রাশিয়া কেন আলাস্কাকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করেছিল?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন শুক্রবার আলাস্কায় বৈঠকে বসেন। আলোচনার মূল বিষয় ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান। এর আগে বুধবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিসহ ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে এক ভার্চুয়াল বৈঠকের পর ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দেন যে, তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলা এই যুদ্ধে পুতিন যদি যুদ্ধবিরতিতে রাজি না হন, তাহলে তাকে 'চরম পরিণতি' ভোগ করতে হবে।
এই হাই-প্রোফাইল বৈঠকের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে আলাস্কার সবচেয়ে বড় শহর অ্যাঙ্করেজের উত্তরে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটি জয়েন্ট বেস এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসনকে। এটি আলাস্কার বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি, যা প্রায় ৬৪,০০০ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এবং আর্কটিক অঞ্চলে মার্কিন সামরিক মহড়া ও প্রস্তুতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২০১৯ সালে প্রথম মেয়াদে এই ঘাঁটি পরিদর্শনের সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, এখানকার সেনারা "দেশের শেষ সীমান্তে আমেরিকার প্রতিরক্ষার প্রথম সারিতে" কাজ করে।
কিন্তু পরিস্থিতি সবসময় এমন ছিল না। মজার ব্যাপার হলো, এই আলাস্কাই যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার কাছ থেকে কিনে নেয়। ১৮৬৭ সালে এই ঐতিহাসিক কেনাবেচা সম্পন্ন হয়। বেরিং প্রণালীর সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশে দেশ দুটির দূরত্ব মাত্র ৯০ কিলোমিটার (৫৫ মাইল)।
গত ৯ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতির সহকারী ইউরি উশাকভ উল্লেখ করেন যে, দেশ দুটি প্রতিবেশী। তিনি বলেন, "আমাদের প্রতিনিধিদলের জন্য বেরিং প্রণালী পার হয়ে আলাস্কায় দুই দেশের নেতাদের এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈঠক করা বেশ যৌক্তিক।"
রাশিয়া কীভাবে আলাস্কার দখল নিয়েছিল?
১৭২৫ সালে রুশ জার পিটার দ্য গ্রেট যখন ড্যানিশ নাবিক ভিটাস বেরিংকে আলাস্কার উপকূল অনুসন্ধানের জন্য পাঠান, তখন থেকেই এই অঞ্চলের প্রতি রাশিয়ার ব্যাপক আগ্রহ ছিল। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই অঞ্চলে জনবসতি ছিল খুবই কম এবং সেখানে পাওয়া যেত দামি সামুদ্রিক ভোঁদড়ের চামড়া।

এরপর ১৭৯৯ সালে সম্রাট প্রথম পল 'রাশিয়ান-আমেরিকান কোম্পানি' নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে আলাস্কায় শাসনের একচেটিয়া অধিকার দেন। এই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় থাকা দলটি বসতি স্থাপন করে, যা ১৮০৪ সালে স্থানীয় ত্লিংগিত উপজাতিকে নির্মমভাবে পরাজিত করার পর রাশিয়ার উপনিবেশিক রাজধানীতে পরিণত হয়।
তবে আলাস্কায় রাশিয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা দ্রুতই নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। তৎকালীন রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে বিশাল দূরত্ব, প্রতিকূল আবহাওয়া, রসদ সংকট এবং আমেরিকান অভিযাত্রীদের সাথে বাড়তে থাকা প্রতিযোগিতা ছিল এর অন্যতম কারণ।
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম দিকে সম্প্রসারিত হতে থাকলে আমেরিকানরা রুশ ব্যবসায়ীদের মুখোমুখি হতে শুরু করে। এর উপর, প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে বড় বসতি এবং সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখার মতো পর্যাপ্ত সম্পদ রাশিয়ার ছিল না। এরপর উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই অঞ্চলের ইতিহাসে নাটকীয় পরিবর্তন আসে।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর রাশিয়া কেন আলাস্কা বিক্রি করে দেয়?
ক্রিমিয়ার যুদ্ধ (১৮৫৩-১৮৫৬) শুরু হয় যখন রাশিয়া তুরস্কের দানিউব অঞ্চলের মলদাভিয়া ও ওয়ালাচিয়ায় (বর্তমান রোমানিয়া) আক্রমণ করে। রাশিয়ার বাণিজ্যিক পথে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে শঙ্কিত হয়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্স দুর্বল অটোমান সাম্রাজ্যের সঙ্গে হাত মেলায়।
যুদ্ধের মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ। ব্রিটিশ ও ফরাসি বাহিনী কৃষ্ণ সাগরে রুশ অবস্থানগুলোতে হামলা চালায়। তিন বছর পর, রাশিয়া এই যুদ্ধে অপমানজনকভাবে হেরে যায়, যা তাদের উপনিবেশিক নীতি পুনর্মূল্যায়ন করতে বাধ্য করে। আমেরিকান পিস সোসাইটির একটি জার্নাল 'অ্যাডভোকেট ফর পিস'-এর হিসাব অনুযায়ী, রাশিয়া সেই যুদ্ধে আজকের দিনের ১৬ কোটি পাউন্ড স্টার্লিংয়ের সমপরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছিল।
অন্যদিকে, অতিরিক্ত শিকারের কারণে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আলাস্কা থেকে আয় প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া, ব্রিটিশ-নিয়ন্ত্রিত কানাডার কাছাকাছি হওয়ায় ভবিষ্যতে ইঙ্গ-রুশ সংঘাতে এটি একটি বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারত।
১৮৬০-এর দশকের শুরুতে জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, আলাস্কা বিক্রি করলে একদিকে যেমন রাশিয়ার জরুরি অর্থের যোগান হবে, তেমনি ভবিষ্যতে ব্রিটিশদের হাত থেকে এটিকে রক্ষা করা যাবে। মহাদেশজুড়ে নিজেদের সীমানা বাড়ানো যুক্তরাষ্ট্র তখন একজন ইচ্ছুক ক্রেতা হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং এর ফলেই ১৮৬৭ সালে আলাস্কা বিক্রি সম্পন্ন হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে এই কেনাবেচার প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
১৮৬৫ সালে আমেরিকার গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম সিওয়ার্ড আলাস্কা কেনার জন্য রাশিয়ার দীর্ঘদিনের প্রস্তাবে সাড়া দেন। ১৮৬৭ সালের ৩০ মার্চ ওয়াশিংটন ৭২ লক্ষ ডলারে রাশিয়ার কাছ থেকে আলাস্কা কিনে নিতে রাজি হয়।
প্রতি একর জমির জন্য ২ সেন্টেরও কম দামে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ১৫ লক্ষ বর্গকিলোমিটার (৬ লক্ষ বর্গমাইল) জমি পায় এবং প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তরাঞ্চলে নিজেদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে। কিন্তু আলাস্কা কেনার বিরোধীরা এই বিশাল বরফ ঢাকা অঞ্চলের তেমন কোনো মূল্য দেখতে পাননি। তারা এটিকে 'সিওয়ার্ডের বোকামি' বা 'সিওয়ার্ডের বরফ বাক্স' বলে উপহাস করতে থাকেন।
'নিউ ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন' ১৮৬৭ সালের এপ্রিলে লেখে, "এই চুক্তির মাধ্যমে আমরা কেবল দুর্গম বরফের মরুভূমি, খর্বাকৃতির কাঠের বিশাল অঞ্চল এবং সিটকা দ্বীপপুঞ্জের নামমাত্র দখল পেয়েছি। বাকি সবটাই অনুর্বর ভূমি।"
কিন্তু ১৮৯৬ সালের ক্লোনডাইক গোল্ড রাশ বা স্বর্ণ অনুসন্ধানের হিড়িক কঠোর সমালোচকদেরও বোঝাতে সক্ষম হয় যে, আলাস্কা মার্কিন ভূখণ্ডের জন্য একটি মূল্যবান সংযোজন ছিল। সময়ের সাথে সাথে আলাস্কার কৌশলগত গুরুত্ব ধীরে ধীরে স্বীকৃত হয় এবং অবশেষে ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে আলাস্কা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়।
এখন আলাস্কার অর্থনীতি কেমন?
বিশ শতকের গোড়ার দিকে আলাস্কার অর্থনীতি স্বর্ণের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। স্যামন ও হ্যালিবুট মাছের বাণিজ্যিক শিকার একটি প্রধান শিল্পে পরিণত হয় এবং কেনেকটের মতো জায়গায় তামার খনির ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে।
এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের ফলে অবকাঠামোগত উন্নতি হয় এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ১৯৬৮ সালে, যখন আর্কটিক উপকূলের প্রুধো বে-তে বিশাল তেলের রিজার্ভ আবিষ্কৃত হয়।
তেল থেকে অর্জিত রাজস্ব আলাস্কার অর্থনীতির মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে। এই অর্থ দিয়ে সরকারি পরিষেবা চালানো হয় এবং 'আলাস্কা পার্মানেন্ট ফান্ড' গঠন করা হয়, যা রাজ্যের বাসিন্দাদের প্রতি বছর লভ্যাংশ দিয়ে থাকে। এই ব্যবস্থার কারণে আলাস্কায় কোনো রাজ্য আয়কর বা বিক্রয় কর নেই, যা যুক্তরাষ্ট্রে একটি বিরল ঘটনা।
সম্প্রতি, আলাস্কায় পর্যটন শিল্পও দ্রুত বিকশিত হয়েছে, যা রাজ্যের জাতীয় উদ্যান এবং হিমবাহ দেখতে পর্যটকদের আকর্ষণ করছে। আজ, একসময়ের উপহাসের পাত্র আলাস্কা প্রাকৃতিক সম্পদ, মৎস্য এবং পর্যটনের ওপর ভিত্তি করে একটি সমৃদ্ধ রাজ্যে রূপান্তরিত হয়েছে।
এদিকে, একসময় মুদ্রা বা পণ্যের মতো জমির হাতবদল হলেও, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি আশা করছেন, ট্রাম্প ও পুতিনের মধ্যকার বৈঠকটি যেন ইউক্রেনের ভূখণ্ড হারানোর বিনিময়ে না হয়।