লাতিন আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রপ্রধানরা কেন এতো আইনি জটিলতায়?

সম্প্রতি ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো সামরিক অভ্যুত্থান ষড়যন্ত্রের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে ২৭ বছরের বেশি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। তবে তিনি ল্যাটিন আমেরিকার এই প্রথম কোনো নেতা নন, যিনি এরকম আইনি জটিলতার মুখোমুখি হয়েছেন।
বরং এই অঞ্চলে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর নেতাদের আইনের মুখোমুখি হওয়াটা যেন এক সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
পেরুতে চারজন সাবেক প্রেসিডেন্ট এখন কারাগারের বাসিন্দা, আর কলম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট আলভারো উরিবে ১২ বছরের গৃহবন্দিত্বের সাজা পেয়েছেন। ল্যাটিন আমেরিকার প্রায় প্রতিটি দেশেই অন্তত একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিচারিক তদন্তের মুখে পড়েছেন।

কারা আছেন এই তালিকায়?
ইকুয়েডরে ১৯৯৬ সাল থেকে ৮ জন নেতার মধ্যে একজন ছাড়া সবাই তদন্তের আওতায় এসেছেন। তাদের মধ্যে ৩ জন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, যার মধ্যে সাবেক প্রেসিডেন্ট রাফায়েল কোরেয়া ঘুষের মামলায় দণ্ডিত হয়ে বর্তমানে বেলজিয়ামে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে আছেন।
পেরুর চিত্রও অনেকটা একইরকম। ২০০০ সাল থেকে ৭ জন প্রেসিডেন্ট দুর্নীতির অভিযোগ বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। এমনকি একজন পুলিশি ঘেরাওয়ের মুখে আত্মহত্যাও করেন।
এল সালভাদর, মেক্সিকো, গুয়েতেমালা ও আর্জেন্টিনায় ৫ জন করে সাবেক প্রেসিডেন্ট ফৌজদারি তদন্তের মুখে পড়েছেন। আর্জেন্টিনার সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিনা ফার্নান্দেজ ডি কির্চনারকে ২০২২ সালে প্রতারণামূলক প্রশাসনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে গৃহবন্দি করা হয়েছে।
গুয়েতেমালায়ও ৩ জন দণ্ডিত হয়েছেন। এছাড়া কোস্টারিকা, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, বলিভিয়া, পানামা, হন্ডুরাস এবং আরও কয়েকটি দেশে সাবেক নেতাদের বিরুদ্ধে গুরুতর তদন্ত চলছে, যার ফলস্বরূপ অনেকেরই কারাদণ্ড হয়েছে।

একমাত্র ব্যতিক্রম উরুগুয়ে
এই হতাশাজনক চিত্রের মাঝে ব্যতিক্রম হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে উরুগুয়ে। দেশটির গণতান্ত্রিক যুগে একজনও প্রেসিডেন্ট বিচার ব্যবস্থার দ্বারা অভিযুক্ত বা দোষী সাব্যস্ত হননি, এমনকি তাদের বিরুদ্ধে কোনো খোলা তদন্তও নেই।
শুধু তাই নয়, 'দি ইকোনমিস্ট'-এর ২০২৪ সালের গণতন্ত্র সূচকে উরুগুয়েকে বিশ্বের ১৫তম এবং এই অঞ্চলের একমাত্র 'পূর্ণ গণতন্ত্র' হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
উরুগুয়ের ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যাঞ্জেল আরেলানো এই অনন্য অবস্থানের কারণ হিসেবে দেশটির 'জনসম্পদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের রাজনৈতিক সংস্কৃতি'কে চিহ্নিত করেন।
তিনি বলেন, '(উরুগুয়েতে) উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নিজেদের গাড়ি ব্যবহার করা এবং তাদের সাধারণ বাড়িতে বসবাস করা খুবই স্বাভাবিক চিত্র। তাদের খুব বেশি সুযোগ-সুবিধা নেই, বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকার বাকি দেশগুলোর তুলনায়, এবং তাদের কার্যক্রমে এক ধরনের কঠোরতা দেখা যায়।'
'একজন মন্ত্রীর এক অফিস থেকে অন্য অফিসে হেঁটে যাওয়া, বা নিজের গাড়ি চালিয়ে যাওয়া, অথবা একজন সংসদ সদস্যের নিজের গাড়ি চালিয়ে সংসদে যাওয়া সাধারণ ঘটনা। কোনো চালক, সচিব, হেলিকপ্টার–কিছুই নেই,' বলেন তিনি। এই চিত্রটি পেরুর মতো দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক দেশগুলোর সম্পূর্ণ বিপরীত, যেখানে গণতন্ত্র সূচকে তারা ৭৮তম স্থানে রয়েছে।
ল্যাটিন আমেরিকার নেতাদের এমন আইনি জটিলতার পেছনে দুটি প্রধান কারণ কাজ করে বলে মনে করা হয়: কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি এবং জনগণের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থার অভাব।
২০২৪ সালের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্ট অনুযায়ী, আমেরিকার গড় স্বচ্ছতার স্কোর ৪২ (১০০-এর মধ্যে), যা ইউরোপের চেয়ে অনেক কম।
আরেলানো এই দুর্নীতিকে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করেন, যা ক্ষমতাকে একজন ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত করে। তিনি বলেন, 'ল্যাটিন আমেরিকা একটি অত্যন্ত শক্তিশালী রাষ্ট্রপতি শাসিত সংস্কৃতি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন...রাষ্ট্রপতির হাতে ক্ষমতার এই কেন্দ্রীভূতকরণও এই ঘটনার একটি অংশ ব্যাখ্যা করে।'

ল্যাটিন আমেরিকার বিচার প্রক্রিয়া ও রাজনীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ম্যানুয়েল বালান তার ২০১৮ সালের গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন যে, '১৯৮০-এর দশকের গণতান্ত্রিকীকরণের পর থেকে ল্যাটিন আমেরিকায় নির্বাহী প্রধানদের (প্রেসিডেন্টদের) বিরুদ্ধে মামলা করার প্রবণতা বাড়ছে।'
আর্জেন্টিনার ইউনিভার্সিদাদ তোরকুয়াতো ডি তেল্লার পরিচালক ক্যাটালিনা স্মুলোভিৎজ মনে করেন, দুর্নীতির পরিসংখ্যান প্রায়শই 'মানুষের ধারণার ওপর' ভিত্তি করে তৈরি হয়।
তিনি বলেন, 'কয়েক বছর আগেও দুর্নীতি এমন কোনো বিষয় ছিল না যা জনমানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করত, তাই ঘটনাটি বেড়েছে কি না তা নির্ধারণ করা কঠিন।' অনেক ক্ষেত্রে, 'মানুষ এটিকে সমস্যা হিসেবে দেখে না' বলে দুর্নীতির হার কম দেখানো হতে পারে।
স্মুলোভিৎজ আরও একটি দিক তুলে ধরেন: রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা এখন 'ল-ফেয়ার' (আইনি লড়াইকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার) ব্যবহার করে বিরোধীদের চুপ করিয়ে দিতে ভিত্তিহীন অভিযোগের আশ্রয় নেয়। যদিও তিনি সতর্ক করেন যে, কর্মকর্তারাও প্রায়শই নিজেদের বিরুদ্ধে 'ল-ফেয়ার' হচ্ছে বলে দাবি করে তদন্ত এড়াতে চান, যা 'বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাকে দুর্বল করে' দিতে পারে।
আরেলানোর মতে, জনসম্পদের তদারকি পশ্চিমা উদার গণতন্ত্রের একটি মূল বৈশিষ্ট্য। তাই আইনি জটিলতা কম হওয়া উন্নতির লক্ষণ নয়; বরং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই আসল লক্ষ্য।