দরিদ্র দেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে কেনা জন্মনিরোধক সামগ্রী ফ্রান্সে পুড়িয়ে ফেলা হবে

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে কেনা প্রায় এক কোটি ডলারের জন্মনিরোধক সামগ্রী বেলজিয়াম থেকে ফ্রান্সে পাঠানো হচ্ছে ধ্বংস করার (দাহ করার) জন্য। কারণ, জাতিসংঘ ও পারিবারিক পরিকল্পনা সংস্থাগুলোর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মূলত জাতিসংঘ ও এ সংস্থাগুলোই এই সামগ্রীগুলো কিনে নিয়ে দরিদ্র দেশগুলোতে পাঠাতে চেয়েছিল। রয়টার্সকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই তথ্য দুটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে বেলজিয়ামের অ্যান্টওয়ার্প প্রদেশের হেল শহরের একটি গুদামে এসব সামগ্রী মাসের পর মাস আটকে ছিল।
এই জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে ইমপ্লান্ট, জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল এবং গর্ভনিরোধক যন্ত্র (আইইউডি), যা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ ঠেকাতে ব্যবহৃত হয়। সাতটি সূত্র এবং একটি স্ক্রিনশট ভাগ করে নেওয়া আরও একটি সূত্রের বরাতে এসব তথ্য জানা গেছে, যা এসব সামগ্রী ধ্বংসের পরিকল্পনার সত্যতা নিশ্চিত করেছে।
এই জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ১ লাখ ৬০ হাজার ডলার ব্যয় করবে। ফ্রান্সের একটি মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রে এসব পুড়িয়ে ফেলা হবে বলে জানিয়েছে বিষয়টি সম্পর্কে অবগত চারটি সূত্র। এর পেছনে কারণ—মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএআইডি) বন্ধ হয়ে যাওয়া।
এই জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীগুলো ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করতে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না বা এগুলো পুড়িয়ে ফেলার পরিকল্পনা নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর রয়টার্সের অনুরোধে কোনো মন্তব্য করেনি।
এই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন আইনপ্রণেতা দুটি বিল উপস্থাপন করেছেন, যার লক্ষ্য হলো এই জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ধ্বংস হওয়া ঠেকানো। তবে সহায়তা সংস্থাগুলোর মতে, এই বিলগুলো পাস হওয়ার সম্ভাবনা কম এবং এর মধ্যেই সামগ্রীগুলো পুড়িয়ে ফেলা হতে পারে।
বেলজিয়ামের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছে এবং সাময়িক স্থানান্তরসহ ধ্বংস ঠেকাতে সব সম্ভাব্য বিকল্প খতিয়ে দেখেছে।
বেলজিয়াম সরকার এক বিবৃতিতে মঙ্গলবার রয়টার্সকে জানায়, 'এইসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, এবং আমাদের অংশীদারদের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি—ধ্বংস ঠেকাতে কোনও কার্যকর বিকল্প খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবুও, এই দুঃখজনক পরিণতি এড়াতে বেলজিয়াম এখনো সক্রিয়ভাবে সমাধানের পথ খুঁজছে।'
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, 'যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য আদর্শগত বাধার শিকার হওয়া উচিত নয়।'
গুদামে জমা থাকা পণ্যের একটি অভ্যন্তরীণ তালিকা অনুসারে, যার সত্যতা তিনটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, এসব জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর মূল্য ৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার এবং এগুলোর মেয়াদ ২০২৭ সালের এপ্রিল থেকে ২০৩১ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ হবে।
এমএসআই রিপ্রোডাকটিভ চয়েসেস নামের একটি বেসরকারি সংস্থার অ্যাডভোকেসি বিভাগের সহকারী পরিচালক সারা শ' রয়টার্সকে বলেন, তারা প্রস্তাব দিয়েছিল—এই জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ইউএসএআইডি-এর লেবেল বাদ দিয়ে নতুনভাবে মোড়কজাত করে দরিদ্র দেশগুলোতে পাঠানোর জন্য যাবতীয় খরচ (রিপ্যাকেজিং, শিপিং এবং আমদানি শুল্ক) বহন করবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকার সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।
শ' বলেন, 'এমএসআই প্রস্তাব দিয়েছিল যে তারা রিপ্যাকেজিং, পরিবহন ও আমদানি শুল্ক দেবে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো আগ্রহ দেখানো হয়নি… আমাদের জানানো হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র সরকার শুধু পূর্ণ বাজারদরে এই সামগ্রী বিক্রি করবে।'
তিনি এনজিওটি কত টাকা দিতে চেয়েছিল, তা বিস্তারিত জানাননি। তবে তার মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের গর্ভপাত ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক কঠোর নীতির কারণেই এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
শ' আরও বলেন, 'এটা যে অর্থ বাঁচানোর জন্য করা হয়েছে, তা নয়। বরং এটা প্রজনন অধিকার নিয়ে একটি আদর্শগত আক্রমণের মতো মনে হচ্ছে—আর এর ফলে ইতোমধ্যেই নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।'
শ' আরও বলেন, সাহারা-পূর্ব আফ্রিকার বহু দেশ জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর জন্য ইউএসএইডের ওপর নির্ভর করত। এখন সেই সহায়তা বন্ধ হওয়ায় অনিরাপদ গর্ভপাতের সংখ্যা বাড়বে।
জাতিসংঘের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপিএ-ও এই জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী কিনে নিতে চেয়েছিল বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন তিনটি সূত্র। তবে তারা আর্থিক প্রস্তাবের বিস্তারিত জানায়নি।
তবে আলোচনার সঙ্গে জড়িত একটি সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে সাড়া না পাওয়ার কারণে আলোচনাটি ভেঙে যায়। ইউএনএফপিএ এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানায়।
বিষয়টি সম্পর্কে অবগত একটি সূত্র জানায়, ট্রাম্প প্রশাসন মেক্সিকো সিটি নীতি অনুসরণ করেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই নীতিটি গর্ভপাতবিরোধী একটি চুক্তি, যেখানে ট্রাম্প জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রকে আবার অন্তর্ভুক্ত করেন। এই নীতি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র সরকার এমন কোনো সংস্থাকে অর্থ বা সহায়তা দিতে পারে না, যারা গর্ভপাতের সুযোগ দেয় বা গর্ভপাত-সংক্রান্ত সহায়তা দেয়।
সূত্রটি জানায়, ইউএসএআইডি নিশ্চিত করতে পারছিল না যে ইউএনএফপিএ এই জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী এমন কোনো গোষ্ঠীর কাছে দেবে না, যারা গর্ভপাতের সুযোগ দেয়—যা হলে মেক্সিকো সিটি নীতির লঙ্ঘন হতো।
সূত্রটি আরও জানায়, বিষয়টি আরও জটিল হয়ে পড়ে কারণ বেলজিয়ামে থাকা এই জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীতে ইউএসএআইডির লোগো বা চিহ্ন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার চাইছিল না, এই চিহ্নযুক্ত পণ্য অন্য কোথাও পাঠানো হোক।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) সূত্রের উত্থাপিত উদ্বেগ নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি।
এমএসআই রিপ্রোডাকটিভ চয়েসেস, যাদের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে—তারা এমন একটি ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করে, যেখানে সবাই গর্ভনিরোধ এবং গর্ভপাতের সুযোগ পাবে, তারা চলতি মাসের শুরুর দিকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সমালোচনা করে বলে, 'জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা সামগ্রী ধ্বংসে তারা যেন মরিয়া', আর এতে মার্কিন জনগণের ওপর আর্থিক বোঝা আরও বেড়েছে। তবে এ বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
খবরে আরও বলা হয়, গর্ভপাত যুক্তরাষ্ট্রে একটি অত্যন্ত বিতর্কিত রাজনৈতিক ইস্যু এবং এটি ২০২৪ সালের নির্বাচনে বড় ভূমিকা রেখেছে, যেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হন। উল্লেখযোগ্যভাবে, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট গর্ভপাতের জাতীয় অধিকার বাতিল করে, যার ফলে এখন প্রতিটি রাজ্য নিজ নিজভাবে গর্ভপাত আইন প্রণয়ন করে থাকে।
'প্রয়োজন ডজন ডজন ট্রাক'
রয়টার্সকে তথ্য দেওয়া দুই সূত্রের একজন জানান, বেলজিয়ামের হেলের গুদাম থেকে ফ্রান্সে এই জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সরাতে ডজনের পর ডজন ট্রাক লাগবে এবং পুরো প্রক্রিয়ায় অন্তত দুই সপ্তাহ সময় লাগবে। একটি তৃতীয় সূত্রও এই ব্যাপক প্রস্তুতির সত্যতা নিশ্চিত করেছে। তবে ফ্রান্স সরকার এ বিষয়ে মন্তব্যের অনুরোধে তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেয়নি।
ইউএসএইডের পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সরবরাহ চেইন পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান 'চেমোনিকস'—এই সামগ্রী ধ্বংসের পরিকল্পনা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
একটি অভ্যন্তরীণ ইউএসএইড স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয় যে, বিপুল পরিমাণ জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী গুদামে পড়ে আছে এবং অতিরিক্ত ব্যয় ও অপচয় এড়াতে সেগুলো অবিলম্বে অন্য কোনো সংস্থার কাছে হস্তান্তর করা উচিত।