ফ্রন্টলাইনে ফিরছেন রুশ কমান্ডার পোপভ: শাস্তির মাঝেই মুক্তির আশার খোঁজ?

রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সমালোচনার জেরে বরখাস্ত হওয়া একসময়ের আলোচিত সামরিক কমান্ডার মেজর জেনারেল ইভান পোপভ এবার আবার ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনে ফিরছেন। তবে এবার তিনি ফিরছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটি চুক্তির ভিত্তিতে।
তার আইনজীবী জানিয়েছেন, এ চুক্তির মাধ্যমে পোপভকে পুনরায় সক্রিয় দায়িত্ব পালনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে নিয়মিত কোনো ইউনিটে নয়, তাকে প্রাক্তন বন্দিদের নিয়ে গঠিত একটি শাস্তিমূলক ব্যাটালিয়নের নেতৃত্বে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।
দুই বছর আগে দক্ষিণ ইউক্রেনে রাশিয়ার ৫৮তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির নেতৃত্ব দিয়ে পোপভ ব্যাপক পরিচিতি পান এবং প্রশংসাও কুড়ান।
২০২৩ সালের জুলাইয়ে একটি ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিং প্রকাশের পর তার পতন শুরু হয়। সেখানে তিনি রুশ সামরিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে চিফ-অফ-স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভের কঠোর সমালোচনা করেন।
রেকর্ডিংয়ে পোপভ অভিযোগ করেন, ফ্রন্টলাইনের সেনাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন শীর্ষ কমান্ডাররা। তিনি বলেন, পর্যাপ্ত আর্টিলারি সহায়তা চাওয়ার পরই তাকে বরখাস্ত করা হয়।
পোপভ বলেন, 'ইউক্রেনের সেনারা আমাদের ভাঙতে পারেনি, কিন্তু নিজেদের কমান্ডাররাই পেছন থেকে আমাদের আঘাত করেছেন। তারা আমাদের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তে বিশ্বাসঘাতকতা করে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছেন।'
তার বরখাস্ত রাশিয়ার উগ্র-জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী, সামরিক ভেটেরান ও কিছু কর্মকর্তার মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করে। তারা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন, মন্ত্রণালয় নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতে পোপভকে চুপ করিয়ে দিয়েছে।
ওই সময় ওয়াগনার গ্রুপের বিদ্রোহ রাশিয়ান সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তোলে।
বরখাস্তের পর পোপভকে সিরিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হলেও কিছুদিন পর তাকে রাশিয়ায় জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও তিনি বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছেন।
প্রসিকিউটররা তার ছয় বছরের কারাদণ্ড দাবি করেছিলেন এবং সশস্ত্র বাহিনী থেকেও তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বহিষ্কার করা হয়। তবে জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে তার প্রতি সমর্থন কমেনি। সমালোচকরা বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
চলতি বছরের মার্চের শেষ দিকে পোপভ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে খোলা চিঠি লিখে আবেদন করেন। চিঠিতে তিনি পুতিনকে 'নৈতিক পথপ্রদর্শক' বলে উল্লেখ করেন এবং কারাদণ্ডের পরিবর্তে যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যাওয়ার সুযোগ চান।
তার আইনজীবী সের্গেই বুইনভস্কি জানান, ইউক্রেনে রাশিয়ার 'বিশেষ সামরিক অভিযানে' মোতায়েনের জন্য পোপভের বিরুদ্ধে চলমান মামলার স্থগিতাদেশ চাওয়া হয়েছে।
যদিও সামরিক আদালত এখনও এ সিদ্ধান্ত নেয়নি, রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ও যুদ্ধপন্থী ব্লগাররা ইতোমধ্যে পোপভের সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছেন।
সামরিক ব্লগার ভ্লাদিমির রোগভ লিখেছেন, 'কিংবদন্তি জেনারেল আবার ফ্রন্টে ফিরেছেন!'
তবে পোপভ আর আগের ৫৮তম ইউনিটে ফিরছেন না। এবার তাকে স্টর্ম জেড নামের একটি ইউনিটের নেতৃত্বে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ইউনিট প্রাক্তন বন্দিদের নিয়ে গঠিত এবং উচ্চ-ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখ আক্রমণের জন্য পরিচিত।
রুশ অর্থনীতি বিষয়ক দৈনিক সংবাদপত্র কমার্স্যান্ট জানিয়েছে, এ ইউনিটে সৈন্যদের মৃত্যু ঝুঁকি অনেক বেশি।
বিশ্লেষকদের মতে, পোপভের এ দায়িত্ব একদিকে শাস্তিমূলক, অন্যদিকে এটি একটি পরীক্ষা। 'ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ওয়ার'-এর গবেষক ক্যাটেরিনা স্টেপানেঙ্কো এ নিয়োগকে 'প্রায় মৃত্যুদণ্ড' বলে অভিহিত করেছেন। কারণ স্টর্ম জেড ইউনিটগুলো সাধারণত সবচেয়ে বিপজ্জনক অভিযানে পাঠানো হয়, যেখানে হতাহতের হার অনেক বেশি।
এ ধরনের ঝুঁকির মধ্যেও ক্রেমলিন প্রাক্তন বন্দিদের যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের পক্ষে। সাম্প্রতিক এক বৈঠকে পুতিন স্টর্ম জেড সদস্যদের 'ভেটেরান' মর্যাদা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বলেন, 'আমি কোনো সমস্যা দেখি না। আমার ভালো যোগাযোগ রয়েছে। আমি সরকার ও ডেপুটিদের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে পারব।'
এখন ক্রেমলিন এমন একটি পথ তৈরি করছে, যেখানে বিতাড়িত কর্মকর্তারাও নিজেদের দোষ স্বীকার করে যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে মুক্তির সুযোগ পেতে পারেন।
যদিও পোপভ তার বিরুদ্ধে আনা জালিয়াতির অভিযোগ অস্বীকার করছেন, তবু তিনি সে পথেই হাঁটছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রাক্তন বন্দিদের নিয়ে গঠিত ইউনিটের নেতৃত্বে পোপভ একেবারে নতুন নন। আগে ৫৮তম সেনাবাহিনীর কমান্ডে থাকাকালে তিনি স্টর্ম গ্ল্যাডিয়েটর ব্যাটালিয়নের তত্ত্বাবধান করেছিলেন। ওই ব্যাটালিয়নে শত শত দণ্ডপ্রাপ্ত সৈনিক ছিলেন, যাদের অনেকে সামরিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এবং ওয়াগনার বা চেচেন 'আখমাত' যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন।
২০২৩ সালে বাখমুত শহরে এ ইউনিটের এক অভিযানে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অনুমান করা হয়, তখন ইউনিটটির বেঁচে থাকার হার ছিল চল্লিশ শতাংশেরও নিচে।
এখন আবারও যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছেন পোপভ। আবারও তার নেতৃত্বে থাকছে প্রাক্তন বন্দিদের একটি কড়া নিয়মকানুনে চলা ইউনিট। তবে এবার পরিস্থিতি আরও বেশি বিপজ্জনক ও রাজনৈতিকভাবে জটিল।
তার ভবিষ্যৎ এখন নির্ভর করছে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ফ্রন্টে টিকে থাকার ওপর—এবং সম্ভবত মুক্তির একমাত্র পথও সেটাই।