রাশিয়ান তেল আমদানিতে ভারতের বেলায় কঠোর ট্রাম্প, চীনের বেলায় নয় কেন?

রাশিয়ার সঙ্গে চলমান যুদ্ধে সমাপ্তি টানার জন্য নতুন শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর মধ্যে রয়েছে রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা এবং সেইসব দেশের ওপর পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞা, যারা মস্কোর থেকে কাঁচা তেল কিনছে।
রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করার জেরে চলতি মাসের শুরুতে ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন, এতে ভারতের ওপর মোট শুল্ক হার ৫০ শতাংশে পৌঁছে। তবে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় তেল ক্রেতা চীনের ওপর তিনি এ ধরনের শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেননি।
রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করতে ভারতের প্রতি ট্রাম্প যেভাবে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে, চীনের ক্ষেত্রে তেমন কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছেন না কেন?
ট্রাম্প ইতোমধ্যেই চীনের ওপর শুল্ক আরোপ না করার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্প মূলত চীনের সঙ্গে বিরল খনিজ এবং অন্যান্য কৌশলগত বাণিজ্য আলোচনার সম্ভাবনা বিবেচনা করে সময় নিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হলো ভারতের মতো দেশের ওপর চাপ বাড়িয়ে রাশিয়ার তেল আমদানির হার কমানো, কিন্তু চীনের সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা বিবেচনায় এখনই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
চীনের গত বছরের রাশিয়ান তেল আমদানি ছিল রেকর্ড ১ কোটি ৯ মিলিয়ন টন, যা তাদের মোট জ্বালানি আমদানির প্রায় ২০ শতাংশ। অন্যদিকে, ২০২৪ সালে ভারতের আমদানি ছিল ৮৮ মিলিয়ন টন।
চীনের সঙ্গে রাশিয়ার অর্থনৈতিক সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ যে অনেকের মতে, বেইজিং রাশিয়াকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাতে সাহায্য করছে।
এদিকে, মার্কিন কংগ্রেসের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের আইনপ্রণেতারা একটি বিল পেশ করার উদ্যোগ নিয়েছেন—'স্যানকশনিং রাশিয়া অ্যাক্ট ২০২৫'। এই বিল অনুযায়ী, যে কোনও দেশ রাশিয়ার তেল ও গ্যাস কিনলে তা পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।
বিলে ট্রাম্পকে ৫০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ক্ষমতা দেওয়া হবে। মার্কিন সিনেটররা জানান, তারা বিলটি এগিয়ে নেওয়ার আগে ট্রাম্পের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছেন।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্প মূলত সময় নিচ্ছেন একটি বিস্তৃত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনার জন্য, যাতে এতে রেয়ার আর্থ মিনারেলসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পণ্য অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। রেয়ার আর্থ মিনারেল হলো ১৭ ধরনের মৌলিক উপাদানে তৈরি, যা অটো পার্টস, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং সামরিক প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন শিল্পে অপরিহার্য। খনি উত্তোলন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে চীনের প্রভাব দীর্ঘদিন ধরে সবচেয়ে বড়।
যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শিল্প চীনা খনিজের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এগুলো চলমান বাণিজ্য আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। ট্রাম্পের চীনের ওপর তুলনামূলকভাবে নরম হওয়ার আরেকটি কারণ হলো মার্কিন খুচরা ব্যবসায়ীরা ডিসেম্বরের ক্রিসমাস মৌসুমের আগে চীনা পণ্য মজুত করছেন; শুল্ক বৃদ্ধির ঝুঁকি এড়াতেই বরং আগ্রহী ট্রাম্প।
সম্প্রতি ট্রাম্প বাণিজ্য সংঘাত কমানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। আগস্টের শুরুতে মার্কিন প্রশাসন চীনের জন্য উন্নত সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানির ওপর কিছু বিধিনিষেধ শিথিল করেছে, যা চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি ছিল।
১১ আগস্ট ট্রাম্প অনুমতি দিয়েছেন মার্কিন কোম্পানি এনভিডিয়াকে চীনে উন্নত চিপ বিক্রি করার জন্য। তবে এই প্রযুক্তির ১৫ শতাংশ ফেডারেল সরকারের কাছে দিতে হবে। এর আগে ট্রাম্প এই চুক্তি রোধ করেছিলেন।
সোমবার সিএনবিসিকে সাক্ষাৎকারে মার্কিন ট্রেজারি সচিব স্কট বেসেন্ট চীনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, "ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ান তেলের কেনার ক্ষেত্রে চীনের অংশ ছিল যুদ্ধের আগে ১৩ শতাংশ, যা এখন বেড়ে ১৬ শতাংশে পৌঁছেছে। ফলে চীনের তেলের উৎস বিচিত্র।"
বেসেন্ট আরও উল্লেখ করেন, চীন ভারতের মতো 'আর্বিট্রাজ' করেনি। তবে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে লাভসাধনের অভিযোগ তোলেন। তার মতে, ইউক্রেন যুদ্ধের আগে ভারতের রাশিয়ান তেলের আমদানির পরিমাণ এক শতাংশের কম ছিল; এখন তা ৪২ শতাংশে পৌঁছেছে। বেসেন্টের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ভারত অল্পদামী রুশ তেল কিনে তা প্রক্রিয়াজাত করে পুনঃবিক্রয় করছে।
সোমবার, হোয়াইট হাউসের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো দ্বিতীয় উচ্চপদস্থ ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তা হিসেবে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে তারা রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধকে অর্থায়ন করছে।
১২আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এ প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করেন যে ট্রাম্প কি বেইজিংয়ের ওপর ভারতকে দেওয়া অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্কের মতো পদক্ষেপ নেবেন কিনা। তিনি বলেন, 'প্রেসিডেন্ট বলেছেন তিনি এটি নিয়ে ভাবছেন, তবে এখনও কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি… চীনের বিষয়টা একটু জটিল কারণ আমাদের চীনের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক অন্য বিষয়ককেও প্রভাবিত করে, যা রাশিয়ার পরিস্থিতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়।'
এই সপ্তাহের শুরুতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সতর্ক করেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর রাশিয়ার তেল পরিশোধের জন্য পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পেতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির কোনো চুক্তি হলে এবং রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। বিশেষ করে জুলাইয়ের অর্থনৈতিক সূচকের পরিপ্রেক্ষিতে, এটি চীনের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
জুলাই মাসে দেশটির কারখানা উৎপাদন, বিনিয়োগ ও খুচরা বিক্রি কমেছে। তরুণদের বেকারত্বও বেড়েছে—জুলাই মাসে ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সী শহুরে যুবকদের মধ্যে বেকারত্ব দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশে; গত ১১ মাসের মধ্যে যা সর্বোচ্চ।
হংকংভিত্তিক ন্যাটিক্সিস ব্যাংকের অর্থনীতিবিদ অ্যালিসিয়া গার্সিয়া হেরেরো বলেছেন, চীনের অর্থনীতিতে চিড় দেখা যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, 'চীন অনেক দিন ধরেই পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞার ভয় মাথায় রেখে বিকল্প বাণিজ্যপথ তৈরি করছে। সে জন্য তাদের অর্থনীতি সহজে চেপে ধরা যাবে না।' তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও এটি ঝুঁকি, কেননা, চীনা আমদানি বেশি হওয়ায় শুল্ক বাড়লে মার্কিন ভোক্তাদের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে।
গত বছর চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি ছিল ২৯৫.৪ বিলিয়ন ডলার (২৯ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা), যা আগের বছরের তুলনায় ৫.৮ শতাংশ বেশি। তবে এপ্রিলে চলমান শুল্কযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর ১৪৫ শতাংশ এবং চীন পাল্টা ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় কার্যত দুই দেশের বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
মার্কিন সেনসাস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, উচ্চ শুল্কের কারণে চলতি বছরের জুন মাসে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি ২০০৪ সালের পর সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে। মার্চ থেকে আগস্টের মধ্যে ঘাটতি কমেছে ২২.২ বিলিয়ন ডলার (২ হাজার ২২০ কোটি টাকা), যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ কম।
শুল্কযুদ্ধের বিরতি হিসেবে, গত মে মাসে জেনেভায় আলোচনার পর দুই দেশ শুল্ক কমিয়েছে—মার্কিন শুল্ক ৩০ শতাংশে এবং চীনের শুল্ক ১০ শতাংশে নামানো হয়েছে। চীন আংশিকভাবে বিরল খনিজ রপ্তানি শুরু করেছে। পরে ১২ আগস্ট দুই দেশ নতুন করে ৯০ দিনের জন্য শুল্কবিরতি ঘোষণা করে, যা ১০ নভেম্বর পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।
গার্সিয়া হেরেরোর মতে, বড় কোনো নাটকীয় পরিবর্তন না ঘটলেও চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্যচুক্তি হবে। তিনি বলেন, 'দুই দেশই ইতিবাচক কোনও খবর চাইছে, নইলে উভয়ই অর্থনৈতিক ধাক্কা খাবে।'