২৪ শতাংশের বেশি সার ডিলার অনিয়মে জড়িত; ডিলার নিয়োগে আসছে নতুন নীতিমালা, বাড়তে পারে কমিশন

সারাদেশে প্রতি চারজন সারের ডিলারের মধ্যে একজন কোনো না কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। সরকারের হিসাব অনুযায়ী, মোট ডিলারের ২৪.৬৬ শতাংশ বা ২,৬৫৫ জন ডিলারের বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। কৃষকদের কাছে সহজে সার পৌছে দিতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার সারাদেশে এসব ডিলার নিয়োগ দেয়। 'কালো তালিকা'ভুক্ত করে তাদের ডিলারশিপ বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। শিগগিরই নতুন ডিলার নিয়োগ দেওয়া হবে।
৩০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সার বিষয়ক জাতীয় সমন্বয় ও পরামর্শক কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। এতে কৃষি সচিব ইমদাদ উল্লাহ মিয়ান সারের চাহিদা, ডিলারদের অনিয়ম এবং নতুন ডিলার নিয়োগ নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করেন।
সভা-সংক্রান্ত কার্যপত্রে বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে বিসিআইসি (বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন) ও বিএডিসি (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন) মিলিয়ে মোট ১০ হাজার ৮১৪ জন সার ডিলার রয়েছে—এর মধ্যে বিসিআইসির ৫ হাজার ৬৫৫ জন এবং বিএডিসির ৫ হাজার ১৫৯ জন। বিসিআইসি ২০০৯ সালের নীতিমালা অনুযায়ী ডিলার নিয়োগ দিয়েছে, আর বিএডিসি নিয়োগ দিয়েছে তাদের বীজ ডিলারদের মধ্য থেকে।
সভায় জানানো হয়, ভবিষ্যতে বিসিআইসি ও বিএডিসির আলাদা ডিলার থাকবে না। সরকার 'সার ডিলার নিয়োগ ও বিতরণ সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা-২০২৫' প্রণয়ন করছে, যা উপদেষ্টা পরিষদ নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে। চূড়ান্ত অনুমোদনের পর এ নীতিমালা অনুযায়ী নতুন ডিলার নিয়োগ করা হবে।
এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ) আহমেদ ফয়সাল ইমামের নেতৃত্বে একটি কমিটি কাজ করছে। তিনি বলেন, 'নীতিমালা অনুমোদন হয়েছে। এখন ভাষাগত পরিমার্জনের কাজ চলছে। শিগগিরই নতুন নীতিমালা জারি হবে এবং সে অনুযায়ী ডিলার নিয়োগ করা হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'আগে ডিলারের লাইসেন্স পেয়েছেন যারা কিন্তু কোনো অনিয়ম নেই, তাদের লাইসেন্স বহাল থাকবে। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী জামানত দিতে হবে। নতুন নীতিমালায় জামানত নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ টাকা।'
উল্লেখ্য, বর্তমানে বিসিআইসির ডিলারদের জামানত ৪ লাখ এবং বিএডিসির ডিলারদের জামানত ১ লাখ টাকা।
বিএডিসির চেয়ারম্যান মো. রুহুল আমিন খান গত ২০ অক্টোবর বলেন, 'সারের ডিলার নিয়োগে নতুন নীতিমালা করা হচ্ছে। বিএডিসি ও বিসিআইসির আলাদা ডিলার থাকবে না। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী সকল ডিলার নিয়োগ হবে।'
যেসব অনিয়মে জড়িত ডিলাররা
সভার কার্যপত্রে ডিলারদের অনিয়মের একটি চিত্র তুলে ধরে বলা হয়েছে, ১৪৭ জন ডিলার নিয়োগ নীতিমালা লঙ্ঘন করে নিয়োগ পেয়েছেন এবং সার বিতরণ সংক্রান্ত অনিয়মে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। এছাড়া ২,১৬১ জন নীতিমালা লঙ্ঘন করে নিয়োগ পেয়েছেন। ৯ জন ডিলার একাধিকবার এবং ৩৪৮ জন কমপক্ষে একবার অনিয়ম করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে ৮,১৪৯ জন ডিলার নিয়ম অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো অনিয়মের অভিযোগ নেই।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, কিছু ডিলার সরকারি গুদাম থেকে সার তুলে কৃষকদের না দিয়ে গায়েব করে ফেলেছে। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী বোরো মৌসুম শুরুর আগেই নতুন ডিলার নিয়োগ সম্পন্ন করার লক্ষ্য রয়েছে।
আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ডিলারদের অনিয়মের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো কৃষকদের কাছে না বিক্রি করে বাজারে বিক্রি করা, মজুদ সৃষ্টি করে সংকট ঘটানো, মৃত ডিলারের নামে সার তোলা, কিংবা অন্য জেলার সার অন্যত্র বিক্রি করা।
সভায় ডিলার কমিশন বাড়ানোর প্রস্তাবও গৃহীত হয়। কৃষি সচিব ইমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, ২০০৮ সাল থেকে প্রতি কেজিতে ২ টাকা কমিশন নির্ধারিত আছে, যা কখনো বাড়ানো হয়নি। জীবনযাত্রার ব্যয়, শ্রমিক মজুরি, পরিবহন ও আনুষঙ্গিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় কমিশন বাড়ানোর দাবি যৌক্তিক।
বাড়তে পারে ডিলার কমিশন
সভায় সারের ডিলারদের কমিশন বাড়ানোর বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। কৃষি সচিব ইমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, '২০০৮ সাল থেকে প্রতি কেজি সারে ২ টাকা ডিলার কমিশন ধরে দাম নির্ধারণ হয়ে আসছে। এই সময়ে কয়েকবার সারের দাম বাড়লেও ডিলার কমিশন বাড়ানো হয়নি। অথচ জীবনযাত্রার ব্যয়, শ্রমিক মজুরি, পরিবহনসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ বেড়েছে।'
শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান জানান, কৃষক পর্যায়ে সারের দাম অপরিবর্তিত থাকবে। তিনি বলেন, 'কোনোভাবেই দাম বাড়ানো যাবে না। কৃষক পর্যায়ে সারের দাম অপরিবর্তি রেখে ডিলার কমিশন বাড়ানো যেতে পারে।'
সভায় জানানো হয়, কৃষক পর্যায়ে দাম ঠিক রেখে ডিলার কমিশন প্রতি কেজিতে ২ টাকা বাড়ালে সরকারের মোট ১,১৬০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে। এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের লিখিত মতামত চাওয়ার পর কমিশন নির্ধারণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সারের চাহিদা ও পরিবহন নীতিতে পরিবর্তন
বৈঠকে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য দেশে মোট ৫৮ লাখ টন সারের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ইউরিয়া ২৬ লাখ টন, টিএসপি ৭.৫০ লাখ টন, ডিএপি ১৪.৮৫ লাখ টন এবং এমওপি ৯.৫০ লাখ টন।
একইসাথে সারের নিরাপত্তা মজুত ১২ লাখ টন থেকে কমিয়ে ১১ লাখ টন নির্ধারণ করা হয়েছে।
সার পরিবহণেও নতুন নিয়ম আনা হচ্ছে। এখন থেকে ডিলারদের নিজেদেরই মোকাম থেকে সার উত্তোলন করতে হবে। প্রতিনিধি নিয়োগের প্রয়োজন হলে কেবল প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে মনোনয়ন দেওয়া যাবে এবং সেক্ষেত্রে ডিলারকে প্রত্যয়নপত্র দিতে হবে।