টেকসই ও সাশ্রয়ী মহাসড়ক নির্মাণে বিটুমিনের বদলে কংক্রিটে ঝুঁকছে সরকার

বাংলাদেশে মহাসড়ক নির্মাণে বিটুমিনের বদলে কংক্রিট ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে সরকার। সাম্প্রতিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, রিজিড পেভমেন্ট বা কংক্রিট সড়ক বেশি টেকসই, রক্ষণাবেক্ষণে কম খরচ হয় এবং দেশের জলবায়ুর প্রভাব ও যানবাহনের চাপ সামলাতে সক্ষম।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) তথ্য অনুযায়ী, বিটুমিন ও পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন (পিবিএম) দিয়ে তৈরি সড়কজের প্রাথমিক নির্মাণ খরচ কম হলেও—এর আয়ুষ্কাল স্বল্প। এ ধরনের সড়কের ২০ বছরের মধ্যে অন্তত চারবার বড় ধরনের সংস্কারের প্রয়োজন হয়, পাশাপাশি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের খরচ তো আছেই, যা সামগ্রিক খরচ অনেক বাড়িয়ে তোলে। উচ্চ তাপমাত্রা, শীত, জলাবদ্ধতা আর অতিরিক্ত বোঝাই ট্রাকের ভারে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয় এসব সড়ক।

অন্যদিকে, কংক্রিট সড়কে ব্যবহৃত হয় দেশীয় সিমেন্ট, বালি ও পাথর। প্রাথমিক নির্মাণ খরচ বিটুমিনের তুলনায় প্রায় ১০–১৫ শতাংশ বেশি হলেও এর আয়ুষ্কাল অনেক দীর্ঘ, প্রায় ২০-৩০ বছর। একবার নির্মাণ করলে খুব কম বা প্রায় শূন্য রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন হয়। তাপমাত্রা, বন্যা ও জলাবদ্ধতার মতো প্রতিকূল আবহাওয়াতেও এটি টেকসই থাকে।
প্রকৌশলীরা বলছেন, এর ফলে প্রতিবছর সড়ক মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ খাতে বড় অঙ্কের অর্থ সাশ্রয় হবে এবং মহাসড়ক হবে আরও টেকসই। ভারতসহ বহু দেশ ইতোমধ্যেই এই কৌশল গ্রহণ করেছে।
নীতিগত পদক্ষেপ ও চলমান প্রকল্প
এ সিদ্ধান্ত এখন শুধু কাগজে-কলমে নেই। এলেঙ্গা-হাটিকামরুল-রংপুর মহাসড়কের (১৯০ কিমি) সম্প্রসারণ প্রকল্পের প্রায় ৯০ কিলোমিটার অংশে কংক্রিট ব্যবহার হয়েছে, আর বাকি ১০০ কিলোমিটার বিটুমিনে নির্মাণ করা। একইভাবে ঢাকা-সিলেট করিডোর উন্নয়ন প্রকল্পে পরীক্ষামূলকভাবে ১১ কিলোমিটার কংক্রিট সড়ক নির্মাণ হচ্ছে, যা থেকে প্রায় ৫৪ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে ধারণা।
সওজ-এর এক কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে দেশব্যাপী রিজিড পেভমেন্টের ব্যবহার বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রকৌশলীরা আরও জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিটুমিন অংশ ভারী যানবাহন চলাচল ও জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও – বাজার এলাকা ও টোল প্লাজায় যেসব অংশে কংক্রিট ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞদের মতামত ও বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, সরকারের উচিত হবে আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে কংক্রিটের ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি জাতীয় নীতি গ্রহণ করা। আমাদের মতো জলবায়ুর দেশ ভারত অনেক গবেষণার পর এই বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা আমাদের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ কমিয়ে আনবে। ভারত ২০১৭ সালে গবেষণার ভিত্তিতে জাতীয় মহাসড়কগুলোতে কংক্রিট ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়।
তিনি আরও বলেন, "কংক্রিট সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কমায়, সরকারি তহবিলের সাশ্রয় করে এবং ঘন ঘন মেরামতের কারণে যাত্রীদের যে ভোগান্তি তৈরি হয় তা থেকেও মুক্তি দেয়। বাংলাদেশের জন্য এটি শুধু প্রকৌশলগত নয়, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত।"
কংক্রিটের তৈরি সড়কের সুবিধা
বিটুমিন সড়ক (ফ্লেক্সিবল পেভমেন্ট) তৈরি হয় আমদানি-নির্ভর অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের তলানি হিসেবে পাওয়া উপজাত পদার্থ বিটুমিন দিয়ে, এতে বিটুমিনের জন্য বৈদেশিক উৎসের ওপর নির্ভর করতে হয়, আবার ডলারও ব্যয় করতে হয়। এ ধরনের সড়ক তুলনামূলক কম খরচে তৈরি হলেও টেকসই নয়। ২০ বছরের মধ্যে অন্তত চারবার বড় ধরনের সংস্কারের প্রয়োজন পড়ে, এর বাইরে নিয়মিত মেরামত তো আছেই। তাপমাত্রা ৩৫-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠলেই বিটুমিন গলতে শুরু করে, শীতকালে ফাটল ধরে এবং জলাবদ্ধতা বা ভারী বৃষ্টিপাত দ্রুত সড়কের ক্ষতি করে।
অন্যদিকে, কংক্রিট সড়কে ব্যবহৃত হয় দেশে উৎপাদিত সিমেন্ট, বালি ও পাথর। এতে নির্মাণ খরচ সামান্য বেশি হলেও এগুলো ২০-৩০ বছর পর্যন্ত খুব কম বা প্রায় শূন্য রক্ষণাবেক্ষণে টিকে থাকে, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিকভাবে আরও সাশ্রয়ী।
কংক্রিট সাদা রঙের কারণে তাপ কম শোষণ করে, যা 'হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট' কমাতে সাহায্য করে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। এর প্রতিফলিত পৃষ্ঠ রাতে দৃশ্যমানতা বাড়ায়।
বিটুমিন পেভমেন্ট নমণীয়। এর ওপর ভারী ট্রাক যখন চাকা নিয়ে দাঁড়ায়, সেটা কিছুটা ডেবে যায়। মাইক্রো লেভেলে যা কয়েক মিলিমিটার পর্যন্ত। এই ডাবা অংশটুকু কাটিয়ে উঠে চলতে তেল খরচ হয় বেশি। কংক্রিটের সড়কে সে তুলনায় ২০ শতাংশ কম জ্বালানি খরচ হয়।
কংক্রিটের সড়কে শব্দ ও ঝাঁকুনি বেশি, তবে সাশ্রয়ী
তবে কংক্রিটের রাস্তা নিয়ে বড় অভিযোগ হলো– এসব সড়ক ঝাঁকুনি তৈরি করে এবং শব্দ বেশি হয়, আবার টায়ার দ্রুত ক্ষয় করে। এছাড়া কংক্রিটের রাস্তায় জয়েন্টগুলো দুর্বল হয় এবং দ্রুত ভেঙে যায় বলে ধারণা রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঝাঁকুনি ও শব্দের এই সমস্যা অদক্ষ শ্রমিকদের কাজের ফলে পৃষ্ঠ অসমতল হলে তৈরি হয়। এটি মূলত নন-ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতির কারণে হয়।
এলেঙ্গা-হাটিকামরুল-রংপুর চার লেন মহাসড়ক প্রকল্পের পরিচালক মো. ওয়ালীউর রহমান জানান, প্রকল্পের ৯০ কিমি কংক্রিট সড়কে গত চার বছরে একবারও রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হয়নি। সম্ভবত ১০ বছর পর রুটিন মেরামতের দরকার পড়বে। বিপরীতে, ১০০ কিলোমিটার বিটুমিন অংশ ইতোমধ্যেই উচ্চ তাপমাত্রা, ভারী বৃষ্টি ও অতিরিক্ত বোঝাই ট্রাকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সাসেক ঢাকা-সিলেট করিডোর প্রকল্পেও ঠিকাদার ও পরামর্শকরা পরীক্ষামূলকভাবে ১১ কিমি কংক্রিট সড়ক নির্মাণের প্রস্তাব দেন, যা বিটুমিনের তুলনায় কিছুটা কম খরচে হয়েছে। "ভ্যালু ইঞ্জিনিয়ারিং" নামে পরিচিত এই প্রক্রিয়ায় খরচ ৩৭৪.৬২ কোটি টাকা থেকে কমে ৩২০.৭৬ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। এতে ৫৪ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই অংশের কাজ করছে চীনা প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো-৮ কোম্পানি লিমিটেড। কংক্রিট ব্যবহারের ফলে হালকা বৃষ্টিতেও কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়, যা প্রকল্পের সময়সীমা কমাতে সাহায্য করে। তবে রাস্তা চালু করার আগে ২৮ দিনের 'কিউরিং' প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিলেট অঞ্চলের অতিবৃষ্টি, জলাবদ্ধতা এবং ঘন ঘন পাথরবোঝাই ওভারলোড ট্রাক চলাচল বিটুমিন দিয়ে নির্মিত সড়ককে ব্যয়বহুল এবং অটেকসই করে ফেলছে।
কংক্রিট সড়কের সুবিধা
সওজের বিস্তৃত তথ্য-উপাত্তের পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কংক্রিট সড়ক বিটুমিন সড়কের তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী ও অধিক সহনশীল। এন-১ (ঢাকা-চট্টগ্রাম), এন-৩ (ঢাকা-ময়মনসিংহ) এবং এন-৫ (ঢাকা-রংপুর) মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে কংক্রিট দিয়ে নির্মিত অংশগুলো বছরের পর বছর ধরে কার্যত কোনো রকম রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন পড়েনি, যদিও সেখানে অতিরিক্ত বোঝাই যানবাহন চলাচল ও দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতি বিদ্যমান।
সে তুলনায়, বিটুমিন সড়ক— এমনকি পলিমার-মডিফায়েড সংস্করণও— বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ সংস্কারের প্রয়োজন পড়েছে। বিশেষ করে টোল প্লাজা ও বাজার এলাকার মতো চাপযুক্ত স্থানে কংক্রিট সড়ক অত্যন্ত সফল প্রমাণিত হয়েছে, এসব অংশে জলাবদ্ধতা প্রচলিত বিটুমিনে তৈরি সড়কের দ্রুত ক্ষতি করে।
কংক্রিট মহাসড়ক নির্মাণের বৈশ্বিক ধারা: যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অভিজ্ঞতা
বিশেষজ্ঞরা জানান, যুক্তরাষ্ট্রে সড়ক নির্মাণে কংক্রিটের ট্রায়াল শুরু হয় ১৯৭৩ সাল থেকে। তখন আমেরিকায় পেট্রোলিয়াম পণ্য রফতানির ওপরে নিষেধাজ্ঞা দেয় আরব দেশগুলো। এদিকে পেট্রোলিয়াম না আসায়, এর উপজাত হিসাবে পাওয়া বিটুমিনেরও দুষ্প্রাপ্যতা তৈরি হলো। ফলে প্রাথমিক খরচ বেশি হলেও পরবর্তীতে তারা কংক্রিটের পেভমেন্ট বানানো আরম্ভ করল। যত হাইওয়ে আছে তখন একটু খরচ বেশি হলেও— তারা বিটুবিনের রাস্তা থেকে সরে গেলে কংক্রিটে।
শুরুর দিকে দ্রুত টায়ার ক্ষয় ও অতিরিক্ত ধূলাবালুর মতো সমস্যার মুখে পড়লেও—ফেডারেল ও অঙ্গরাজ্য পর্যায়ের বিস্তৃত গবেষণার মাধ্যমে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা হয় এবং সড়কের মানোন্নয়ন সম্ভব হয়।
গবেষণায় আরও দেখা যায়, কংক্রিট সড়কে ট্রাক প্রায় ২০ শতাংশ কম জ্বালানি খরচ করে, কারণ শক্ত কংক্রিট সড়ক ভারী চাকার নিচে দাবে না, যেখানে নমনীয় বিটুমিন সড়ক চাপে কয়েক মিলিমিটার বসে যায়।
সময় গড়ানোর সঙ্গে ট্রাক মালিকরাও কংক্রিট সড়কের দাবি জানাতে শুরু করে, ফলে যুক্তরাষ্ট্রে এর ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয় এবং পরে জার্মানি ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও এই প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ে।
একইভাবে, গবেষণা-নির্ভর অভিজ্ঞতার আলোকে ভারত ২০১৭ সালে ঘোষণা দেয় যে, নতুন কোনো জাতীয় মহাসড়ক আর বিটুমিন দিয়ে নির্মিত হবে না।
বাংলাদেশের মতোই গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশ ভারতে প্রচুর বৃষ্টিপাত, ঘন ঘন জলাবদ্ধতা ও দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে বিটুমিন সড়ক টেকসই হয়নি এবং দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়, কংক্রিট সড়ক অধিক টেকসই ও ব্যয় সাশ্রয়ী।
ফলে ভারত সরকার দৈনিক ৩০ কিলোমিটার (বা বছরে প্রায় ১১,০০০ কিলোমিটার) মহাসড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, যেখানে নতুন সব সড়ক কংক্রিট দিয়েই তৈরি করা হচ্ছে, বিটুমিন নয়।
বুয়েটে প্রথম কংক্রিট সড়ক
১৯৯৬ সালে বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রায় ৯০ শতাংশ রাস্তা কংক্রিটে নির্মিত হয়। এর আগে ক্যাম্পাসের রাস্তাগুলো নিয়মিত মেরামত করতে হতো, বিটুমিন ড্রাম গরম করতে তুষ পোড়ানোর কারণে পরিবেশ দূষণ হতো। কংক্রিটে পরিবর্তনের পর থেকে সড়কগুলোতে আর মেরামতের প্রয়োজন হয়নি।
অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, "কংক্রিটের রাস্তা অতিরিক্ত লোডিং, জলবদ্ধতা ও উচ্চ তাপমাত্রার মতো সমস্যাগুলো মোকাবিলায় বিটুমিনের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর। বাংলাদেশ সরকার সাশ্রয়ী মূল্যে টেকসই উন্নয়নের স্লোগান বাস্তবায়নে কংক্রিট পেভমেন্টকে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করতে পারে।"