রয়টার্স এক্সক্লুসিভ: ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানো বন্ধের নির্দেশ হেগসেথের, হোয়াইট হাউসও জানতো না

ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ পর যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ডোভার এয়ার ফোর্স বেস (ডেলাওয়ার) এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি মার্কিন ঘাঁটি থেকে ইউক্রেনের উদ্দেশে রওনা দেওয়া ১১টি অস্ত্রভর্তি কার্গো ফ্লাইট হঠাৎ বাতিল করে দেয়। এতে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে ইউক্রেন ও পোল্যান্ডে, যেখান থেকে এই চালানগুলো সমন্বয় করা হচ্ছিল।
এই সিদ্ধান্ত কে নিয়েছে—তা নিয়ে ওয়াশিংটনে শুরু হয় তোলপাড়। হোয়াইট হাউস, পেন্টাগন ও পররাষ্ট্র দফতরের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তারাও কিছু জানতেন না। পরে এক সপ্তাহের মধ্যেই ফের ফ্লাইটগুলো চালু হয়।
বার্তাসংস্থা রয়টার্সের এক বিশেষ অনুসন্ধানে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য।
রয়টার্স যে দলিলপত্র পর্যালোচনা করেছে, তাতে দেখা যায়—এই মৌখিক নির্দেশ এসেছিল মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথের দপ্তর থেকে।
প্রেসিডেন্ট জানতেন না
জানুয়ারির ৩০ তারিখে ইউক্রেন বিষয়ক এক বৈঠকে ট্রাম্প, হেগসেথসহ শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ইউক্রেনকে সহায়তা বন্ধের প্রস্তাব উত্থাপিত হলেও— ট্রাম্প কোনো নির্দিষ্ট নির্দেশ দেননি বলে জানিয়েছেন তিনজন সংশ্লিষ্ট সূত্র।
তবু বৈঠকের পরই হেগসেথের দপ্তর থেকে মার্কিন পরিবহন কম্যান্ডকে (ট্রান্সকম) অস্ত্রবাহী ফ্লাইট স্থগিতের মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়। হোয়াইট হাউসও পরে নিশ্চিত করে, ট্রাম্প "সাহায্য স্থগিত রাখার" নির্দেশ দিয়েছেন। তাদের এই অবস্থান সম্পর্কে কেন জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা কিছু জানতেন না, বা কেন এত দ্রুত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হলো— সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি সে সময়।
'সিলিকন ভ্যালির দর্শন' চলেনি পেন্টাগনে
এই ঘটনাকে 'নীতিনির্ধারণে বিশৃঙ্খলা'র উদাহরণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। মার্ক ক্যানসিয়ান, এক সাবেক মেরিন কর্মকর্তা ও প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক বলেন, "ওরা আগেই কাজ করে, পরে ভাবে—এটা সিলিকন ভ্যালির দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু শতবর্ষের পুরোনো প্রতিষ্ঠানগুলোয় এটা ঝুঁকিপূর্ণ।"
ট্রান্সকম-এর দলিল অনুযায়ী, ফ্লাইট বাতিলের কারণে ২.২ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়। যদিও সংস্থাটি বলছে, আসল ক্ষতি ছিল ১.৬ মিলিয়ন।
'ভিতরে বিভ্রান্তি, বাইরে ক্ষোভ'
ফ্লাইট বাতিলের কারণে কিয়েভে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ইউক্রেন সরকারের এক কর্মকর্তা জানান, মার্কিন সরকারের বিভিন্ন চ্যানেলে এবিষয়ে তথ্য জানতে চেয়েও— তারা কোনো পরিষ্কার উত্তর পাননি। পরে মার্কিন কর্মকর্তারা এটিকে 'অভ্যন্তরীণ রাজনীতি'র ফলাফল বলে ব্যাখ্যা দেন।
জানা গেছে, ট্রান্সকমের এই বাতিল আদেশের সময়— ইউক্রেনের সেনাবাহিনী পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ লড়ছিল, বিশেষ করে কুরস্ক অঞ্চলে। এই বিরতি তাদের জন্য কৌশলগতভাবে ক্ষতিকর ছিল।
উঠছে প্রশ্ন: হেগসেথ একাই কি সিদ্ধান্ত নিলেন?
হেগসেথের কিছু উপদেষ্টা, যারা কখনো সরকারি পদে কাজ করেননি এবং দীর্ঘদিন ধরে ইউক্রেনকে সহায়তার বিরোধিতা করে আসছেন, তার ওপর প্রভাব বিস্তার করেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এদের মধ্যে একজন ড্যান ক্যাল্ডওয়েলকে সম্প্রতি 'গোপন তথ্য ফাঁসের' অভিযোগে পেন্টাগন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তবে এই সহায়তা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। মার্চের ৪ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে এক ঘোষণার মাধ্যমে সহায়তা স্থগিত হয়, যার আগে ও পরে কিছু অস্ত্র চালান আবারও পাঠানো হয়েছে।
'সহজ সমাধানের' চেষ্টা থেকে 'নির্দেশ জারি': ওয়াশিংটনে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকট
হেগসেথ পলিসি প্রণয়নের জন্য একটি খসড়া স্মারকলিপি নিয়ে ওভাল অফিস বৈঠকে হাজির হয়েছিলেন, যাতে ইউক্রেনের অস্ত্র সহায়তা থামিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনায় সুবিধা আদায়ের সুপারিশ ছিল। কিন্তু এই স্মারকলিপির ভিত্তিতে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
তবে হেগসেথ হয়তো সেই আলোচনার ভুল ব্যাখ্যা করে ট্রান্সকম-কে নির্দেশ দেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টারা জানার পর, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করে অস্ত্র সহায়তা আবার চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ততক্ষণে ১১টি ফ্লাইট বাতিল হয়ে যায়।
পরিণতি: বিভ্রান্তি, রাজনৈতিক চাপ এবং আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
ঘটনার পর ইউক্রেনের ক্ষোভ ও ইউরোপীয় মিত্রদের উদ্বেগ বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এখন অভ্যন্তরীণভাবে এই বিভ্রান্তি ও দ্বন্দ্ব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যরাও হেগসেথের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
যুদ্ধ শেষের কাছাকাছি—হোয়াইট হাউস দাবি
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ক্যারোলাইন লেভিট বলেন, "রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান এখন আগের চেয়ে অনেক কাছাকাছি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার সময় যে অবস্থায় ছিলাম, এখন তা থেকে অনেক অগ্রসর হয়েছি।"