যুক্তরাষ্ট্র-ইইউ বাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন, ইউরোপের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ

বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনৈতিক অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে কয়েক মাস ধরে চলা অচলাবস্থার অবসান ঘটিয়ে একটি বাণিজ্য চুক্তির কাঠামোতে পৌঁছেছে উভয় পক্ষ।
স্কটল্যান্ডে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েনের মধ্যে চূড়ান্ত আলোচনার পর তারা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিতে ইইউয়ের সব পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক আরোপে সম্মত হন।
এ শুল্কহার ট্রাম্পের হুমকি দেওয়া ৩০ শতাংশ আমদানি করের অর্ধেক। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ২৭ সদস্যের এ জোট নির্দিষ্ট কিছু মার্কিন পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে মার্কিন রপ্তানিকারকদের জন্য তাদের বাজার উন্মুক্ত করবে।
ভন ডার লিয়েনও এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, চুক্তিটি দুই মিত্রের জন্যই স্থিতিশীলতা নিয়ে আসবে। এ দুই পক্ষ সম্মিলিতভাবে বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাণিজ্যের অংশীদার।
বিশ্ব অর্থনীতিকে নতুন করে সাজাতে এবং আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর লক্ষ্যে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বাণিজ্য অংশীদারদের বিরুদ্ধে শুল্ককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
ইইউ ছাড়াও তিনি যুক্তরাজ্য, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামের সঙ্গে শুল্ক চুক্তি করেছেন। যদিও '৯০ দিনে ৯০টি চুক্তি' করার লক্ষ্য তিনি পূরণ করতে পারেননি।
রোববার দক্ষিণ আয়ারশায়ারে ট্রাম্পের টার্নবেরি গলফ কোর্সে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ভন ডার লিয়েনের মধ্যে ব্যক্তিগত আলোচনার পর এই চুক্তির ঘোষণা দেওয়া হয়।
পাঁচ দিনের স্কটল্যান্ড সফরে থাকা ট্রাম্প ওই সংক্ষিপ্ত বৈঠকের পর বলেন, 'আমরা একটি চুক্তিতে পৌঁছেছি। চুক্তিটি সবার জন্যই ভালো।'
তিনি আরও বলেন, 'এ চুক্তি আমাদের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসবে।'
ভন ডার লিয়েনও 'কঠিন আলোচনার' পর একে 'বিরাট চুক্তি' বলে প্রশংসা করেন।
ইইউ আগামী তিন বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ৬০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ বাড়াবে বলে জানান ট্রাম্প। এর মধ্যে মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় ও জ্বালানি খাতে ৭৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ও রয়েছে।
ভন ডার লিয়েনের বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), তেল ও পারমাণবিক জ্বালানিতে এই বিনিয়োগ রাশিয়ার জ্বালানি উৎসের ওপর ইউরোপের নির্ভরতা কমাতে সাহায্য করবে।
বিমান ও বিমানের যন্ত্রাংশ, নির্দিষ্ট কিছু রাসায়নিক পদার্থ ও কয়েকটি কৃষি পণ্যসহ কিছু পণ্যের ওপর কোনো শুল্ক আরোপ করা হবে না। সেমিকন্ডাক্টর নিয়ে শীঘ্রই একটি আলাদা চুক্তির ঘোষণা আসতে পারে।
তবে ট্রাম্প জানান, বিশ্বজুড়ে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর তার আরোপিত ৫০ শতাংশ মার্কিন শুল্ক বহাল থাকবে।
উভয় পক্ষই এই চুক্তিকে নিজেদের বিজয় হিসেবে তুলে ধরতে পারে।
ইইউয়ের জন্য শুল্কের হার আরও খারাপ হতে পারত। যুক্তরাজ্যের ১০ শতাংশ শুল্কহারের মতো ভালো চুক্তি না পেলেও ইইউ জাপানের সমান (১৫ শতাংশ) শুল্ক পেয়েছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এ চুক্তি গত বছরের বাণিজ্য পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে সরকারি কোষাগারে প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলার শুল্ক আয়ের সুযোগ তৈরি করবে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিশ্রুত শত শত বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ।
এই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনেক সুবিধা থাকলেও ইইউ ঠিক কী লাভ করল, তা ততটা স্পষ্ট নয়।
উল্লেখ্য, ভন ডার লিয়েন বাণিজ্য সম্পর্কে 'ভারসাম্য' আনার কথা বলেছেন।
আগে ইইউ যুক্তি দিয়েছে, এই সম্পর্ক ভারসাম্যহীন নয়, কারণ ইইউ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যতটা পরিষেবা বিক্রি করে, কেনে তার চেয়ে অনেক বেশি।
গত বছর ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রায় ৯৭৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য-বাণিজ্য হয়েছে। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইইউ থেকে প্রায় ৬০৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে, আর রপ্তানি করে প্রায় ৩৭০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য।
এই ভারসাম্যহীনতা বা বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে ট্রাম্পের বড় আপত্তির রয়েছে। তিনি বলেন, এ ধরনের বাণিজ্য সম্পর্কের অর্থ হলো যুক্তরাষ্ট্র 'লোকসান' দিচ্ছে।
এদিকে ইউরোপীয় নেতারা সতর্কতার সঙ্গে এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন।
আইরিশ প্রধানমন্ত্রী তাউইশখ মিশেল মার্টিন বলেন, শুল্ক আগের চেয়ে বেশি হওয়ায় বাণিজ্য 'আরও ব্যয়বহুল ও চ্যালেঞ্জিং' হবে। ইইউ দেশগুলোর মধ্যে আয়ারল্যান্ডই রপ্তানি বাজার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল।
জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মার্জ এক্স-এ দেওয়া পোস্টে বলেছেন, বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হলে জার্মানি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হতো।
তিনি আরও বলেন, 'বাজারে প্রবেশাধিকার সুবিধাসহ স্থিতিশীল ও অনুমানযোগ্য বাণিজ্য সম্পর্ক আটলান্টিকের দুই পারের ব্যবসায়ী ও ভোক্তা—সবারই উপকারে আসবে।'
ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। চুক্তির বিস্তারিত তিনি দেখতে চান বলে জানিয়েছেন।