অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রে দোষী সাব্যস্ত হওয়া ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর ২৭ বছরের কারাদণ্ড

ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারোকে বৃহস্পতিবার ২৭ বছর ৩ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি ২০২২ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য অভ্যুত্থান ঘটানোর ষড়যন্ত্রে দোষী সাব্যস্ত হন।
পাঁচজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ এ রায় দেন। এর মধ্য দিয়ে ৭০ বছর বয়সী বলসোনারো ব্রাজিলের ইতিহাসে প্রথম সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভ্যূত্থান ঘটানোর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হলেন। এ রায়ের সমালোচনা করেছে ট্রাম্প প্রশাসন।
বলসোনারোকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য ভোট দেওয়ার আগে বিচারপতি কারমেন লুসিয়া সামরিক অভ্যুত্থান এবং গণতন্ত্র উৎখাতের প্রচেষ্টার ইতিহাসের কথা উল্লেখ করে বলেন, 'এই ফৌজদারি মামলাটি ব্রাজিল ও তার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে এক ধরনের মেলবন্ধন তৈরি করেছে।'
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে গৃহবন্দি থাকা বলসোনারোর বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ আছে। তিনি গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে কাজ করেছেন।'
পাঁচ বিচারপতির মধ্যে চারজন সাবেক প্রেসিডেন্টকে পাঁচ অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করেন। সেগুলো হলো−সশস্ত্র অপরাধ সংগঠনে অংশগ্রহণ, সহিংসভাবে গণতন্ত্র বিলোপের চেষ্টা, অভ্যুত্থান সংগঠিত করা এবং সরকারি সম্পদ ও সুরক্ষিত সাংস্কৃতিক সম্পদের ক্ষতি সাধন।
ব্রাজিলের সেনাবাহিনীর সাবেক ক্যাপ্টেন বলসোনারো ১৯৫৪ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত শত শত ব্রাজিলিয়ানকে হত্যা করা সামরিক স্বৈরশাসনের প্রতি তার প্রশংসা কখনও গোপন করেননি। তার সাজা হয়েছে। এ বছর অন্যান্য ডানপন্থী নেতাদের মধ্যে ফ্রান্সের মেরিন লে পেন এবং ফিলিপাইনের রড্রিগো দুতার্তেও একই ধরনের আইনি শাস্তির মুখে পড়েছেন।
এই রায় বলসোনারোর ঘনিষ্ঠ মিত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আরও ক্ষুব্ধ করতে পারে। ট্রাম্প আগেই এ মামলাকে 'উইচ হান্ট' আখ্যা দিয়ে পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ব্রাজিলে ওপর শুল্ক বৃদ্ধি, বিচারকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং বেশিরভাগ উচ্চ আদালতের বিচারকের ভিসা বাতিল করেছিলেন।
বৃহস্পতিবার দণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাম্প আবারও বলসোনারোর প্রশংসা করেন এবং রায়টিকে 'ভয়াবহ ঘটনা' বলে মন্তব্য করেন।
ট্রাম্প আরও বলেন, 'আমি মনে করি এটি ব্রাজিলের জন্য খুব খারাপ।'
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাবার দণ্ডের খবর পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে ব্রাজিলিয়ান কংগ্রেস সদস্য এদুয়ার্দো বলসোনারো রয়টার্সকে জানান, তিনি আশা করছেন ট্রাম্প ব্রাজিল এবং দেশটির সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বিবেচনা করবেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এক্সে (টুইটার) পোস্ট করে বলেন, 'আদালত অন্যায়ভাবে রায় দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের উইচ হান্টের যথাযথ জবাব দেবে।'
রুবিওর মন্তব্যকে ব্রাজিলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি হুমকি আখ্যা দিয়ে জানায়, এটি 'ব্রাজিলের কর্তৃত্বকে আক্রমণ করছে এবং মামলার তথ্য ও শক্ত প্রমাণকে অগ্রাহ্য করছে।' মন্ত্রণালয় আরও জানায়, ভয় দেখিয়ে ব্রাজিলের গণতন্ত্রকে দমিয়ে রাখা যাবে না।
অন্যদিকে বলসোনারোর বিরুদ্ধে রায় নিশ্চিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা স্থানীয় টিভি চ্যানেল ব্যান্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিষেধাজ্ঞাকে ভয় পান না।
রায়টি সর্বসম্মত ছিল না, বুধবার বিচারপতি লুইজ ফুক্স তার সহকর্মীদের থেকে ভিন্নমত পোষণ করে সাবেক প্রেসিডেন্টকে সমস্ত অভিযোগ থেকে খালাস দেন এবং আদালতের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
এই একটি ভিন্নমত ভবিষ্যতে রায় চ্যালেঞ্জ করার পথ খুলে দিতে পারে। আর এই বিচার প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ২০২৬ সালের অক্টোবরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেভাগে হতে পারে। যদিও তার প্রার্থিতা থেকে নিষিদ্ধ তারপরও বলসোনারো বারবার বলেছেন তিনি ওই নির্বাচনে প্রার্থী হবেন।
অন্যদিকে বলসোনারোর আইনজীবীরা এক বিবৃতিতে বলেন, এই সাজা 'অযৌক্তিকভাবে বেশি' এবং তারা যথাযথভাবে আপিল আবেদন করবেন।
বেকবেঞ্চার থেকে আজকের প্রেসিডেন্ট
বলসোনারোর সাজা তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে নিম্নপর্যায়। তবে কংগ্রেসের পিছনের সারি থেকে শুরু করে তিনি এক শক্তিশালী রক্ষণশীল জোট গড়ে তুলেছিলেন, যা দেশের নবীন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চরম পরীক্ষার মুখে ফেলেছিল।
বলসোনারোর রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৮০-এর দশকে রিও ডি জেনেইরোর সিটি কাউন্সিলে। এর আগে সেনাবাহিনীর প্যারাট্রুপার হিসেবে সংক্ষিপ্ত কর্মজীবন শেষ করেন তিনি। এরপর তিনি প্রায় তিন দশক ব্রাসিলিয়ায় কংগ্রেসম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যেখানে তিনি দ্রুত স্বৈরাচারী আমলের নীতিগুলোর পক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য পরিচিত হয়ে ওঠেন।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বিতর্কিতভাবে দাবি করেন, ব্রাজিল কেবল তখনই বদলাবে 'যেদিন এখানে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে এবং সামরিক শাসন যে কাজটি শেষ করতে পারেনি তা আমরা করব। আর তা হলো ৩০ হাজার মানুষ হত্যা।'
দীর্ঘ সময় তাকে প্রান্তিক খেলোয়াড় হিসেবে অবমূল্যায়ন করা হলেও পরে তিনি নিজের বার্তা পাল্টে দুর্নীতি বিরোধিতা এবং পরিবার-সমর্থনমূলক মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিতে থাকেন। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে সারা ব্রাজিলে ব্যাপক বিক্ষোভের সময় তার এই বক্তব্য বেশ সাড়া ফেলে। সেই সময়কার বহুল আলোচিত 'কার ওয়াশ' দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতে শত শত রাজনীতিক জড়িয়ে পড়েন—যার মধ্যে প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভাও ছিলেন। যদিও তার বিরুদ্ধে দেওয়া সাজা পরে বাতিল করা হয়।
প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ক্ষোভই ২০১৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বলসোনারোর সফলতার পথ খুলে দেয়। তার সঙ্গে একাধিক ডানপন্থী ও রক্ষণশীল আইনপ্রণেতা নির্বাচিত হন, যারা কংগ্রেসকে লুলার প্রগতিশীল এজেন্ডার জন্য দীর্ঘস্থায়ী প্রতিবন্ধকতায় রূপান্তরিত করেছিল।
বলসোনারো প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় করোনাভাইরাস মহামারীর সময় ভ্যাকসিনের প্রতি তীব্র সংশয় এবং আমাজন বনাঞ্চলে অবৈধ খনিজ সম্পদ উত্তোলন ও গবাদি পশুর খামার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বন উজাড় বৃদ্ধি পেয়েছিল।
২০২২ সালের পুনঃনির্বাচনের কঠিন প্রচারণার সময়—যেখানে লুলা জয়লাভ করেন—বলসোনারোর মন্তব্য ক্রমেই মেসিয়ানিক স্বভাব ধারণ করে, যা নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণের তার প্রস্তুতির বিষয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করে।
২০২১ সালে বলসোনারো ইভানজেলিক নেতাদের এক সভায় বলেন, তার ভবিষ্যতের জন্য তিনটি বিকল্প রয়েছে: গ্রেফতার, হত্যা, বা বিজয়। তিনি আরও যোগ করেন, 'পৃথিবীর কোনো মানুষ আমাকে হুমকি দিতে পারবে না।'
২০২৩ সালে ব্রাজিলের নির্বাচনী আদালত তাকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত সরকারি দায়িত্ব গ্রহণে নিষিদ্ধ করে, কারণ তিনি দেশের ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেম সম্পর্কে ভিত্তিহীন অভিযোগ ছড়িয়েছিলেন।
লুলার ইনস্টিটিউশনাল রিলেশনস মন্ত্রী গ্লেইসি হফম্যান বলেন, 'বলসোনারোর দোষী সাব্যস্ত হওয়া নিশ্চিত করে যে আর কেউ ভোটকেন্দ্রে মানুষের ইচ্ছা বা আইনের শাসনের উপর হামলা করার সাহস পাবে না।'
গণতন্ত্রের সুরক্ষা
বলসোনারোর দোষী সাব্যস্ত হওয়া এবং সেই রায়ের স্থায়িত্ব রক্ষায় ব্রাজিলের শীর্ষ আদালতের বিচারকরা যে কৌশল গ্রহণ করেছেন, তা গণতন্ত্র রক্ষা করতে কতটা কার্যকর তা পরীক্ষা করবে। তারা এটিকে ডানপন্থীদের বিপজ্জনক আক্রমণ হিসেবে দেখছেন।
বিচারকদের লক্ষ্য ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো, যেগুলোকে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ভোটপ্রক্রিয়া সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন, এবং সেইসাথে এর সঙ্গে জড়িত রাজনীতিবিদ ও কর্মীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ও তার মিত্রদের অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্রের জন্য কারাগারে পাঠানো এই বিরোধপূর্ণ কৌশলের এক চূড়ান্ত উদাহরণ।
এ ব্যাপারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিচারপতি আলেক্সান্দ্রে দে মোরাস। তিনি ২০১৭ সালে একজন রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত হন। বলসোনারো ও তার মিত্রদের প্রতি তার কঠোর মনোভাব বামপন্থীদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে এবং ডানপন্থীদের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে।
বলসোনারো রয়টার্সকে বলেন, 'তারা আগামী বছরের নির্বাচনের আগে আমাকে রাজনৈতিক খেলা থেকে বের করে দিতে চায়। বক্তব্যে তিনি ২০২৬ সালের নির্বাচনের কথা উল্লেখ করছেন, যেখানে লুলা সম্ভবত চতুর্থবারের জন্য প্রার্থী হবেন। তিনি সতর্ক করেন, 'আমাকে ছাড়া লুলা যেকাউকেই হারাতে পারবেন।'
ইতিহাসবিদ কার্লোস ফিকো বলেন, এই মামলার ঐতিহাসিক গুরুত্ব শুধুমাত্র সাবেক প্রেসিডেন্ট ও তার আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সুপ্রিম কোর্ট বলসোনারোর সাতজন মিত্রকেও দোষী সাব্যস্ত করেছেন, যার মধ্যে পাঁচজন সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন।
এটি ব্রাজিল প্রজাতন্ত্রের প্রায় ১৪০ বছরের ইতিহাসে প্রথম যেখানে সেনা কর্মকর্তাদের গণতন্ত্র উৎখাতের চেষ্টা করার জন্য শাস্তি দেওয়া হলো। ফিকো বলেন, 'এই বিচার প্রক্রিয়া সশস্ত্র বাহিনীর জন্য একটি সতর্কবার্তা।'