‘যুদ্ধ কোনো বলিউড সিনেমা না’; কূটনীতিক পথেই সমাধান: ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান নারাভানে

ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে সংঘাত স্থগিত নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলছেন, তাদের কড়া সমালোচনা করেছেন ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ নারাভানে। তিনি বলেন, 'যুদ্ধ কোনো রোমান্টিক বা আবেগতাড়িত বিষয় নয়, এটি কোনো বলিউড সিনেমাও নয়।'
গত রোববার (১১ মে) পুনেতে ইন্সটিটিউট অব কস্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব ইন্ডিয়া আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য এমন মন্তব্য করেন নারাভানে। তিনি বলেন, যুদ্ধের নির্দেশ পেলে তিনি অবশ্যই যাবেন, তবে তার প্রথম পছন্দ হবে কূটনীতি।
সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল নারাভানে জানান, গেল এক সপ্তাহ উভয় দেশেরই পরিস্থিতি ছিল খুবই উত্তেজনাপূর্ণ। 'অপারেশন সিন্দুর' এর মাধ্যমে পাকিস্তান ও পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে সন্ত্রাসী ঘাঁটি ও অবকাঠামোর ওপর ভারতীয় বাহিনীর হামলা দিয়ে এর শুরু, এরপর টানা চার দিন ধরে আকাশপথে ও কিছু এলাকায় স্থলযুদ্ধ হয়েছে।
তিনি বলেন, 'শেষ পর্যন্ত সামরিক অভিযান স্থগিতের ঘোষণা এসেছে। তবে এটা পুরোপুরি যুদ্ধবিরতি নয়—শুধু সাময়িকভাবে লড়াই বন্ধ রাখা হয়েছে। সামনে পরিস্থিতি কীভাবে এগোয়, সেটি এখন দেখার বিষয়।'
তবে অনেকেই উভয় দেশের সামরিক সংঘাত স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল কিনা, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন।
যুদ্ধবিরতির সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, 'যদি আপনি যুদ্ধের খরচ ও ক্ষয়ক্ষতির দিকটা বিবেচনা করেন, তাহলে বুঝবেন—বুদ্ধিমান ব্যক্তিরাই সময় থাকতে যুদ্ধ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন, যখন ক্ষয়ক্ষতি সীমার মধ্যে থাকে।'
নারাভানে বলেন, 'আমরা পাকিস্তানকে দেখিয়ে দিয়েছি যে, শুধু জঙ্গি ঘাঁটি নয়, তাদের ভেতরের বিমানঘাঁটিতেও আমরা আঘাত হানতে পারি। তারা বুঝতে পেরেছে, এই পথে চলা তাদের জন্য কতটা ব্যয়বহুল হতে পারে। আর শেষ পর্যন্ত তারাই আমাদের ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশনস (ডিজিএমও)-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়।'
নারাভানে জানান, যুদ্ধের আরেকটি দিক আছে, যেটা হয়তো মানুষ খুব একটা বিবেচনা করে না—সামাজিক প্রভাব।
'শুধু শক্তি ও ধ্বংস নয়, এই দিকটাও গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধ মানে জীবন হারানো—সীমান্তে বোমার আঘাতে শিশুরা বাবা-মা হারায়, আবার কেউ নিজের জীবনই হারায়। এই ক্ষয়ক্ষতির কোনো হিসাব রাখা হয় না।'
তিনি বলেন, যুদ্ধে যারা প্রিয়জন হারান, তাদের মানসিক আঘাত বহু প্রজন্ম ধরে বহন করতে হয়। 'পিটিএসডি বলে একটা বিষয় আছে। কেউ যদি ভয়ংকর কোনো দৃশ্য দেখেন, ২০ বছর পরও হঠাৎ মাঝরাতে ঘেমে জেগে উঠতে পারেন, তার জন্য মানসিক চিকিৎসা লাগে,' যোগ করেন তিনি।
নারাভানে বলেন, 'যুদ্ধ কোনো বলিউড সিনেমা নয়। এটি অত্যন্ত ভয়ানক, বাস্তব এবং গুরুতর একটি বিষয়। যুদ্ধ বা সহিংসতা আমাদের শেষ বিকল্প হওয়া উচিত। তাই আমাদের প্রধানমন্ত্রী (নরেন্দ্র মোদি) ঠিকই বলেছেন—এটি যুদ্ধের যুগ নয়। যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার মত পরিস্থিতি উদ্ভূত হলে আমরা অবশ্যই তা মোকাবিলা করব, কিন্তু যুদ্ধকে উৎসাহ দেওয়া কখনই ঠিক নয়।'
কূটনীতি ও সংলাপের মাধ্যমে বিরোধ মেটানোর ওপর গুরুত্ব দেন নারাভানে। তিনি বলেন, 'যুদ্ধ পরিস্থিতি উদ্ভূত হলেও আমি চাইব কূটনৈতিক সমাধান। যেকোন দ্বন্দ্বের সমাধান করা উচিত আলোচনার মাধ্যমে, যাতে সশস্ত্রবাহিনীর সংঘাতের মত পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়।'
নারাভানে বলেন, 'আমরা সবাই জাতীয় নিরাপত্তার সমান অংশীদার। আমাদের উচিত, শুধুমাত্র দেশগুলোর মধ্যে নয়, বরং নিজেদের মধ্যেও—পারিবারিক, রাজ্য, অঞ্চল বা সম্প্রদায়ের মধ্যে যেসব দ্বন্দ্ব রয়েছে তা শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা। সহিংসতা কখনই কোনো সমাধান হতে পারে না।'
তিনি ভারতের জাতীয় বাজেটে প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর যুক্তিও তুলে ধরেন। নারাভানে বলেন, 'গান ভার্সেস বাটার' (বন্দুক নাকি মাখন) বিতর্কটা অনেক পুরনো—অর্থাৎ প্রতিরক্ষা না মৌলিক চাহিদা?
তিনি আরও বলেন, 'একটি দেশ প্রতিরক্ষার পেছনে কতটা ব্যয় করবে, সেটা সবসময়ই আলোচনার বিষয়। বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশনসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ খাতে সমানভাবে বরাদ্দ প্রয়োজন।'
নারাভানে জানান, ভারতের জাতীয় বাজেটের প্রায় ১৫ শতাংশই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ থাকে। এবং দেশের স্বার্থে এই বিনিয়োগটি অত্যাবশ্যক।
তিনি বলেন, 'অনেকে হয়তো বলবেন, এত অর্থ খরচ করে আসলে কী লাভ? এটি তো স্রেফ অপচয়, এর কী কোনো বাস্তব প্রয়োজন আছে? আমি বলব, এই ব্যয়কে বিমার প্রিমিয়ামের মতো দেখুন। দুর্ঘটনা কখনও পূর্বঘোষণা দিয়ে আসে না। দুর্ঘটনার পরে বিমার অর্থ আসে, একইভাবে দেশের সশস্ত্র বাহিনী প্রস্তুত থাকলে সেই দুর্ঘটনাই ঠেকানো যায়।'
সাবেক জেনারেল নারাভানে বলেন, 'জরুরি পরিস্থিতিতে একটি দেশের বিকল্প পরিকল্পনা থাকা খুবই দরকার, আর গত সপ্তাহের ঘটনাতে তার গুরুত্ব আমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছি। সেনাবাহিনীতে বিনিয়োগ করলে যুদ্ধ বা আগ্রাসনের মত পরিস্থিতি ঘটার আগেই ঠেকানো সম্ভব হয়।'
আলোচনার শেষে তিনি বলেন, 'আপনি যদি প্রস্তুত থাকেন, তাহলে কেউ আপনাকে আক্রমণের আগে দুবার ভাববে।'
অনুবাদ: আয়েশা হুমায়রা ওয়ারেসা