৫ আগস্টের স্থবিরতার পর রাজশাহী হাইটেক পার্কে বিনিয়োগে নতুন গতি

গত বছর কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে রাজশাহী হাইটেক পার্ক দেশি-বিদেশি কোম্পানির কাছে বিনিয়োগ আকর্ষণের স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি বছরে মার্কিন প্রতিষ্ঠান স্টারলিংক এই হাইটেক পার্কে ৪০ বছরের জন্য এক একর জমি ইজারা নিয়েছে। এরজন্য কোম্পানিটি প্রতি বর্গমিটারে বছরে ২ ডলার হারে ভাড়া ও সার্ভিস চার্জ দেবে।
স্টারলিংকের পাশাপাশি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান অগ্নি সিস্টেমস লিমিটেডও এখানে এক একর জমি পেয়েছে। একইসঙ্গে ব্র্যাক আইটি-কে জমি বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। সম্প্রতি ব্র্যাকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ সালেহ পার্কটি পরিদর্শন করেছেন। প্রতিষ্ঠানটি তাদের ৬৫০ জন আইটি ডেভেলপারকে স্থানান্তরের জন্য দুই একর জমি চেয়েছে।
জানা গেছে, ১২ তলা সিলিকন টাওয়ার বিশিষ্ট রাজশাহী হাইটেক পার্কে বরাদ্দযোগ্য মোট রেডি স্পেসের পরিমাণ ৮৪,৬৬১ বর্গফুট। এই টাওয়ারের দশম তলায় ১২,৬১২ বর্গফুট স্পেস বরাদ্দ নেওয়ার জন্য চুক্তি সই করেছে চালডাল কোম্পানি। বরাদ্দ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
চালডাল সেখানে তাদের আইটি বিজনেস, বিশেষ করে আইটি সেন্টার ও কল সেন্টার গড়ে তুলবে, যেখানে প্রায় ৭০০ জনের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়া নবম তলায় একই পরিমাণ স্পেস বরাদ্দ নেওয়ার জন্য চুক্তি সই করেছে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। তাদের বরাদ্দ প্রক্রিয়াও চলছে। প্রতিষ্ঠানটি সেখানে কল সেন্টার ও আইটি সেন্টার গড়ে তুলবে।
স্টারলিংকের ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ও ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশের বন্ডস্টাইন টেকনোলজিস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর শাহরুখ ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে জানান, "স্টারলিংক রাজশাহী হাইটেক পার্কে যে অপারেটিভ কার্যক্রম শুরু করতে চায়, তার পাঁচভাগের একভাগও এখনো শুরু হয়নি। এখন পর্যন্ত মাত্র ১০টি অ্যান্টেনা বসানো হয়েছে, আরও ৩০টি অ্যান্টেনা বসানো হবে।"
তিনি জানান, এপ্রিলে প্লট বরাদ্দ পাওয়ার পর জুলাই পর্যন্ত সময় লেগেছে গ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণে; ইতোমধ্যেই এটি সম্পন্ন হয়েছে। এই গ্রাউন্ড স্টেশনের মাধ্যমে স্টারলিংক সারাদেশে তাদের নেটওয়ার্কিং সেবা প্রদান করবে।

রাজশাহী হাইটেক পার্ক ছাড়াও গাজীপুরের কালিয়াকৈর হাইটেক পার্ক ও যশোর হাইটেক পার্কে স্টারলিংক গ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণ করেছে, যেগুলো থেকে কমিশনিং (অপারেশন) করা সম্ভব হবে।
রাজশাহী হাইটেক পার্কের ডেপুটি ডিরেক্টর মাহফুজুল কবির জানান, "হাইটেক পার্কের সিলিকন টাওয়ারের সামনে ৮টি প্লট রয়েছে, যেগুলো বড় কোম্পানিগুলোকে বরাদ্দ দেওয়া হবে। আশা করছি, ডিসেম্বরের মধ্যে পার্কে উল্লেখযোগ্য অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হবে।"
রাজশাহী হাইটেক পার্কের তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী নগরীর কোর্ট এলাকার পাশে পদ্মা নদীর তীরে ৩১ একর জমির ওপর ৩৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে রাজশাহী হাইটেক পার্ক। ২০২৪ সালের ৩০ জুন 'হাই-টেক পার্ক রাজশাহী স্থাপন প্রকল্প'-এর মেয়াদ শেষ হয় এবং বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ পার্কটির দায়িত্ব গ্রহণ করে।
গত বছরের ৫ আগস্টের আগে রাজশাহী হাইটেক পার্কে হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানি কার্যক্রম চালাচ্ছিল। এরমধ্যে স্টার সিনেপ্লেক্স, নেত্র সিস্টেমস লিমিটেড ও বিজনেস অটোমেশন উল্লেখযোগ্য। তবে ৫ আগস্টের ব্যাপক লুটপাটের ঘটনার পর স্টার সিনেপ্লেক্স এখনও বন্ধ রয়েছে। ওই ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটি প্রায় তিন কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হয়।
স্টার সিনেপ্লেক্স বন্ধ থাকলেও অন্যান্য কোম্পানি ক্ষতি কাটিয়ে আবারও পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করেছে।
নেত্র সিস্টেমস-এর সিইও আসিক মোহাম্মদ জানিয়েছেন, লুটপাটে তাদের ২৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে এবং টানা তিন মাস কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হয়েছে। এ সময় তারা অস্থায়ীভাবে হোম অফিস করে কাজ চালিয়েছেন।
তার মতে, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এলে হাইটেক পার্কের কার্যক্রম আরও প্রসারিত হবে এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। বিশেষ করে বর্তমানের ফ্রিল্যান্সিং-কেন্দ্রিক কার্যক্রমের পাশাপাশি সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের কাজ বৃদ্ধি পেলে এর সুফল আরও বেশি পাওয়া যাবে।
বিজনেস অটোমেশন লিমিটেড-ও প্রায় ৩০ লাখ টাকার ক্ষতির শিকার হয়েছে। এরইমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে অফিস নতুনভাবে সাজিয়ে কাজ শুরু করেছে।
তবে অবকাঠামোগত সমস্যা এখনও রয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানের এইচআর এক্সিকিউটিভ রুবায়াত জামান আবির জানান, ঘনঘন বৈদ্যুতিক সাবস্টেশনের ত্রুটির কারণে সার্ভার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, ফলে কাজ স্থগিত থাকে। নিরাপত্তাও পর্যাপ্ত নয়; সিসিটিভি স্থাপন এখনো সম্পন্ন হয়নি এবং বর্তমানে সুরক্ষার জন্য স্থানীয় কর্মীদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও রাজশাহী হাইটেক পার্ক স্থানীয় তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করছে উল্লেখ করে চালডাল-এর সিইও জিয়া আশরাফ জানান, তারা দক্ষ তরুণ পেশাজীবীদের নিয়োগ দেওয়ার আশা করছেন, বিশেষ করে গ্রাফিক ডিজাইন, টেক সাপোর্ট এবং হার্ডওয়্যার খাতে। শিক্ষানগরী হিসেবে রাজশাহীর সুনাম এবং স্থানীয়ভাবে কাজ করার আগ্রহী মেধাবী জনশক্তি এই আশাকে আরও জোরদার করছে।
এদিকে প্রাণ-আরএফএল-এর জিএম তানভীর হোসেন জানিয়েছেন, ফ্লোর বরাদ্দ চূড়ান্ত হলে তারা আইটি বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং, গ্রাফিক ডিজাইন এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করার পরিকল্পনা করেছেন।
বর্তমানে সিলিকন টাওয়ারের ১৮টি ব্লকে ১৬টি কোম্পানি কার্যক্রম পরিচালনা করছে, এর মধ্যে ১১টি ইতোমধ্যে চালু হয়েছে এবং বাকিগুলো উদ্বোধনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাশাপাশি, পার্শ্ববর্তী আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টারে ৭টি সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।
এদিকে, গত ৫ আগস্টের লুটপাটের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিক হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩২ কোটি টাকা, যার বড় অংশই স্টার সিনেপ্লেক্স ও সংশ্লিষ্ট সম্পদের।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে হাইটেক পার্কের ডেপুটি ডিরেক্টর মাহফুজুল কবির বলেন, "আমরা প্রায় ধ্বংসস্তূপ থেকে এই পার্ককে পুনরুজ্জীবিত করেছি। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে রাজশাহী হাইটেক পার্কে কার্যক্রম ও কর্মসংস্থানের বড় ধরনের উত্থান ঘটবে বলে আশা করছি।"
হাইটেক পার্কে ধারাবাহিক প্লট বরাদ্দ এবং দেশীয় শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি কোম্পানির ক্রমবর্ধমান আগ্রহ রাজশাহীকে প্রযুক্তি হাব হিসেবে গড়ে তোলার সম্ভাবনাকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে বলে আশা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিনিয়োগকারীরা।