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে, যা স্থল যুদ্ধের মূল কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে কস্তিয়ানতিনিভকা শহর রক্ষায় থাকা ইউক্রেনীয় সেনাদের চারপাশে প্রায় ১০ মাইল গভীর একটি বেষ্টনী তৈরি করেছে রুশ বাহিনী। পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে শহরটিকে।
এছাড়া, তিন বছরের বেশি সময় পর এবারই প্রথমবারের মতো ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দনিপ্রোপেত্রোভস্ক অঞ্চলেও প্রবেশ করেছে রুশ সেনারা।

মাঠের লড়াইয়ে রাশিয়া মূলত দুটি কৌশল ব্যবহার করছে বলে জানিয়েছেন ইউক্রেনীয় সেনারা। প্রথমে ড্রোন, গোলাবারুদ ও 'গ্লাইড বোম্ব' দিয়ে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে স্থির করে রাখে তারা, এরপর বারবার ছোট ছোট স্কোয়াড পাঠিয়ে সামনে এগোয়।
এমন পরিস্থিতিতে ইউক্রেন যুদ্ধের অভিজ্ঞ ও ড্রোন-সজ্জিত সেনা দল পাঠিয়ে ফাঁকফোকর সামলানোর চেষ্টা করছে, যাকে অনেকেই 'আগুন নেভাতে দমকল পাঠানোর মতো' বলে তুলনা করেছেন।
তবে রাশিয়ার এই ধারাবাহিক আক্রমণে বিশাল ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ছে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী, যাদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
ফলে জুন মাসে রাশিয়া ২০২৫ সালের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভূমি দখলের ঘটনা ঘটিয়েছে। ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা এবং ড্রোন চিত্রের মাধ্যমে যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণকারী 'ডিপ স্টেট' নামের একটি ইউক্রেনীয় গ্রুপ জানায়, শুধু জুনেই রাশিয়া ২১৪ বর্গমাইলের বেশি ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড দখল করেছে। মে মাসে এ পরিমাণ ছিল ১৭৩ বর্গমাইল।
তবে এসব অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে ধীর। প্রতি মাসে ইউক্রেনের মোট ভূখণ্ডের ০.১ শতাংশেরও কম দখল করছে রাশিয়া। এই গতিতে চললে ২০২২ সালে ঘোষিত চারটি ইউক্রেনীয় অঞ্চল পুরোপুরি দখল করতে মস্কোর আরও কয়েক বছর সময় লাগবে।
বিমান যুদ্ধ
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইউক্রেনে হামলায় ব্যবহৃত রুশ ড্রোনের সংখ্যা নতুন রেকর্ড গড়ছে।
গত সপ্তাহে ইউক্রেনের বিমানবাহিনীর তথ্যানুযায়ী, রাশিয়া ৭২৮টি বিস্ফোরক ড্রোন ও ছদ্মবেশী ড্রোন ছুড়েছে। রাশিয়া ড্রোন তৈরির কারখানা বাড়ানোর ফলে সামরিক বিশ্লেষকরা আশা করছেন, শরতে প্রতি হামলায় হাজারের বেশি ড্রোন পাঠাবে মস্কো।
গত সপ্তাহে কিয়েভ ছিল প্রধান লক্ষ্য। স্থানীয় কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, ব্যপক বোমা বর্ষণে কমপক্ষে দুইজন নিহত এবং ২৫ জন আহত হয়েছেন।

রাশিয়া হামলা চালাতে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও ব্যবহার করছে। ইউক্রেনের কাছে বিভিন্ন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে—এমনকি মাছ ধরার জাল দিয়ে ড্রোন আটকের মতো অনুপ্রাণিত পদ্ধতিও ব্যবহার করছে। তবে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আটকানোর মতো সক্ষমতা শুধু আমেরিকার প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাই রাখে।
ট্রাম্প প্রশাসন সামরিক সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার পর এবং ইউরোপীয় মিত্রদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে (যেটি ইউক্রেনকে দেবে) ইউক্রেনের মানুষ নতুন করে আশাবাদী। কিন্তু তারা সাবধানও থাকছেন এই ভেবে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের ওপর ভরসা করতে পারবেন কি-না।
ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশগুলোর কর্মকর্তারা এমন একটি পরিকল্পনা দিয়েছেন যেখানে ট্রাম্প প্রশাসন তার মিত্রদের কাছে অস্ত্র বিক্রি করবে, আর তারা তা ইউক্রেনকে দেবে। এতে যুক্তরাষ্ট্র বড় অর্থ উপার্জন করবে এবং ট্রাম্প সরাসরি যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ থেকে বাঁচতে পারবেন।
গত সপ্তাহে, ট্রাম্প বলেছেন তিনি এই পরিকল্পনাটি গ্রহণ করবেন।
রাশিয়ার লক্ষ্য
রাশিয়া শুধু ইউক্রেনের নতুন এলাকা দখল করতে চায় না।
রেডাক্তসিয়া নামের এক স্বাধীন রুশ সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীন রুশ সামরিক বিশ্লেষক ভ্যালেরি শিরিয়ায়েভ বলেন, 'রাশিয়ার মূল লক্ষ্য হলো ইউক্রেনের সামরিক শক্তি ধ্বংস করা, তার সেনাবাহিনী গুঁড়িয়ে দেওয়া। সেনাবাহিনী না থাকলে দেশটি একেবারে অসহায় হয়ে পড়বে।'
ক্রেমলিন বহুবার বলেছে, তারা ইউক্রেনে অভিযান চালিয়ে যাবে যতক্ষণ না কিয়েভ মস্কোর শান্তি শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়। রাশিয়ার দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে— ইউক্রেন যেন রাশিয়ার দখলকৃত অঞ্চলকে স্বীকৃতি দেয়, সেনাবাহিনী ছোট করে ফেলে, রুশ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং নিরপেক্ষতা ঘোষণা করে— যাতে ইউক্রেন ভবিষ্যতে ন্যাটোতে যোগ দিতে না পারে।
এই সব দাবি ইউক্রেনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জনগণের কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। তবে যুদ্ধ শুরুর পর প্রথমবারের মতো সম্প্রতি ইস্তাম্বুলে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সরাসরি আলোচনা হয়েছে। সেখানে রুশ প্রতিনিধি দল স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে, মস্কো তাদের চাওয়া না পাওয়া পর্যন্ত চাপ বজায় রাখবে।
রুশ অর্থনীতি
বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া যুদ্ধ চালাতে এত বেশি খরচ করছে যে তা আর অর্থনৈতিকভাবে টেকসই নয়। এতে দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। এদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শুল্কারোপের কারণে জ্বালানি তেলের দাম কমে গেছে। এর ফলে রাশিয়ার তেল ও গ্যাস খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাশিয়ার মোট বাজেটের এক-তৃতীয়াংশই আসে তেল রপ্তানি থেকে।
জুন মাসের শেষে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জানান, দেশটি জিডিপির ৬.৩ শতাংশ বা ১৭২.৫ বিলিয়ন ডলার সামরিক খাতে ব্যয় করছে, যা 'অনেক বেশি'। তিনি স্বীকার করেন, 'এই খরচের মূল্য মুদ্রাস্ফীতির মাধ্যমে দিতে হয়েছে'। মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার ২০ শতাংশে বেঁধে দিয়েছে।

পুতিন আরও বলেন, 'আমরা আগামী বছর এবং তার পরের দুই বছরে সামরিক খরচ কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছি।'
যদি পুতিন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন এবং সামরিক খরচ কমে যায়, তাহলে যুদ্ধ চালানোর ক্ষমতা অনেকটা কমে যাবে।
রাশিয়ার অর্থনীতি নিয়ে টেলিগ্রামে জনপ্রিয় একটি চ্যানেল এম.এম.আই. এই বাজেট পরিস্থিতিকে আখ্যা দিয়েছে 'বিপর্যয়' হিসেবে।
দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রেকর্ড পরিমাণ সামরিক খরচের কারণে বছরের প্রথম ছয় মাসেই রাশিয়ার বাজেট ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪৭ বিলিয়ন ডলারে। তেলের দাম কমে যাওয়ায় তেল ও গ্যাস থেকে আয় কমেছে ১৬ শতাংশের বেশি।
তবে রাশিয়ার 'রেইনি ডে ফান্ড'-এ এখনো ৫২.৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদ রয়েছে, যার সাহায্যে চলতি বছরের বাজেট ঘাটতি কিছুটা সামাল দেওয়া সম্ভব। তবে রুশ জ্বালানি ও অর্থনীতিবিদ কিরিল রোদিওনভ বলছেন, আগামী বছর কেমন খরচ করবে তা নিয়ে ক্রেমলিনকে 'গুরুতরভাবে ভাবতে হবে'।
ক্ষয়ক্ষতি
যুদ্ধের শুরুতে সরকারিভাবে কয়েকবার মৃত্যুর সংখ্যা প্রকাশ করা হলেও, রাশিয়া পরে আর কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। তবে গবেষক ও বিশ্লেষকদের একটি দল বিভিন্ন প্রকাশ্য তথ্য—যেমন মৃত্যুসংবাদ ও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত নথি ঘেঁটে রুশ সেনাদের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে। এখন পর্যন্ত তারা ১ লাখ ১৫ হাজারের বেশি রুশ সেনা নিহত হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে।

চলতি বছরের জুনে এক গবেষণায় বলা হয়, যুদ্ধের শুরু থেকে প্রায় ১০ লাখ রুশ সেনা নিহত বা আহত হয়েছে।
রাশিয়ার স্বাধীন সংবাদমাধ্যম মেদুজার [এটি এখন লাটভিয়া থেকে পরিচালিত হয় এবং রাশিয়ায় নিষিদ্ধ] সামরিক বিশ্লেষক দিমিত্রি কুজনেতস জানান, প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এখন রাশিয়া ও ইউক্রেন প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ জন সেনা হারাচ্ছে।
তবে সরকারি তথ্য ও বাজেট বিশ্লেষণের ভিত্তিতে জার্মানির আন্তর্জাতিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণা সংস্থার গবেষক ইয়ানুস ক্লুগে জানান, এ বছর এখন পর্যন্ত রাশিয়া গড়ে প্রতি মাসে ৩০ হাজার নতুন সেনা সংগ্রহ করতে পেরেছে। তবে এর জন্য রাশিয়াকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে, সেনা ভর্তির জন্য বড় অঙ্কের বোনাস ও উচ্চ বেতন দিতে হয়েছে।
কুজনেতস বলেন, 'গত এক বছরে উভয় দেশই এমনভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে যেন যুদ্ধে যাই হোক, তারা লড়াই চালিয়ে যেতে পারে।'