শরীয়তপুর শহরে সড়কের জমিতে ১৪৬ অবৈধ স্থাপনা, যাচ্ছে না উচ্ছেদ করা; ভোগান্তিতে শহরবাসী

শরীয়তপুর সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগেরর অধীনে থাকা জেলা শহরের প্রধান সড়কের জমিতে নানা ধরনের ১৪৬টি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এসব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে পারছে না সওজ। প্রধান সড়কের পাশে থাকা এসব জমি আটকে যাওয়ায় শহরে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে, প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।
শরীয়তপুর সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ নাবিল হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'দীর্ঘ দিন ধরে সড়ক বিভাগের অধিগ্রহণ করা জমি দখল করে বিভিন্ন স্থায়ী ও অস্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এসব অবৈধ স্থাপনা থাকার ফলে সড়ক সংকুচিত হয়ে গেছে।'
শরীয়তপুর সওজ বিভাগ সূত্র জানায়, শরীয়তপুর জেলা গঠিত হওয়ার পর ১৯৮৬-১৯৮৭ সালে মনোহর বাজার মোড়-শরীয়তপুর-প্রেমতলা সড়কের জন্য জমি অধিগ্রহণ করে সওজ। ওই সময় জেলা শহরের ধানুকা, তুলাশার ও পালং মৌজায় ১২ একর ১২ শতাংশ জমি জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার মাধ্যমে অধিগ্রহণ করা হয়। ধানুকা থেকে পালং উত্তর বাজার পর্যন্ত দুই কিলোমিটার সড়কটির জন্য ৬০-৭০ ফুট প্রশস্ত জমি অধিগ্রহণ করা হয়। তখন মনোহর বাজার মোড় থেকে জেলা শহরের ওপর দিয়ে পালং উত্তর বাজার পর্যন্ত ১২ ফুটের একটি পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়। পরে ওই সড়ক ২৪ ফুটে উন্নিত করা হয়। এই সড়কটিই এখন ঢাকা-শরীয়তপুর সড়ককে যুক্ত করেছে।
অধিগ্রহণ করা জমিটিতে যাত্রী ছাউনি, ফুটপাত, ড্রেন নির্মাণ, সৌন্দর্যবর্ধনের অবকাঠামো ও সড়কবাতি বসানোর কথা ছিল। কিন্তু এমন কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করেনি সওজ।
এই সড়কটি নির্মাণ করার পর শহরের গুরুত্ব বেড়ে যায়। তখন থেকেই বিভিন্ন ব্যক্তি ও সরকারি প্রতিষ্ঠান সড়কের ফাঁকা জমি দখল শুরু করে। কেউ পাকা, আধাপাকা ভবন নির্মাণ করেছেন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান সড়কের জমিতে সীমানাপ্রাচীর ও প্রবেশপথ নির্মাণ করেছে।
ওই জমি দখলে নিয়ে অনেকে ভূমি জরিপের সময় নিজেদের নাম বসিয়ে দেন। তাই বিআরএস পর্চায় সড়ক বিভাগের ওই জমি অনেক ব্যক্তির নামে করা হয়। সওজ তাদের দখল বুঝে পেতে ও নিজেদের মালিকানা বহাল রাখতে ২০১৭ সালে শরীয়তপুর জজ আদালতে ১৮টি মামলা করেছে। ওই মামলাগুলো এখনও চলমান রয়েছে।
সড়কটির জন্য অধিগ্রহণ করা ১২ একর ১২ শতাংশ জমির মধ্যে ৮৭ শতাংশ জমি দখল হয়ে গেছে। ওই জমির মধ্যেই বিভিন্ন পাকা ও আধাপাকা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।
ধানুকা থেকে পালং উত্তর বাজার পর্যন্ত সড়কের জমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করা ১৪৬ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নামে তৈরি করা একটি তালিকা গত ৯ জানুয়ারি সওজ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠিয়েছেন। জমি উদ্ধারে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।
বিভিন্ন ব্যক্তির পাশাপাশি জেলা পরিষদ, বিদ্যুৎ বিভাগ (ওজোপাডিকো), শরীয়তপুর পৌরসভা, সিভিল সার্জন কার্যালয় ও আনসার-বিডিপির জেলা কমান্ডডেন্টের কার্যালয় সড়কের জমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করেছে।
জেলা শহরের বাসিন্দা শাহিন ঢালি বলেন, 'শরীয়তপুর দিন দিন বিভিন্ন গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। আমরা প্রতিদিন যানজটের কবলে পড়ে অতিষ্ঠ। এটা যেহেতু জেলাশহর, এখানে প্রতিদিনই যানবাহন বাড়বে। কিন্তু তার জন্য সড়ক বৃদ্ধি করতে হবে। যে সড়ক আছে তার প্রস্থ দ্বিগুণ করা না হলে এ ভোগান্তি কমবে না। এসব সম্ভব হবে যদি সড়ক বিভাগের জায়গা দখলমুক্ত করা যায়।'
শহরের সড়ক নিয়মিত ব্যবহার করেন ব্যাংক কর্মকর্তা আকরাম হোসেন। তিনি বলেন, 'শহরটা আস্তে আস্তে যেভাবে বিস্তৃত হচ্ছে আর গাড়িঘোড়া যেভাবে বাড়ছে, এর ফলে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। স্কুলগামী শিক্ষার্থী ও অফিসগামী মানুষদের প্রতিদিনই ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। মাঝে মাঝে দুর্ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে আমাদের। তাই সড়কের জন্য নির্ধারিত জায়গাটুকু দখলমুক্ত করে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা এবং ফুটপাত নির্মাণ করার জন্য প্রশাসনের প্রতি আমার জোরালো দাবি।'
ঢাকা-শরীয়তপুর চলাচলকারি শরীয়তপুর সুপার সার্ভিস গাড়ির চালক মোহাম্মদ আলী বলেন, 'পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর পরিবহন ও অন্যান্য গাড়ি বাড়ার কারণে আমরা শরীয়তপুর শহরে এলেই সবসময় ভোগান্তিতে থাকি। সরু সড়ক হওয়ায় সবসময় যানজট লেগেই থাকে। যানজটের কারণে সময় বেশি লাগে। ট্রিপ মিস যায়। মাঝে মাঝে ইজিবাইক বা গাড়ির সাথে দুর্ঘনাও ঘটে। আর এত বড় একটা শহর, অথচ কোথাও যাত্রী নামানো বা ওঠানোর স্থান নেই।'
সড়কের জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে আলমগীর মুন্সির বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, 'আমি আমার জমিতেই ভবন উঠাইছি। যদি সড়ক বিভাগের জমি হয়, তাহলে ভেঙে দিক। মাপজোক দিয়ে সমাধান হলে আমি আমার স্থাপনা সরিয়ে দেব।'
সড়কের জমি দখল করে স্থাপনা নির্মাণকারী ওজোপাডিকো-র নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, 'সড়ক বিভাগ ও আমাদের মধ্যে জমি নিয়ে ঝামেলা আছে, কিন্তু এখনও সমাধান হয়নি। এ বিষয়ে কী করা যায়, সে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানানো হয়েছে। তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী কাজ করা হবে।'
শরীয়তপুর জজ কোর্টের সরকারী কৌঁসুলি (জিপি) শাহাদাত হোসেন বলেন, 'অধিগ্রহণকৃত জমি রেকর্ড করার বা দখল করে রাখার কোনো সুযোগ নেই। যারা করেছেন, তারা হয়তো গোপনে অথবা যোগসাজশে করেছেন। তাদের শাস্তি হওয়া দরকার।
'আর এ সম্পত্তি উচ্ছেদ মামলা করলেও তো এত বছর লাগার কথা না; কারণ এটার সাথে জনসম্পৃক্ততা জড়িত। এখানে রাস্তার সংকট আছে। রাস্তা সংকীর্ণ। জনগনের সমস্যা হচ্ছে। তাই মামলা এত দেরি হওয়ার কথা না। বিষয়টি জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় নিয়ে প্রত্যাশী সংস্থা এগিয়ে এলে সুরাহা সম্ভব।'
শেখ নাবিল হোসেন বলেন, 'এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা গেলে সড়ক প্রশস্ত করা যাবে। অবশ্যই যানজট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই জায়গায় অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করা যাবে। মানুষের জন্য সুবিধা হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'বিষয়টি লিখিতভাবে জেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। শীঘ্রই আমরা যৌথভাবে মাঠে নামব। উচ্ছেদ শেষে এসব জমিতে সড়ক সম্প্রসারণ ও যৌন্দর্য বর্ধন ছাড়াও যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করা হবে।'
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'শরীয়তপুরে দিন দিন জনসংখ্যা বাড়ছে, শহর বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার সাথে পাল্টা দিয়ে যানবাহন। শহরের সক্ষমতার তুলনায় যানবাহন অনেক বেশি। তাই সড়ক সম্প্রসারণ খুবই জরুরি। বিষয়টি নিয়ে আমরা সড়ক বিভাগের সঙ্গে কথাও বলেছি। যেসব জমি নিয়ে মামলা আছে, সেগুলোর জন্য আদালতের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর অন্য সব বেদখল জমি উদ্ধারে জেলা প্রশাসন সচেষ্ট আছে।'