শিবচর-মাদারীপুর রুটে চার সেতু নির্মাণে দীর্ঘসূত্রতা, দুর্ভোগে হাজারো মানুষ
পদ্মা সেতুর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী শিবচর-মাদারীপুর আঞ্চলিক সড়কের চারটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুর নির্মাণকাজ দীর্ঘদিন ধরে কার্যত অচল হয়ে আছে। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন স্থানীয় হাজারো বাসিন্দা।
জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণকাজ শুরু করায় প্রকল্পটি নানা আইনি ও প্রশাসনিক জটিলতায় পড়েছে। এখন একে অপরের ওপর দোষ চাপাচ্ছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।
কুতুবপুর সেতুর কয়েকটি পিলার মাঝনদীতে দাঁড়িয়ে থাকলেও সেখানে কোনো নির্মাণকাজ চলছে না। প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে অনুমোদিত ৯০ মিটার দীর্ঘ এই সেতুর কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৪০ শতাংশ, অথচ এরইমধ্যে শেষ হয়ে গেছে প্রকল্পের মেয়াদ। ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কের আরও তিনটি সেতুর অবস্থাও একই রকম। নথিপত্র ও জমি-সংক্রান্ত জটিলতায় সবখানেই কাজ বন্ধ রয়েছে।
মরা আড়িয়াল খাঁ নদীর ওপর নির্মাণাধীন ছিলারচর সেতুটির কাজ বন্ধ থাকায় চারটি ইউনিয়নের মানুষ সরাসরি যোগাযোগব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকা বা ট্রলারে করে নদী পার হচ্ছে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল পরিবহনে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, ক্ষতির মুখে পড়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও। স্থানীয়দের আক্ষেপ, 'নতুন সেতু তো হলোই না, বরং পুরোনোটাও হারালাম।' প্রায়ই ঘটে দুর্ঘটনা; জরুরি যাতায়াতে হিমশিম খায় সাধারণ মানুষ।
চান্দেরচর ও হাকিমপুর সেতুর নির্মাণের প্রথম মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। অধিগ্রহণ ও জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জটিলতায় সেতু দুটির কাজ বন্ধ পড়ে আছে মাসের পর মাস। ফলে ঢাকার সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগের এই সড়কটি এখন স্থানীয়দের কাছে ভোগান্তির আরেক নাম।
মাদারীপুর এলজিইডির তথ্যমতে, ২৯.২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে কুতুবপুর সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২৩ সালের অক্টোবরে। ২০২৫ সালের অক্টোবর মাসে এর মেয়াদ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৪০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ১০.৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ের চান্দেরচর সেতুর কাজ শুরু হয় ২০২৩ সালের নভেম্বরে, যার মাত্র ৩০ শতাংশ শেষ হয়েছে। ৭২.৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ের ছিলারচর সেতুর কাজ ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৯ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। ৩০ কোটি টাকার হাকিমপুর সেতুটির কাজ জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় বর্তমানে পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। সব মিলিয়ে ১৪১.৫১ কোটি টাকা ব্যয়ের এই চার সেতুর নির্মাণমাত্র ৫০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে।
মাদারীপুর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী বাদল চন্দ্র কীর্তনীয়া বলেন, জমি অধিগ্রহণ-সংক্রান্ত সমস্যার কারণেই কাজের গতি ধীর হয়ে গেছে। তবে সম্প্রতি প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়া গেছে এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্র জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আশরাফুল আলম জানান, যথাযথ প্রস্তাব বা অনুমোদন ছাড়াই কাজ শুরু করার কারণে এই জটিলতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে জমির শ্রেণি নিয়ে সমস্যা রয়েছে, জমির মূল্য নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। সমস্যাটি দ্রুত সমাধানের জন্য বাস্তবায়নকারী সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে।
চান্দেরচর এলাকার বাসিন্দা জব্বার খান জানান, দুই বছর ধরে নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষকে প্রতিদিন অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে।
ছিলারচর উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাঈমা আক্তার বলে, 'নতুন ব্রিজ বানানোর জন্য পুরনো ব্রিজটা ভেঙে ফেলেছে। এখন পায়ে হেঁটে অনেক কষ্টে পারাপার হতে হয়। বৃষ্টির দিনে অনেক সময়ই বইখাতা নিয়ে ক্যাডার মধ্যে পড়ে যাই। ক্লাস করতে পারিনা। অনেক সময় স্কুলে পৌঁছতে দেরি হয়। একটা সেতু হতে কতদিন লাগে? আর কতদিন আমাদের ভোগাবে?'
ছিলারচর সেতুর জন্য বাসিন্দা সেলিম মাদবরের জমি অধিগ্রহণ করার কথা ছিল। তিনি অভিযোগ করেন, জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ না দিয়েই কাজ শুরু করা হয়েছে।
সেলিম বলেন, 'এখন আমাদের টাকাও দেয় না, আর সেতুর কাজও বন্ধ আছে। কবে টাকা দেবে, তা-ও কিছু প্রশাসন বলে না।' তিনি আরও বলেন, সেতুর কাজ করতে গিয়ে পুরনো সেতু ভেঙে ফেলায় প্রতিদিন এই ওই ভাঙা সেতু দিয়ে যাতায়াতে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আহত হচ্ছেন মানুষ।
কৃষক আলাউদ্দিন বলেন, সেতুগুলো না হওয়ায় পরিবহন খরচ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে; বাজারে সময়মতো পণ্য নেওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে।
