বিছারা ‘দখল করে নিচ্ছে’ ব্রাজিলের শহরগুলো, হুল ফোটানো বেড়েছে ২৫০% পর্যন্ত

ব্রাজিলের শহরগুলো এখন বিছারা 'দখল' করে নিচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন গবেষকরা। এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, দ্রুত নগরায়ন ও জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে বিছার হুল ফুটানোর ঘটনা বেড়ে গেছে।
ব্রাজিলের রোগ-সংক্রান্ত জাতীয় তথ্যভান্ডার-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশটিতে প্রায় ১১ লাখেরও বেশি বিছায় দংশনের ঘটনা ঘটেছে। 'ফ্রন্টিয়ার্স ইন পাবলিক হেলথ' জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০১৪ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিছার হুল ফুটানোর ঘটনা প্রায় ২৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
গবেষকদের মতে, নিয়ন্ত্রণহীন ও অপরিকল্পিত নগরায়ন—বিশেষ করে 'ফাভেলা' (ব্রাজিলের শহরাঞ্চলের ঘনবসতিপূর্ণ বস্তি)—বিছার উপদ্রব ও দংশন বৃদ্ধির মূল কারণ। এসব এলাকায় অপর্যাপ্ত আবাসন ও দুর্বল বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থাও বিছাদের বিস্তারকে ত্বরান্বিত করছে। এই নগরায়ন একদিকে যেমন বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলে হস্তক্ষেপ করছে, তেমনি বিছাদের জন্য সৃষ্টি করছে টিকে থাকার উপযোগী পরিবেশ।
প্রধান গবেষক এবং সাও পাওলো স্টেট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক মানুয়েলা বের্তো পুক্কা বলেন, 'নগরায়নের ফলে ব্রাজিলের ইকোসিস্টেমে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে'।
তার ভাষায়, 'নগরাঞ্চলের স্যাঁতসেঁতে দেয়াল, নর্দমা, ধ্বংসাবশেষ ও ফেলে রাখা নির্মাণসামগ্রী বিছাদের জন্য আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে শহরের নর্দমাগুলো প্রায় সারা বছর উষ্ণ থাকায় এরা সেখানে থাকতে পছন্দ করে। শহরে তেমন কোনো শিকারি প্রাণীও নেই বললেই চলে। অন্যদিকে তেলাপোকাসহ অন্যান্য ছোট ছোট জীবও সহজলভ্য হওয়ায় বিছাদের খাবারেরও কোনো অভাব পড়ছে না। কিছু কিছু প্রজাতি তো আবার ৪০০ দিন পর্যন্ত না খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে, এমনকি সঙ্গম ছাড়াও বংশবৃদ্ধি করতে পারে—তাই এদের নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূল করাও বেশ কঠিন।'
কখনও তীব্র গরম তো কখনও অতিবৃষ্টি, আবার কখনও খরার মতো আবহাওয়া—সব মিলিয়েই ব্রাজিলে এখন বিছাদের টিকে থাকার এক আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কারণ, উষ্ণ ও আর্দ্র—উভয় পরিবেশে এরা স্বভাবগতভাবেই মানিয়ে নিতে পারে।
২০২৪ সালের প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ব্রাজিলে বিছার হুল ফুটানোর ঘটনা প্রায় দুই লাখ ছুঁয়েছে। আর বিছার দংশনে মারা গেছেন মোট ১৩৩ জন। গবেষকেরা আশঙ্কা করছেন, ২০২৫ থেকে ২০৩৩ সালের মধ্যে নতুন করে ২০ লাখের মতো বিছা দংশনের ঘটনা ঘটতে পারে।
তাদের মতে, 'আসলে পরিসংখ্যানে যেমনটা দেখাচ্ছে, বাস্তবে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। কারণ এসব ক্ষেত্রে অনেকেই ঘরোয়া উপায়ে নিজেদের চিকিৎসা করান অথবা চিকিৎসা নেয়ার প্রয়োজনই মনে করেন না।'

গবেষক মানুয়েলা বের্তো পুক্কা বলেন, 'আমি এমন কিছু এলাকায় কাজ করেছি যেখানে প্রায় প্রতিদিনই মানুষ বিছার দংশনের ভয়ে ভোগে—দরিদ্র ও ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে এই প্রবণতা আরও বেশি। পরিসংখ্যান দেখেই বোঝা যায়, ভবিষ্যতে এই সমস্যা আরও বাড়বে।'
গবেষকেরা বলেন, বিছার দংশনে মৃত্যুর হার মাত্র ০.১ শতাংশ। তবে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে শিশু ও বৃদ্ধরা। যদিও প্রাপ্তবয়স্কদের বেশিরভাগই পুরোপুরি সেরে ওঠেন, তবে তাদেরও বেশ কয়েকদিন ধরে ব্যথা অনুভব করা, জ্বালাপোড়া, শরীরে লালচে ভাব, আক্রান্ত স্থান ফুলে যাওয়া, মাথা ঝিনঝিন করা ও বমি বমি ভাবের মতো উপসর্গে ভুগতে হয়।
ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, বলিভিয়া, মেক্সিকো, গায়ানা ও ভেনেজুয়েলায় গত কয়েক দশকে বিছার দংশনের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। গবেষকেরা বলছেন, 'স্করপিয়নিজম' নামে পরিচিত এই চিকিৎসাজনিত রোগ এখন এসব দেশে বড় জনস্বাস্থ্য সংকটে রূপ নিয়েছে। ইউরোপে বিছার ৩৫টির বেশি দেশীয় প্রজাতি রয়েছে বলে ধারণা করা হলেও সেগুলোর সংখ্যা বা বিস্তারের প্রবণতা নিয়ে এখনো কোনো বড় পরিসরের গবেষণা হয়নি।
গবেষকদের মতে, বিছার দংশন এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এর সংক্রমণ রোধে সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
পুক্কা বলেন, 'বিছারা অগোছালো এবং স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে টিকে থাকে। তাই এলাকাগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা, দেয়ালের ফাটল ধরলে তা বন্ধ করা, নর্দমায় জালি বসানো এবং জুতা, তোয়ালে বা পোশাক ইত্যাদি ব্যবহারের আগে ভালোমতো ঝেড়ে দেখা—এসব অভ্যাস গড়ে তুললেই বড় বিপদ এড়ানো সম্ভব' ।
গবেষণায় সরাসরি যুক্ত না থাকলেও রিডিং ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিদ ড. মানুয়েলা গনসালেজ-সুয়ারেজ বলেন, 'পরিসংখ্যানগুলো আমার প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি। বিছার দংশন যে একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা বেশ স্পষ্ট।' তবে তিনি মনে করেন, সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে অনেক ক্ষেত্রেই হুল ফুটানোর ঘটনাগুলো আগের চেয়ে বেশি ঘটছে।
এই পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই বলে মনে করেন গনসালেজ-সুয়ারেজ। তিনি বলেন, 'বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিছার দংশন প্রাণঘাতী হয় না। আমরা সড়ক দুর্ঘটনা বা সহিংসতায় মৃত্যুর হার যেমনটা দেখি, সেই তুলনায় বিছার দংশনে মৃত্যুর হার খুবই কম।'
ব্রাজিলে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার আওতায় বিনামূল্যে বিছার হুল ফুটানোর চিকিৎসা দেওয়া হয়। দেশের কিছু কিছু হাসপাতাল এবং জরুরি চিকিৎসাকেন্দ্রে অ্যান্টিভেনমও (বিষনাশক প্রতিষেধক) বেশ সহজলভ্য। সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং গবেষণাটির অন্যতম লেখক এলিয়ানে কানদিয়ানি আরান্তেস বলেন, 'বিছা কামড়ালে পরিস্থিতি অবনতি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা না করে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চলে যাওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।'
তিনি সতর্ক করেন, 'বিছার দংশনে সব বয়সী মানুষই ঝুঁকিতে থাকে, তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে শিশুরা। কারণ, দেখা যায় সামান্য এক দংশনই একটি শিশুর প্রাণ নিয়ে নিতে পারে।'
যুক্তরাজ্যের লেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং 'অ্যাভয়েডেবল ডেথস নেটওয়ার্ক'-এর সভাপতি নিবেদিতা রে-বেনেট বলেন, 'এই গবেষণা আসলে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে—প্রতিকারের জন্য এখনই ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।'
বিছাদের নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলোও তুলে ধরেছেন অধ্যাপক মানুয়েলা পুক্কা। তিনি বলেন, 'বিছারা আমাদের শত্রু নয়। এরা কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে আক্রমণ করে না—আসলে আত্মরক্ষার্থেই প্রতিক্রিয়া দেখায়। প্রকৃতির এই জীবেরা কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে রাখে, জীববৈচিত্র্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।'