শুল্ক বাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র কত টাকা আয় করছে?

হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার পর থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছেন। ২ এপ্রিল, যেটিকে 'লিবারেশন ডে' নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে, সেদিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিশ্বের ডজনখানেক দেশের ওপর কঠোর পাল্টা শুল্ক (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) বা আমদানি কর আরোপের ঘোষণা দেন। এর অনেকগুলোই আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। খবর বিবিসি'র।
এরপর ট্রাম্প যুক্তরাজ্য, ভিয়েতনাম, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ কয়েকটি বাণিজ্যিক অংশীদারের সঙ্গে চুক্তি করেন, যার ফলে কিছু শুল্ক কমানো হয়।
গাড়ি ও স্টিলের মতো কিছু নির্দিষ্ট পণ্যের ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন বড় অঙ্কের খাতভিত্তিক শুল্ক আরোপ করায় গড় শুল্কহার প্রায় এক শতাব্দীর মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এই শুল্কের বোঝা মূলত বহন করতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সেই কোম্পানিগুলোকে, যারা বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করে। এর প্রভাব পড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতিতেও।
শুল্ক থেকে আরও বেশি রাজস্ব পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ল্যাবের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের গড় প্রযোজ্য শুল্কহার দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ২ শতাংশ, যা ১৯৩৪ সালের পর সর্বোচ্চ।
ট্রাম্প ক্ষমতায় ফেরার আগে, ২০২৪ সালে এই হার ছিল মাত্র ২ দশমিক ৪ শতাংশ।
শুল্কহারে এই বড় বৃদ্ধি মার্কিন সরকারের রাজস্ব আয় অনেকাংশে বাড়িয়েছে।
সরকারি তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক থেকে আয় করেছে ২৮ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪ সালের মাসিক গড় আয়ের প্রায় তিনগুণ।
মার্কিন কংগ্রেসের স্বাধীন আর্থিক পর্যবেক্ষক সংস্থা কংগ্রেশনাল বাজেট অফিস (সিবিও) জুনে জানিয়েছে, ২০২৫ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ১৩ মে পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র যে নতুন শুল্ক আরোপ করেছে, তা থেকে বাড়তি রাজস্ব আসবে। এর ফলে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত আগামী দশ বছরে দেশটির সরকারি ঋণ ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার কমতে পারে।
তবে সিবিও-র মূল্যায়নে দেখা গেছে, এই শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির মোট আয়তন কমে যাবে — অর্থাৎ শুল্ক না থাকলে যেভাবে অর্থনীতি বাড়ত, তার তুলনায় পিছিয়ে পড়বে।
সিবিও আরও জানিয়েছে, নতুন শুল্ক থেকে আসা অতিরিক্ত রাজস্ব আগামী দশকে ট্রাম্প প্রশাসনের করছাড়ের কারণে যেই রাজস্ব ক্ষতি হবে, তার তুলনায় কম হবে। অর্থাৎ শুল্কে বাড়তি আয় হলেও তা করছাড়ের ঘাটতি পূরণ করতে পারবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে
ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতিকে ক্ষতিকর হিসেবে দেখেন। তার দাবি, অন্য দেশগুলো আমেরিকায় বেশি পণ্য রপ্তানি করে আর কম আমদানি করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে ঠকাচ্ছে।
এই অসমতা দূর করতে শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল, যা আমদানি কমাবে এবং অন্য দেশগুলো আমেরিকান পণ্যের ওপর শুল্ক কমাবে—এটাই ছিল প্রত্যাশা।
কিন্তু বাস্তবে ট্রাম্পের 'ট্রেড ওয়ার' বা বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যের আমদানি আরও বেড়েছে।
এর পেছনে প্রধান কারণ, শুল্ক কার্যকর হওয়ার আগে অতিরিক্ত কর এড়াতে মার্কিন কোম্পানিগুলো আগেভাগে পণ্য মজুত করেছে। অপরদিকে, আমেরিকার রপ্তানি মাত্র সামান্য বেড়েছে।
ফলে, সামগ্রিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি কমেনি, বরং বেড়েছে।
২০২৫ সালের মার্চে এই ঘাটতি সর্বোচ্চ ১৬২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। পরে জুনে তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৮৬ বিলিয়ন ডলারে।
ট্রাম্প প্রশাসনের পণ্য মজুত করার কারণে যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়েছে, তা সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে কমবে। তবে অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি কমানো সহজ হবে না।
তাদের মতে, এই ঘাটতির মূল কারণ মার্কিন অর্থনীতির ভেতরের দুর্বলতা—দেশে উৎপাদিত পণ্যের তুলনায় খরচ অনেক বেশি; অন্য দেশগুলো আমেরিকার বিরুদ্ধে অন্যায় বাণিজ্য নীতি পরিচালনার কারণে নয়।
চীনের আমেরিকায় রপ্তানি কমছে
ট্রাম্প সময় চীনের ওপর সর্বোচ্চ ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিল। এখন তা কমে ৩০ শতাংশ হলেও, বাণিজ্য দ্বন্দ্বের কারণে চীনের আমেরিকায় রপ্তানি অনেক কমে গেছে।
২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে চীনের আমেরিকায় রপ্তানি ২০২৪ সালের একই সময়ের তুলনায় ১১ শতাংশ কমেছে।
অন্যদিকে, চীন অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধি করেছে, যা ইঙ্গিত দেয় তারা নতুন ক্রেতা পেয়েছে।
চীনের ভারতের সঙ্গে রপ্তানি এই বছরে ১৪ শতাংশ বেড়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে তা যথাক্রমে ৭ ও ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এছাড়া, চীনা কোম্পানিগুলো আংশিক প্রস্তুত পণ্য রপ্তানি করে পুরো পণ্য আমেরিকায় পাঠানোর জন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে কাজ শুরু করেছে বলে ট্রাম্প প্রশাসন উদ্বিগ্ন।
এই ধরনের 'শুল্ক এড়িয়ে যাওয়া' আগেও ঘটেছিল, যখন ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে চীনের সৌর প্যানেলের ওপর শুল্ক আরোপ করেছিলেন।
অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, চীনের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির পেছনে এ কারণ থাকতে পারে।
আরও বাণিজ্য চুক্তি
ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধে কিছু দেশ নিজেদের শুল্ক বাড়ানোর বদলে অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করেছে।
যুক্তরাজ্য ও ভারত তিন বছর ধরে চলা আলোচনার পর নতুন বাণিজ্য চুক্তি করেছে।
নরওয়ে, আইসল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও লিচটেনস্টাইন—যারা 'ইউরোপিয়ান ফ্রি ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন (ইএফটিএ)' নামে পরিচিত—ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকটি দেশের সঙ্গে নতুন বাণিজ্য চুক্তি করেছে। ওই দেশের গোষ্ঠীকে 'মার্কোসুর' বলা হয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে নতুন বাণিজ্য চুক্তি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
কানাডা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার 'আসিয়ান' দেশগুলোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার চেষ্টা করছে।
কিছু দেশ আমেরিকা ও চীনের বাণিজ্য দ্বন্দ্ব থেকে সুযোগ নিয়েছে।
চীন আগে আমেরিকা থেকে বিপুল পরিমাণ সয়াবিন আমদানি করত, যা প্রায় ৪৪ কোটি শূকরের খাবারের জন্য ব্যবহার হয়।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ব্রাজিল থেকে সয়াবিন কেনার দিকে বেশি ঝুঁকেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ ও চীনের প্রতিশোধমূলক শুল্কের কারণে এ প্রবণতা বেড়েছে।
২০২৫ সালের জুনে চীন ব্রাজিল থেকে ১০.৬ মিলিয়ন টন সয়াবিন আমদানি করেছে, আর আমেরিকা থেকে মাত্র ১.৬ মিলিয়ন টন নিয়েছে।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে চীন আমেরিকার সয়াবিনের ওপর শুল্ক বসালে আমেরিকার সরকার কৃষকদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে নতুন ভাতা দিয়েছে।
আমেরিকায় ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন, ট্রাম্পের শুল্কের কারণে আমদানির দাম বাড়ায় আমেরিকায় মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে।
জুন মাসের সরকারি মূল্যস্ফীতি ছিল ২.৭ শতাংশ, যা মে মাসের ২.৪ শতাংশের চেয়ে কিছুটা বেশি, তবে জানুয়ারির ৩ শতাংশের নিচে রয়েছে।
বছরের প্রথম দিকে পণ্য মজুত থাকায় দোকানিরা এখনও দাম বাড়ায়নি।
তবে সাম্প্রতিক তথ্য দেখায়, ট্রাম্পের শুল্ক ধীরে ধীরে আমেরিকার ভোক্তা মূল্যে প্রভাব ফেলছে।
জুনে বিশেষ কিছু আমদানি পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে—যেমন বড় ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার, খেলাধুলার সরঞ্জাম, বই ও খেলনা।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাইসিং ল্যাবের গবেষকরা ২০২৫ সালের শুল্কের প্রভাব জানার জন্য আমেরিকার চারটি বড় দোকানের অনলাইন ডেটা 'রিয়েল টাইম' বিশ্লেষণ করছেন। তারা দেখেছেন, আমেরিকায় আমদানিকৃত পণ্য ও শুল্কপ্রভাবিত দেশীয় পণ্যের দাম ২০২৫ সালে দ্রুত বেড়েছে, যা শুল্কবহির্ভূত দেশীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির চেয়ে বেশি।