চাকরির সংকট: বেকারত্ব লুকাতে নিজ পকেটের টাকা ঢেলেই অফিসে কাজের ভান করছেন চীনা তরুণরা

এমন এক চাকরি যেখানে আপনি কোনও বেতন পাবেন না। কোনও পদ নেই, নেই কোনও পদোন্নতির সুযোগ। শুধু খালি ডেস্ক, একটি ল্যাপটপ আর সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অফিসে বসে থাকার জন্য উল্টো আপনাকেই নিজের পকেট থেকে টাকা ঢালতে হবে!
রসিকতা মনে হলেও চীনের কিছু শহরে এটি এখন বাস্তবের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর এক কৌশল। চীনের শহরাঞ্চলে যুবকদের বেকারত্বের হার এখনও ১৪ শতাংশেরও বেশি। আর চাকরির বাজার ক্রমশই কঠিন হয়ে উঠছে।
সমাজে সম্মান বজায় রাখা, আত্মমর্যাদা রক্ষা এবং পরিবার বা পরিচিতদের কাছে 'ব্যর্থ' না দেখানোর জন্য বেকার অনেক যুবকই এমন অভিনব উপায়ে নিজেদের ব্যস্ত রাখছে। বাস্তব চাকরি পাওয়া কঠিন হওয়ায়, কিছু তরুণ নিজের বাড়িতে বসে থাকার পরিবর্তে অফিসে গিয়ে 'চাকরি করার অভিনয়' করতে টাকা দিতে রাজি হচ্ছে।

৩০ বছর বয়সি শুই ঝোউ আগে একজন উদ্যোক্তা ছিলেন। ২০২৪ সালে তার খাবারের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর নতুন করে পথ খুঁজতে তিনি চলতি বছরের এপ্রিল থেকে তিনি চীনের ডংগুয়ান শহরে 'প্রেটেন্ড টু ওয়ার্ক কোম্পানি' নামে এক অফিসে যেতে শুরু করেন। এর জন্য তিনি দিনে প্রায় ৪ ডলার ২০ সেন্ট খরচ করছেন।
সেখানে তিনি আরও পাঁচজন 'সহকর্মী'-এর সঙ্গে যোগ দেন, যারা একই রকমভাবে অফিসে বসে 'চাকরির অভিনয় করছেন।
এ ধরনের অফিস এখন চীনের শেনজেন, সাংহাই, নানজিং, উহান, চেংদু এবং কুনমিং-এর মতো বড় বড় শহরগুলোতে দেখা যাচ্ছে। এই অফিসগুলো দেখতে পুরোপুরি আসল বাস্তব অফিসের মতোই, যেখানে কম্পিউটার, ইন্টারনেট সংযোগ, মিটিং রুম এবং চায়ের ব্যবস্থাও আছে।
শুধু বসে না থেকে অনেক সময় তারা কম্পিউটার ব্যবহার করে চাকরি খুঁজতে পারেন বা নিজেদের ব্যবসা শুরুর চেষ্টা চালাতে পারেন। এছাড়াও ৩০ থেকে ৫০ ইউয়ানের মধ্যে দুপুরের খাবার, এবং পানীয়র ব্যবস্থা থাকে নকল অফিসগুলোতে।
শুই ঝোউ অফিসে কাজ করার ছবি তার বাবা-মাকে পাঠান। তিনি বলেন, এতে তার বাবা-মা তার বেকারত্ব নিয়ে অনেকটাই স্বস্তি অনুভব করেন।
এই নকল অফিসগুলোতে যে কোনো সময় যাওয়া-আসা করা যায়। কিন্তু শুই ঝোউ সাধারণত সকাল ৮–৯টার মধ্যে অফিসে পৌঁছান। কখনও কখনও রাত ১১টা পর্যন্ত থাকেন।
তিনি বলেন, ওখানকার মানুষ এখন তার বন্ধুদের মতো। কেউ ব্যস্ত থাকলে, যেমন চাকরি খোঁজা, তখন সবাই কঠোর পরিশ্রম করে, কিন্তু অবসর সময়ে আড্ডা দেয়, মজা করে, খেলাধুলা করে। প্রায়ই কাজ শেষে একসাথে রাতের খাবারও খান।
জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল অ্যানথ্রোপোলজির পরিচালক ড. বিআও শিয়াং বলেন, চীনের এই 'চাকরি করার অভিনয়' মূলত চাকরির অভাবে যুবকদের হতাশা ও অসহায়তার অনুভূতি থেকে জন্মেছে।

ডংগুয়ান শহরের 'প্রেটেন্ড টু ওয়ার্ক কোম্পানি'-র মালিক ৩০ বছর বয়সী ফেইউ (ছদ্মনাম)। অতীতে তিনি নিজেও বেকার ছিলেন; করোনার মহামারির সময় তার খুচরা ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।
চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ফেইউ 'প্রেটেন্ড টু ওয়ার্ক' প্রচার শুরু করেন, আর এক মাসের মধ্যে সব ওয়ার্কস্টেশন পূর্ণ হয়ে যায়। নতুন যোগদানের ইচ্ছুকদের আবেদন করতে হয়।
ফেইউ বলেন, গ্রাহকদের ৪০ শতাংশ সাম্প্রতিক বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকপাশ, যারা ইন্টার্নশিপের প্রমাণ হিসেবে ছবি তুলতে আসে। এর মধ্যে কিছু আসে আবার পরিবারের চাকরির চাপ সামলাতে।
অন্য ৬০ শতাংশ ফ্রিল্যান্সার—অনেকে বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান বা অনলাইন লেখালেখিতে যুক্ত। তাদের গড় বয়স প্রায় ৩০ বছর, সর্বনিম্ন বয়স ২৫।
সরকারিভাবে এই ধরনের কর্মীদের 'ফ্লেক্সিবল এমপ্লয়মেন্ট প্রফেশনাল' বলা হয়।
দীর্ঘমেয়াদে ব্যবসা লাভজনক হবে কি না তা নিয়ে ফেইউর সংশয় আছে। বরং তিনি এটিকে সামাজিক পরীক্ষা হিসেবে দেখেন। তিনি বলেন, 'সম্মান বজায় রাখার জন্য মিথ্যা বললে এটি কিছু লোককে সত্য খুঁজে পেতে সাহায্য করে।'